করোনার কারণে কয়েক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর জার্মানির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য় নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়াসহ কয়েকটি রাজ্যে বৃহস্পতিবার থেকে স্কুল শুরু হয়েছে৷ তবে প্রথমে শুধুমাত্র শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে যেতে বলা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
এদিকে, জার্মানির কেন্দ্রীয় সরকার আগামী ৪ মে থেকে শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের দিয়ে শুরু করে ক্রমান্বয়ে সব রাজ্যের স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের ১৫ বছর বয়সি শিক্ষার্থী এলেয়া মারশোলেক রাজ্য সরকারের স্কুল খোলার সিদ্ধান্তে ‘দারুণ ক্ষুব্ধ'৷ এজন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আরমিন লাশেটকে ইনস্টাগ্রামে তিনি একটি বার্তা পাঠিয়েছেন বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন৷ বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘‘আমরা হলাম ভবিষ্যতের ভোটার৷ আর যারা আমাদের স্বাস্থ্যের কথা ভাবেন না. তাদের আমরা ভুলে যাবো না৷’’
ডয়চে ভেলেকে মারশোলেক বলেন, ‘‘আমার মনে হচ্ছে, তারা শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরীক্ষা করতে চাইছেন৷ কিন্তু আমরা গিনিপিগ নই৷’’
মারশোলেক শুধু তাকে নিয়ে চিন্তিত নন৷ তার চিন্তা, তার মাধ্যমে তার ভাই আক্রান্ত হতে পারে৷ সেই ভাই আবার বয়স্কদের সেবা দেয়ার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে৷ ‘‘আমি যদি স্কুল থেকে ভাইরাস নিয়ে আসি, আর সে (ভাই) যদি কোনো বয়স্ক মানুষের বাড়িতে সেটা নিয়ে যায়, তাহলে খুব খারাপ হবে,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন মারশোলেক৷
স্কুল খোলার শর্ত হিসেবে সরকার শিক্ষার্থীদের ডেস্ক দেড় মিটার দূরে বসানোর পরামর্শ দিয়েছে৷ এছাড়া হাত ধোয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ও যথেষ্ট পরিমাণ জীবাণুনাশক রাখতে বলা হয়েছে৷
জার্মানিতে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে জীবন
করোনা-সংকট সত্ত্বেও জার্মানি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পথে ফেরার উদ্যোগ শুরু করছে৷ প্রথম পর্যায়ে কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে৷ তবে প্রতিটি রাজ্য এ ক্ষেত্রে নিজস্ব পথ বেছে নিচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/A. Rentz
নতুন করে দৈনন্দিন জীবনের স্বাদ
প্রায় এক মাস কড়কড়ির পর জার্মানির মানুষ আবার কিছু স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছেন৷ কিন্তু দেশের সব প্রান্তে বিধিনিয়ম এক নয়৷ ১৬টি রাজ্য এ বিষয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে৷ কিছু রাজ্যে ২০শে এপ্রিল থেকে ৮০০ বর্গ মিটারের কম আয়তনের দোকানপাট খোলা হয়েছে৷ তবে এমন অভিজ্ঞতার জন্য বার্লিনের মতো কিছু রাজ্যের মানুষকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে৷
ছবি: Reuters/A. Gebert
যত মত, তত পথ
জার্মানির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য নর্থরাইন ওয়েস্টফেলিয়া অবিলম্বে দোকানবাজার খোলার পথ বেছে নিয়েছে৷ বন শহরের অনেক মানুষ চুটিয়ে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন৷ আরো এক ধাপ এগিয়ে এ রাজ্যে এমনকি হবু মায়েদের প্রয়োজনীয় পণ্যের বড় দোকান খোলার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/A. Rentz
সাইকেল কেনার উৎসাহ
ডিন্সলাকেন শহরে সোমবার সাইকেলের দোকান খোলার পর নতুন সাইকেল কেনার আশায় অনেক মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন৷ জার্মানির সব রাজ্যেই সাইকেল, বই ও গাড়ির দোকান খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে৷ অন্যান্য দোকানের মতো এ ক্ষেত্রে আয়তন সংক্রান্ত কোনো বিধিনিষেধ থাকছে না৷
ছবি: Getty Images/L. Baron
ব্যবসা-বাণিজ্য আবার চালু
দোকানের মালিকরা আবার ক্রেতাদের স্বাগত জানাতে পেরে খুবই সন্তুষ্ট৷ বসন্ত উপলক্ষ্যে কিছু ছাড় দিয়ে ক্রেতাদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন অনেকে৷ স্যাক্সনি-আনহাল্ট রাজ্যের লুডভিগসবুর্গ শহরে এক দোকানের সামনে লেখা আছে ‘‘আমরা ফিরে এসেছি৷ আপনাদের আবার দেখতে পেয়ে খুব ভালো লাগছে৷’’
ছবি: Getty Images/AFPT. Keinzle
আবার স্কুলে ফেরার আনন্দ
কিছু রাজ্যে শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে আবার স্কুলে ফিরতে পারছে৷ বার্লিন, ব্রান্ডেনবুর্গ ও স্যাক্সনি রাজ্য বেশি বয়সের শিক্ষার্থীরা ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি ও মূল পরীক্ষার জন্য সোমবার থেকে স্কুল ভবনে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে৷ জার্মানির বেশিরভাগ রাজ্যে ৪ঠা মে থেকে শিক্ষার্থীরা সেই সুযোগ পাবে৷ শুধু বাভেরিয়া রাজ্যে ১১ই মে পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Michael
চিড়িয়াখানা ও মিউজিয়ামও দরজা খুলছে
কড়াকড়ির কারণে জার্মানির চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কগুলিও বন্ধ রাখা হয়েছিল৷ কয়েকটি রাজ্যে সেই বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে৷ মেকলেনবুর্গ-ওয়েস্টার্ন পমেরানিয়া, ব্রান্ডেনবুর্গ ও রাইনল্যান্ড প্যালেটিনেট রাজ্য চিড়িয়াখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ এই তিনটি এবং আরো কিছু রাজ্যে মিউজিয়ামও খোলা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/L. Kuegeler
মাস্ক পরার চল বাড়ছে
কিছু মানুষ স্বেচ্ছায় প্রকাশ্যে মাস্ক পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ জার্মানির কিছু অঞ্চলে অবশ্য আরো বেশি মাস্ক-পরা মানুষ চোখে পড়ছে৷ দেশজুড়ে বাধ্যতামূলক না হলেও কয়েকটি রাজ্য ও পৌর কর্তৃপক্ষ এই নিয়ম চালু করছে৷ যেমন স্যাক্সনি রাজ্যে এপ্রিল মাস থেকে ট্রাম-বাস বা ট্রেনে এবং দোকানবাজারে মাস্ক পরা অথবা অন্য কোনো উপায়ে মুখ ও নাক ঢাকা বাধ্যতামূলক৷ বাভেরিয়াসহ আরো কিছু রাজ্যেও এমন নিয়ম চালু হয়েছে৷
ছবি: Reuters/W. Rattay
ব্যবধান বজায় রাখুন!
গোটা দেশজুড়ে সামাজিক দূরত্ব সংক্রান্ত নীতিমালায় কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না৷ বাসার মানুষ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কমপক্ষে দেড় মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে৷ যে সব দোকান খোলা হচ্ছে, সেখানেও নানাভাবে ক্রেতাদের মধ্যে এই দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/L. Baron
8 ছবি1 | 8
তবে বাস্তবে এসব মানা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এক শিক্ষার্থীর মা সুজানে হাওসার৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি জানি আমার মেয়ের স্কুলের টয়লেট কীরকম৷ সে যতটা সম্ভব ওটা ব্যবহার থেকে বিরত থাকে৷’’ সুজানে হাওসারের বয়স ৫৩ এবং হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট থাকার কারণে তিনি করোনার উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন৷
অবশ্য স্কুলে যাওয়া, না যাওয়ার সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীরা নিতে পারবে বলে জানিয়েছে নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্য৷ তারপরও এমন সিদ্ধান্তে বিরক্ত সুজানে হাওসার৷ তিনি বলছেন, তাঁর মেয়েকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হচ্ছে৷ ‘‘একদিকে সে কিছু মিস করতে চায় না, অন্যদিকে একজন অভিভাবক হারানোর বিনিময়ে সার্টিফিকেট পাওয়ার কী মানে,’’ বলছেন সুজানে হাওসার৷
তাঁর মতো অনেক অভিভাবক রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তে অবাক ও উদ্বিগ্ন হয়েছেন৷ এমন অভিভাবকদের কাছ থেকে অনেক টেলিফোন পাওয়ার কথা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন রাল্ফ রাডকে৷ তিনি নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের অভিভাবকদের সংগঠনের নেতা৷
এই অবস্থায় কয়েকজন শিক্ষার্থী স্কুল বয়কটের আহ্বান জানিয়ে অনলাইনে একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেছে৷ ইতিমধ্যে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এতে অংশ নিয়েছে৷ অনেকে বলছেন, কোর্সওয়ার্কের ভিত্তিতে তাদের সার্টিফিকেট দেয়া হোক৷ আর যে শিক্ষার্থীরা মার্ক ভালো করতে চায় তারা স্কুলে যেতে পারে৷
নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যে এখন পর্যন্ত ৩১ হাজারের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা জার্মান রাজ্যগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ৷ মারা গেছেন এক হাজার জনের বেশি৷
করোনায় জার্মানিতে এখন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ হাজার জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷
নিকোলাস মার্টিন/জেডএইচ
কড়াকড়ি উঠে গেলেও জার্মানিতে কী কী বন্ধ থাকবে?
করোনা সংকটের কারণে জার্মানিতে কড়াকড়ির মেয়াদ আপাতত ৩ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে৷ এই সময়ে বা তারপরেও কিছু ক্ষেত্রে বাধানিষেধ তুলতে চাইছে না সরকার৷ এমনই কিছু দৃষ্টান্তের দিকে নজর দেওয়া যাক৷
ছবি: JACQUES COLLET/AFP/Getty Images
কমপক্ষে দেড় মিটার দূরত্ব
সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে প্রকাশ্যে মানুষের মধ্যে কমপক্ষে দেড় মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে৷ একা, দুইজন অথবা পরিবার বা বাসার অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে বার হওয়ার অনুমতি রয়েছে৷ সব ক্ষেত্রেই কড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে৷ করোনায় আক্রান্ত কোনো মানুষ যাতে বড়জোর একজনের বেশি মানুষকে সংক্রমিত করতে না পারে, সেই লক্ষ্যেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Sommer
বন্ধ থাকবে কিন্ডারগার্টেন
স্কুলের নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্লাস আবার চালু করার সিদ্ধান্ত নিলেও সরকার এখনো কিন্ডারগার্টেন খুলতে সাহস পাচ্ছে না৷ শিশুদের কাছে সামাজিক দূরত্ব ও কড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রত্যাশা করা কঠিন বলেই মূলত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পেশার মানুষ যাতে কাজে যেতে পারেন, সেই লক্ষ্যে তাদের শিশুদের দেখাশোনার জন্য জরুরি ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Fassbender
বার, রেস্তোঁরা খুলছে না
বার বা রেস্তোরাঁর বদ্ধ ঘরে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি বলে এই সব স্থাপনাও আপাতত বন্ধ রাখছে জার্মানির সরকার৷ তবে কিছু রেস্তোঁরা রান্না করা খাবার কেনার ব্যবস্থা শুরু করেছে৷ বাইরে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে অর্ডার দিয়ে মোড়কবন্দি খাবার কিনছেন অনেক মানুষ৷ বাসায় খাবার পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করলেও বাধা নেই৷
ছবি: picture-alliance/D. Kubirski
বড় আকারের অনুষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা
কনসার্ট, উৎসব, খেলার ম্যাচ ইত্যাদি যে সব অনুষ্ঠানে অনেক মানুষের সমাবেশ হয়, সেগুলি আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত বন্ধ রাখছে জার্মানির সরকার৷ ভিড় যেখানে অনিবার্য, সেখানে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা কার্যত অসম্ভব৷ আয়োজকদের পক্ষেও এমন গ্যারেন্টি দেওয়া সম্ভব নয়৷ একই কারণে বন্ধ থাকছে মিউজিয়াম, গ্যালারির মত স্থাপনাও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রার্থনা করা যাবে না উপাসনালয়ে
গির্জা, মসজিদ, সিনাগগ, মন্দির – কোনো ধর্মের মানুষই আপাতত সমবেত হয়ে প্রার্থনা করতে পারবেন না৷ সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্কের পর ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে৷ উপাসনালয়ে কড়া বিধিনিয়ম নিশ্চিৎ করে প্রার্থনার ব্যবস্থা করতে পারলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা চিন্তা করবে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gentsch
ভ্রমণ, পর্যটনের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে
ভ্রমণেও বহাল থাকছে নিষেধাজ্ঞা৷ এমনকি দেশের মধ্যে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের কাছে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞাও তুলে নিচ্ছে না সরকার৷ খুব জরুরি ক্ষেত্রে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে৷ পর্যটকের অভাবে বেশিরভাগ হোটেলও বন্ধ থাকছে৷ সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নিত্যযাত্রীদের জন্য শুধু কয়েকটি হোটেল খোলা রাখা হচ্ছে৷ তবে ১৪ দিনের কোয়ারান্টিনের নিয়ম মেনে বেশি মানুষ সেই সুযোগ গ্রহণ করছেন না৷