রাজার ঘরে জন্ম, জার্মানিতে পড়ালেখা, রাজা রুডলফ দৌয়ালা মাঙ্গা বেল জার্মান সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন৷ কিন্তু জার্মান উপনিবেশের সময় যখন তার জনগণ অত্যাচারিত হতে লাগলো, তখন রুখে দাঁড়ালেন তিনি৷ শেষ পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলতে হয় তাকে৷
বিজ্ঞাপন
রুডলফ দৌয়ালা মাঙ্গা বেল কে?
১৮৭৩ সালে দৌয়ালায় জন্ম তার৷ তিনি রাজা এনদুম্বে লোবে বেলের নাতি, যিনি রাজা বেল নামে সুপরিচিত ছিলেন৷ ১৮৮৪ সালে জার্মান সাম্রাজ্যের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি৷ পড়ালেখার জন্য রুডলফ দৌয়ালা জার্মানিতে গিয়েছিলেন৷ পরে বাবাকে সাহায্য করতে ক্যামেরুনে ফিরে আসেন এবং ১৯০৮ সালের ২রা সেপ্টেম্বর রাজা হন৷
রুডলফ দৌয়ালা কেনো জার্মান ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন?
জার্মান আইন সম্পর্কে জানতে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়েছিলেন রুডলফ৷ সেই সুবাদে জার্মানির ঔপনিবেশিক প্রশাসনে কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো তার৷ এরপরই জার্মান শাসনের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব জন্মায় তার৷ তিনি দেখলেন, জার্মানরা নিজেদের তৈরি আইন লঙ্ঘন করছে৷ দুই বছর রাজত্বের পর দৌয়ালার অনুসারীরা তার নেতৃত্বে জার্মান ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন৷ রুডলফের বক্তব্য ছিলো, জার্মানরা অবৈধভাবে তাদের জমি দখল করছে, যা তার দাদার সাথে হওয়া চুক্তির লঙ্ঘন৷
দৌয়ালাতে সেসময় একটি শহর ছিলো যেখানে ইউরোপীয়রা থাকতো আর অন্য একটি শহরে থাকতো কৃষ্ণাঙ্গরা৷ জার্মানরা কৃষ্ণাঙ্গদের দূরে রাখতে চাইতো, তাদের অভিযোগ, কৃষ্ণাঙ্গরা ম্যালেরিয়া ছড়ায়৷
কীভাবে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রুডলফ?
জার্মানির ঔপনিবেশিক ইতিহাস: বর্ণবাদী, নির্মম, নিষ্ঠুর
জার্মান ঔপনিবেশিক ইতিহাসে জার্মানরা ভয়াবহ ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল৷ দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকার যে অংশ (বর্তমানে নামিবিয়া) জার্মানদের অধীনে ছিল, সেখানে হেরেরো এবং নামাদের উপর গণহত্যা চালিয়েছিল তারা৷
ছবি: public domain
জার্মান উপনিবেশ
চ্যান্সেলর ওটো ফন বিসমার্কের আমলে নামিবিয়া, ক্যামেরুন, টোগো, তানজানিয়া এবং কেনিয়ার কিছু অংশে ছিল জার্মানির উপনিবেশ৷ সম্রাট দ্বিতীয় ভিলহেল্ম ১৮৮৮ সালে দায়িত্ব নিয়ে এই কলোনি আরও বিস্তারের উদ্যোগ নেন৷
ছবি: picture alliance/dpa/K-D.Gabbert
উপনিবেশের বিস্তার
ঐ উদ্যোগের ফলে নিউগিনির উত্তরাঞ্চল, বিসমার্ক আর্কিপেলাগো ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এবং সামোয়া ও চীনের সিংতাওতে তা বিস্তার লাভ করে৷ ১৮৯০ সালে ব্রাসেলসে এক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় জার্মান সম্রাট রুয়ান্ডা এবং বুরুন্ডিসহ পূর্ব আফ্রিকা দখল করবেন৷ উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এসব এলাকা দখল করে জার্মানরা৷
ছবি: picture-alliance / akg-images
ব্যবস্থার বৈষম্য
এই এলাকাগুলোতে শেতাঙ্গ কম ছিল৷ ১৯৪১ সালে মাত্র ২৫ হাজার জার্মান এসব এলাকায় বাস করত৷ আর ১ কোটি ৩০ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ তাদের অধীনে কাজ করত, যাদের বৈধভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁইটাও ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/arkivi
বিংশ শতাব্দীর প্রথম গণহত্যা
জার্মান ঔপনিবেশিক ইতিহাসে জার্মানরা ভয়াবহ ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল৷ সেই সময়ের দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকার যে অংশ (বর্তমানে নামিবিয়া) জার্মানদের অধীনে ছিল, সেখানে হেরেরো এবং নামাদের উপর গণহত্যা চালিয়েছিল তারা৷ ১৯০৪ সালের ওয়াটারব্যর্গ যুদ্ধে বেশিরভাগ হেরেরো বিদ্রোহী মরুভূমিতে পালিয়ে গিয়েছিল৷ জার্মান সেনারা তখন তাদের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়৷ ফলে সেখানেই প্রাণ হারায় ৬০ হাজার হেরেরো৷
ছবি: public domain
জার্মান অপরাধ
ঐ সময় ১৬ হাজার হেরেরো বেঁচে গিয়েছিল৷ তাদের নির্যাতন শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ ভয়াবহ নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছিল বেশিরভাগের৷ এখনও জানা যায়নি আসলেই কত বন্দি তখন মারা গিয়েছিল৷ এটা নিয়ে এখনো সমালোচনা হয়৷ এমনকি যে অল্প কয়েকজন সেখান থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছিল, তাদেরও সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল৷ জীবণধারণের জন্য কিছুই অবশিষ্ট ছিল না তাদের৷
ছবি: public domain
ঔপনিবেশিকতার ভয়াবহ চিত্র
১৯০৫ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব আফ্রিকায় জার্মান উপনিবেশের প্রতিবাদে সোচ্চার হয় উপজাতি গোষ্ঠীগুলো৷ এই বিদ্রোহে প্রাণ হারায় অন্তত এক লাখ মাজি-মাজি নৃ গোষ্ঠী৷ তানজানিয়ার ইতিহাসে এটা একটা বড় ঘটনা হলেও জার্মান ইতিহাসে এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না৷
ছবি: Downluke
১৯০৭ এর সংস্কার
ঔপনিবেশিক যুদ্ধের পর জার্মান প্রশাসন ঐসব এলাকায় মানুষের জীবন মানের উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়৷ ব্যার্নহার্ড ডার্নব্যুর্গ একজন সফল উদ্যোক্তা, যাকে ১৯০৭ সালে কলোনিয়াল অ্যাফেয়ার্সের রাজ্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং তিনি ঔপনিবেশিক নীতিমালা সংস্কার করেন৷
ছবি: picture alliance/akg-images
বৈজ্ঞানিক গবেষণা
ডার্নব্যুর্গের এই সংস্কারের ফলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে চুক্তি হয়৷ এর আওতায় হামবুর্গ আর কাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য আলাদা বিভাগ গড়ে তোলা হয়৷ ১৯০৬ সালে রবার্ট কোখ পূর্ব আফ্রিকার মানুষের ঘুমের সমস্যা নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন৷
ছবি: Deutsches Historisches Museum/T. Bruns
শান্তিচুক্তি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হারের পর জার্মানি ১৯১৯ সালে ভার্সিলিদের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে, সেখানে বলা হয় জার্মানি ভার্সিলিদের তাদের সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দিচ্ছে৷
ছবি: DW/J. Hitz
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আগে
নাৎসি আমলে ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ইচ্ছে আবারও প্রবল হয় জার্মানদের মধ্যে৷ এবার তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দিকে হাত বাড়ায়৷ পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে শুরু করে হত্যাযজ্ঞ৷ এছাড়া তারা আফ্রিকায় তাদের আধিপত্য ফিরিয়ে আনারও চেষ্টা করেছিল৷ ১৯৩৮ সালে একটি স্কুলের এই মানচিত্র থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/J. Hitz
10 ছবি1 | 10
রুডলফ প্রথমে জার্মানিতে আন্দোলন শুরু করলেন, যেখানে তাকে বিদ্রোহী বলে ডাকা শুরু হল৷ যেহেতু তিনি জার্মানির স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছিলেন, তাই আইনি পথেই লড়াইটা শুরু করেছিলেন তিনি৷ যখন তিনি দেখলেন কোন কৌশলই খাটছে না, তখন দৌয়ালাতে আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নিলেন৷
কীভাবে মারা গেলেন রুডলফ?
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মানরা তাদের বিদ্রোহীদের দমনের সিদ্ধান্ত নিলো৷ জার্মান প্রশাসন রুডলফ দৌয়ালার বিচার করলো এবং সে বছরের ৭ই আগস্ট তাকে গ্রেপ্তার করা হলো৷ বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো৷ সেই রাতেই কর্নেল সিমারমান তাকে শৃঙ্খলমুক্ত করে তার রানী ও যুবরাজদের কাছ থেকে বিদায় নিতে বললেন৷ চাইলে তিনি পালাতে পারতেন৷ কিন্তু তিনি পরের দিন জার্মান সেনাদের কাছে যান৷ ৮ই আগস্ট তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়৷ তার শেষ কথা ছিলো: ‘‘তোমরা নিষ্পাপ একজন মানুষকে ফাঁসি দিচ্ছো৷ অকারণে আমাকে হত্যা করছো৷ এর ফলাফল হবে ভয়াবহ৷''
ক্যামেরুনের মানুষ কীভাবে তাকে স্মরণ করছে?
জার্মান ঔপনিবেশিক প্রভুদের বিরোধিতা করার জন্য ক্যামেরুনের মানুষ রুডলফ দৌয়ালা মাঙ্গা বেলকে একজন শহীদ ও বীরের মর্যাদা দিয়েছে৷ কয়েকজন ইতিহাসবিদের মতে, দৌয়ালা মাঙ্গার বিদ্রোহের কারণেই ক্যামেরুন স্বাধীন হয়েছে৷