বুন্ডেস্টাগ বা জার্মান সংসদের ছবি তুলেছেন সান ফ্রান্সিসকোর শিল্পী ক্যারমিট ব্যার্গ বুন্ডেস্টাগেরই ফরমায়েশে৷ নিও-রেনেসাঁস শৈলী থেকে শুরু করে ব্রিটিশ স্টার স্থপতি নর্মান ফস্টারের কাচের গম্বুজ, সব কিছুর ছবি৷
বিজ্ঞাপন
শুধুমাত্র যখন সংসদের অধিবেশন চলছে না, তখন ছবি তুলতে পারতেন৷ এমনকি সংসদকক্ষ পুরোপুরি খালি থাকলেও ছবি তোলার অনুমতি ছিল না৷ তবে অন্যান্য অনেক স্বাধীনতা ছিল৷ ব্যার্গ স্মৃতিচারণ করলেন, ‘‘স্বচ্ছন্দে অনুমতি পাওয়া যেত, যেমন এই দেওয়ালটার পিছনে রয়েছে সাংসদদের ভোট দেওয়ার কার্ড – আমার জন্য দেওয়ালটা খোলা হয়েছিল৷ আমি সেই খোলা দেওয়ালের যে ছবি তুলি, পরে বুন্ডেস্টাগ সেটা কিনেছে৷''
বুন্ডেসটাগ এককালে ছিল রাইখস্টাগ৷ বাইরেটা নিও-রেনেসাঁস শৈলীর, পরে তার উপর একটি কাঁচের গম্বুজ যোগ করেন ব্রিটেনের প্রখ্যাত স্থপতি নর্মান ফস্টার৷ ভেতরের কক্ষগুলো আধুনিক ও স্বচ্ছ৷ ১৯৬৯ সাল যাবৎ জার্মান সংসদ শিল্পকলা সংগ্রহ করে চলেছে: রাইখস্টাগের দেওয়াল আর সাংসদদের অফিসের জন্য কিনেছে ছবি আর ভাস্কর্য৷ এ কাজের দায়িত্বে রয়েছেন আন্দ্রেয়াস ক্যার্নবাখ৷
এমন ছবি, যা সংসদেরও মনে ধরে
04:19
ক্যার্নবাখ মন্তব্য করলেন, ‘‘স্বভাবতই আমরা এমন সব শিল্পকলা খুঁজি, সংসদ ও রাজনীতির সঙ্গে যার কোনো একটা সংযোগ রয়েছে৷ ক্যারমিট ব্যার্গ-এর ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে প্রযোজ্য: সংসদের শিল্প উপদেষ্টা পরিষদ তাঁকে এমন সব ছবি তুলতে বলেছে, যা-তে এই সংযোগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ আমাদের আশা ছিল যে, তিনি সংসদের কাজকর্ম, স্থাপত্য, পরিবেশ, সব কিছু নতুন চোখ দিয়ে দেখে এবং দেখিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের আদর্শকে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন৷''
যা সাধারণত চোখেই পড়ে না
বুন্ডেস্টাগ ইতিমধ্যেই ব্যার্গের দশটি ছবি কিনেছে৷ এই লাউডস্পিকারটিও ব্যার্গকে মুগ্ধ করেছে৷ সবাই যখন চোখে পড়তে আকুল, তখন তিনি এমন সব জিনিসের ছবি তোলেন, যেগুলো সাধারণত চোখেই পড়ে না৷ ব্যার্গের মতে, ‘‘ওরা যদি আমার ছবি নিয়ে মাথা ঘামায়, তাহলে ওরা এই পরিবেশ সম্পর্কে বিশদ একটা ধারণা পাবে – যেখানে ওরা সাধারণত এই পরিবেশের একটা ভাসা ভাসা ধারণা পায়, যার কোনো কিছুই ঠিকমতো মনে থাকে না; ওরা কোনো খুঁটিনাটি দেখেনি, কোনো আলোছায়া দেখেনি; যা কিছু এই ঘরটাকে জীবন্ত করে তুলেছে, তার সব কিছুই ওদের নজর এড়িয়ে গেছে৷''
৬৪ বছর বয়সি ক্যারমিট ব্যার্গ রাইখস্টাগে এলে কিছুই ছাড়েন না৷ শেষমেষ এমন একটা ঘর খুঁজে পেয়েছিলেন, যা অধিকাংশ মানুষের অজ্ঞাত৷ এটা হলো সংসদের রেফারেন্স লাইব্রেরি৷ সংসদ মানেই ভাষণ৷ কাইজারের আমল থেকে ভাইমার প্রজাতন্ত্র হয়ে হালআমল পর্যন্ত যাবতীয় সংসদীয় বিতর্কের প্রোটোকল নথিবদ্ধ করা আছে এখানে৷ ব্যার্গ জানালেন, ‘‘জায়গাটা ঠান্ডা নয়, বরং আতিথেয়তাপূর্ণ; কিন্তু উপস্থাপনায় পুরোপুরি নান্দনিক৷ তারপর আমি পড়তে শুরু করি, এই সব বইতে কি আছে, তাদের উপজীব্য, তাদের ইতিহাস৷ আমি জার্মানির ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষভাবে আগ্রহী৷ আমিও এসেছি জার্মান পটভূমি থেকে৷''
‘প্রজাতন্ত্রের প্রাসাদ’ ভেঙে ‘নগর প্রাসাদ’
‘পালাস্ট ডেয়ার রেপুবলিক’ ছিল পূর্ব জার্মানির ক্ষমতার কেন্দ্র, তথাকথিত ‘ফলক্সকামার’ বা গণপ্রতিনিধিদের কক্ষ৷দশ বছর আগে জার্মান সংসদ ভবনটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়৷
ছবি: picture alliance/akg-images
জিডিআর-এর ট্রেডমার্ক
প্রজাতন্ত্রের প্রাসাদ ছিল কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানির প্রেস্টিজ প্রোজেক্ট৷ তৈরি হতে প্রায় তিন বছর লাগে, উদ্বোধন হয় ১৯৭৬ সালের ২৩শে এপ্রিল তারিখে৷ বাড়ির বাইরেটা এক ধরনের সোনালি-বাদামি আয়নার কাচ দিয়ে ঢাকা৷ এখানে যে শুধু পূর্ব জার্মান সংসদের অধিবেশন বসতো, এমন নয় – রক কনসার্ট, থিয়েটার, ফ্যাশন শো, সব কিছু হয়েছে এখানে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বড়লোকি চাল
আলোঝলমলে পালাস্ট ডেয়ার রেপুবলিক-কে পূর্ব জার্মানির মানুষরা বলতেন, লোকদেখানো, বড়লোকি চাল৷ নয়তো এরিক-এর বাতির দোকান৷ এরিক বলতে কমিউনিস্ট এসইডি দলের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি এরিক হনেকার৷ প্রাসাদটি ব্যবহার করা হয় মাত্র ১৯৯০ সাল অবধি৷ সে-বছর পূর্ব জার্মানির প্রথম নিরপেক্ষভাবে নির্বাচিত সংসদ ভবনটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, প্রাসাদ নির্মাণে বিষাক্ত অ্যাজবেস্টস স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছে বলে৷
ছবি: picture alliance/akg-images
প্রাসাদের চত্বর
দুই জার্মানির পুনর্মিলনের পর জার্মান বুন্ডেসটাগ একবার নয়, দু’বার নয়, তিন-তিনবার প্যালেসটি ভেঙে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে – ২০০২, ২০০৩ ও ২০০৬ সালে৷ তার জায়গায় বার্লিনের কেন্দ্রে একটি নতুন সাংস্কৃতিক ফোরাম তৈরি করার কথা ভাবা হচ্ছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eisele
ভাঙাগড়া
অ্যাজবেস্টস পরিষ্কার করা খুব সহজ নয়৷ কাজেই বাড়িটা ভাঙতেও দেরি হয়েছে৷ গোড়ায় ২০০৭ সালের মধ্যেই তা ভেঙে ফেলার কথা ছিল, কিন্তু সে সময়সীমা বজায় রাখা সম্ভব হয়নি৷ শেষমেষ সেই বাড়ি ভাঙায় খরচা হয়েছে এক কোটি ইউরোর বেশি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Pilick
খোলনলচে
১৯৯০ সালে ভবনটি বন্ধ করে দেবার পর, সেটির ভিতর থেকে সব কিছু সরিয়ে নেওয়া হয়, যা-তে শুধু বাইরের খোলটাই পড়ে থাকে৷ ২০০৬ সালের বসন্তে বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু হয়৷ সব মিলিয়ে মোট ৫০০ টন কাচ, দু’হাজার টন ইস্পাত ও ৫৬ হাজার টন কংক্রিট সরাতে হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/S. Gallup
ধাপে ধাপে
ভবনটা তৈরি করতে সময় লেগেছিল ৩২ মাস৷ সেটাকে ভেঙে ইট-কাঠ-পাথর সব সরাতে সময় লেগেছে তার চেয়ে বেশি – সে কাজ শেষ হয় ২০০৮ সালে৷ তারপর প্রাসাদের কংক্রিটের ভিত্তিটা এক লক্ষ ঘনমিটার বালি দিয়ে ভরাতে হয়৷ নয়ত রাস্তার অপর পারে বার্লিন ক্যাথিড্রাল ধসে যেতে পারত৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Sax
বিতর্কিত বিষয়
বার্লিনের ঐতিহাসিক ‘স্টাটশ্লস’ বা সিটি প্যালেস খাড়া ছিল ঠিক এই পালাস্ট ডেয়ার রেপুবলিকের জায়গায় – ১৪৪৩ সাল থেকে ১৯৫০ সাল অবধি৷ প্যালেস ভেঙে ‘স্টাটশ্লস’ করা নিয়ে বহুদিন বিতর্ক চলেছে৷ কেন তা করা হবে? এভাবে কি জার্মানি তার নিজের ইতিহাসের একটা অধ্যায় মুছে দেবার চেষ্টা করছে না?
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Burgi
‘হুমবোল্ট-বক্স’
পালাস্ট ডেয়ার রেপুবলিক ভেঙে ফেলার পর জায়গাটায় ঘাস বোনা হয় ও গাছপালা লাগানো হয়৷ ২০১১ সালে আসে হামবোল্ট বক্স নামধারী এই সাময়িক কাঠামোটি, যেখানে সিটি প্যালেস ও হামবোল্ট ফোরাম সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে পাওয়া যাবে৷ মডেল ও ইন্টারঅ্যাকটিভ প্রদর্শনীর মাধ্যমে এলাকাটির চূড়ান্ত রূপ কী হবে, দর্শকরা সে বিষয়ে জানতে পারবেন৷
ছবি: picture-alliance/D. Kalker
নতুন প্রাসাদ
আপাতত দেখতে পাওয়া যাবে বার্লিন সিটি প্যালেসের কংক্রিটের ধাঁচা, তার বেশি কিছু নয়৷ তা-তেই ইতিমধ্যে কেন্দ্রের খরচা পড়েছে ৫৯ কোটি ইউরো৷ প্রাসাদের ব্যারোক শৈলীর সম্মুখভাগ তৈরিতে খরচ পড়বে আট কোটি ইউরো, যার সবটাই নাকি আসবে দান থেকে৷ ২০১৯ সাল থেকে হামবোল্ট ফোরাম এখানে বিভিন্ন প্রদর্শনী, নাট্যাভিনয় ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Zinken
9 ছবি1 | 9
বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর গোলটেবিল বৈঠকের নথিপত্র সম্পর্কে ক্যারমিট ব্যার্গ আরো জানতে আগ্রহী, কেননা পূর্ব জার্মানির জনগণ তাতে অংশগ্রহণ করেছিল৷
ছবি তোলার বিষয় খুঁজতে গিয়ে ব্যার্গ অন্যান্য শিল্পীদের কাজও আবিষ্কার করেন, যেমন ‘‘জার্মান সাংসদদের মহাফেজখানা'' নামের একটি ইনস্টলেশন৷ ফরাসি শিল্পী ক্রিস্তিয়ঁ বোলতানস্কি পাঁচ হাজার লোহার বাক্স দিয়ে ইনস্টলেশনটি সাজান৷ অথবা ক্রিস্টিয়ানে ম্যোবুস-এর রেসিং বোটগুলি – এটিও একটি ইনস্টলেশন, নাম ‘‘ওঠাপড়া আর যাত্রা''৷
ক্যারমিট ব্যার্গ সব জায়গাতেই তাঁর নিজের ছাপ রেখে যান, রাইখস্টাগের বাইরেও৷
চিরকালের সেরা সব বাগানের ছবি
লন্ডনের রয়াল অ্যাকাডেমির একটি প্রদর্শনীতে দেখানো হচ্ছে ১৮৭০ থেকে ১৯২০, এই ৫০ বছরে চিত্রকলায় বাগানের রূপ কিভাবে বদলেছে৷
ছবি: Portland Art Museum, Portland, Oregon
বাগানে মহিলা
ফরাসি ‘ইম্প্রেশনিস্ট’ চিত্রকরদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা সম্ভবত ক্লদ মোনে৷ ১৮৬৭ সালে তিনি আঁকেন তাঁর এক আত্মীয়ার ছবি, সে আমলের লম্বা ড্রেস পরা, প্যারাসল হাতে রোদঝলমল বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছেন৷ পরে জিভের্নিতে তাঁর নিজের হাতে গড়া বাগানের ছবি এঁকে মোনে বিশ্বখ্যাত হন৷
ছবি: The State Hermitage Museum. Photography: Vladimir Terebenin
পার্ক থেকে প্রেরণা
আউগুস্ত রেনোয়া যে আমলে আঁকছিলেন, তখন প্যারিসে পাবলিক পার্ক নিয়ে খুব ধুম চলেছে৷ রাজকীয় পার্কগুলোতে আপামর জনতাকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে; সাধারণ নাগরিকরাও বাড়ির সামনে ছোট ছোট বাগান করছেন৷ প্যারিসের এই সব পার্ক আর বাগান থেকেই রেনোয়া তাঁর ছবি আঁকার প্রেরণা পেতেন৷ ১৮৭৩ সালে তিনি আঁকেন তাঁর বন্ধু ক্লদ মোনের ছবি৷ মোনে তখন আর্জঁতুই-য়ে তাঁর নিজের বাগানে ইজেল বসিয়ে, ক্যানভাস পেতে ছবি আঁকছেন৷
ছবি: Wadsworth Atheneum Museum of Art, Hartford, CT
মস্কো থেকে বাভারিয়া
ভাসিলি কান্ডিনস্কিকে বিমূর্ত চিত্রকলার জনক বলে মনে করা হয়৷ ১৯০৯ সালে তাঁর সঙ্গিনী গাব্রিয়েল ম্যুন্টার বাভারিয়া রাজ্যের মুর্নাউ শহরের কাছে স্টাফেলজে হ্রদের ধারে একটি বাড়ি কেনেন৷ কান্ডিনস্কির জন্ম মস্কোয়, তাই প্রতিবেশীরা বাড়িটির নাম দিয়েছিলেন রাশিয়ান হাউস৷ দু’জনেই তাদের নিজের তৈরি বাগানটাকে ভালোবাসতেন৷ কান্ডিনস্কির ছবিতে একাধিকবার এই বাগান দেখতে পাওয়া যাবে, যেমন ১৯১০ সালে আঁকা এই ছবিটিতে৷
ছবি: Merzbacher Kunststiftung
স্পেনের তরল সূর্য
স্পেনের তরল সূর্য স্পেনের চিত্রকর ইওয়াকিন সোরোল্লাকে ‘আলোর ছবি-আঁকিয়ে’ বলে মনে করা হয়৷ তিনি টিফানি ল্যাম্প খ্যাত মার্কিন ডিজাইনার লুইস কম্ফর্ট টিফানির এই ছবিটি আঁকেন ১৯১১ সালে৷ দেখলে মনে হবে, টিফানি স্পেনের একটি ফুলে ভরা বাগানে বসে খানিকটা রেস্ট নিচ্ছেন৷
ছবি: Courtesy of The Hispanic Society of America, New York
বাগানে পা ছড়িয়ে...
পিয়ের বনার প্যারিসের দৈনন্দিন জীবনের ছবি আঁকতেন উজ্জ্বল সব রঙে৷ যেমন এই তরুণী মহিলাটি, যিনি বাগানে তাঁর আরাম কেদারার ওপর পা ছড়িয়ে বসে বিশ্রাম করছেন৷ পাশে টেবিলে সব প্রয়োজনীয় বস্তু৷ বনার ছবিটি আঁকেন ১৯১৪৷
ছবি: Nasjonalmuseet for kunst, arkitektur og design/The National Museum of Art, Architecture and Design/(c) ADAGP, Paris and DACS, London 2015
শিল্পীর বাগান
ক্লদ মোনের ‘জলপদ্ম’ পর্যায়ের ছবিগুলি আঁকা হয় ১৯১৪-১৫ সালে৷ এগুলি সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে আইকনিক ছবিগুলির পর্যায়ে পড়ে৷ জিভের্নি-তে তাঁর নিজের বাগানেও জলপদ্ম লাগিয়েছিলেন মোনে৷ ১৯২৬ সালে মৃত্যুর স্বল্প আগে বলেছিলেন, আমার বাগানই হল আমার সবচেয়ে বড় শিল্পকর্ম৷