বাধ্যতামূলক টিকা — ২০২১ সালের সবচেয়ে বিতর্কিত দুটি শব্দ হবে এগুলো৷ কিন্তু সেটা কি এতই বিতর্কিত যে সেগুলো জার্মান সমাজকে বিভক্ত করে ফেলবে?
এই মুহূর্তে নিশ্চিয় সেরকম মনে হচ্ছে৷ এটা সত্য যে আগামী বছর থেকে জার্মানিতে করোনা টিকা বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক চলছে৷
তবে, বিষয়টি আরো জটিল করে তোলার আগে একটু থামা ও শোনা কাজের কাজ হবে৷
শোনা বলতে যেমন বোঝাচ্ছি নতুন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস দায়িত্ব গ্রহণের দিন টিকার বিষয়ে জার্মানিতে আলোচিত বিভক্তি নিয়ে কী বলেছিলেন, সেটা৷ তিনি বিষয়টিকে তেমন বড় কিছু মনে করছেন না, কারণ দেশটির অধিকাংশ নাগরিক ইতোমধ্যে টিকা নিয়ে নিয়েছেন৷
এবং তিনি ঠিকই বলেছেন৷ ১০ ডিসেম্বর অবধি প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রায় সত্তর শতাংশ মানুষ টিকার পূর্ণ ডোজ নিয়ে নিয়েছেন৷ শলৎস এটাও বলেছেন, ‘‘এবং আরো অনেকে মনে করেন যে এটা ঠিকই আছে বা অন্তত নীতিগতভাবে ভুল কিছু নয়৷'' এটাও সত্য কথা৷
সংখ্যালঘু একটি অংশ সরব
তবে তিনি যে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছেন সেটা হচ্ছে: ‘‘শুধুমাত্র একটি সরব সংখ্যালঘু অংশ চরম উগ্রবাদী আচরণ করছে বলে আমাদের এটা মনে করা উচিত হবে না যে সমাজ বিভক্ত হয়ে গেছে৷'' চমৎকার বলেছেন, জনাব চ্যান্সেলর! কেউ যদি তার এই বক্তব্য নিয়ে সন্দিহান হন তাহলে তার উচিত মেরুকরণ এবং জনতুষ্টি বিষয়ক গবেষণাগুলো আরো নিবিড়ভাবে দেখা৷ এরকম অনেক গবেষণা রয়েছে, আর সেগুলো যা খুঁজে পেয়েছে তাও পরিষ্কার: সামাজিক সংহতি অনেক মানুষের ধারনার চেয়েও বৃহত্তর ব্যাপার৷
জার্মানির কনরাড আডেনাউয়ার ফাউন্ডেশনের ইওখেন ব়্যোসে নির্বাচন এবং সমাজ নিয়ে গবেষণা করেন৷ প্রতিষ্ঠানটির এক গবেষণার আলোকে তিনি লিখেছেন, ‘‘২০১৯ সালের শুরুর দিকে দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ধারণা ছিল সমাজে সংহতি খুব অল্প বা একেবারেই নেই৷ মেরুকরণ সম্পর্কে এই উপলব্ধি করোনা মহামারির সময় কমে গেছে৷ ‘আমাদের সমাজে মানুষ অসংলগ্নভাবে একে অপরের বিরোধিতা করে' এমন বক্তব্যের সঙ্গে ঐক্যমত্য পোষণ করাদের সংখ্যা ৪১ শতাংশ থেকে কমে ৩১ শতাংশে নেমে এসেছে৷''
এখানে লক্ষ্যণীয় হচ্ছে জার্মানির মানুষ এভাবে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে৷
ব্যার্টেলসমান পপুলিজম ব্যারোমিটারও একই ধরনের ইঙ্গিত দিচ্ছে: ‘‘বর্তমানে জার্মানির প্রতি দশজন ভোটারের মধ্যে মাত্র প্রায় দু'জন এখনও নিজেদের ধ্যানধারনায় পপুলিস্ট৷ এটা ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের (৩২ দশমিক আট শতাংশ) তুলনায় এক তৃতীয়াংশ কম৷''
এটাও জার্মান সমাজে বিভক্তি বাড়ছে বলে যে বিস্তৃত ধারনা তৈরি হয়েছে তার বিপরীত বার্তা দিচ্ছে৷
বিতর্কের নেতৃত্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
তাহলে এরপরও কেন বিভক্তি, মেরুকরণ এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে? এর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে আমরা তথাকথিত মিডিয়া গণতন্ত্রে বসবাস করছি৷ ডিজিটাল যুগের ইতিবাচক দিক হচ্ছে যেকেউ যে-কোনো বিষয়ে যে-কোনো সময় নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারেন৷ এজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ধন্যবাদ৷ কিন্তু ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম এবং এরকম প্ল্যাটফর্মগুলোর নেতিবাচক দিক হচ্ছে, এগুলো ব্যবহার করে লাগামহীন গুঞ্জন তৈরির সুযোগ আছে৷ আর এখানেই সেই বহু পুরনো কথাটা ফিরে আসে: একজন যত সরব ও বিক্ষুব্ধভাবে সামনে আসে, ততবেশি মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে৷
গণমাধ্যমের করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, জার্মানিতে শুধুমাত্র সংখ্যালঘু একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন৷ ২০২০ সালে ২৬ শতাংশ মানুষ ফেসবুক, বিশ শতাংশ মানুষ ইন্সটাগ্রাম এবং শুধুমাত্র ৫ শতাংশ মানুষ টুইটার সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করেছেন৷ নির্দিষ্ট কিছুক্ষেত্রের মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সক্রিয়: রাজনীতিবিদ, অ্যাক্টিভিস্ট এবং সাংবাদিকরা৷
এদের সবাই তাদের বার্তা জনগণের সামনে তুলে ধরতে চায়, বা তাদের সেটা করতে হয়৷ আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ছাড়া সেটা করাও অসম্ভব৷ কিন্তু যারা এসব প্লাটফর্ম ব্যবহার করেন না তাদের কাছে অনলাইনের বার্তা কীভাবে পৌঁছায়? টুইটার এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনকি কেউ না চাইলেও অনেকে মতামত দেন৷ আর এসব মতামতদাতাদের মতামত সেই প্ল্যাটফর্মেই সীমাবদ্ধ থাকতো যদি সেগুলো অন্যরা শেয়ার বা প্রচার না করতেন৷ এখন যা ঘটছে তাহচ্ছে এসব মতামত কখনো কখনো প্রচলিত মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর সহায়তায় লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে৷ এক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়তা করছে টেলিভিশন টকশোগুলো৷
উত্তপ্ত বিতর্কের অর্থ হচ্ছে গণতন্ত্র কাজ করছে
অডিয়েন্স, রেটিং এবং ক্লিকের নিরলস প্রতিযোগিতায় চাঞ্চল্যকর শিরোনাম এবং তথ্যে অতিরঞ্জন এই খাতের অংশ হয়ে উঠছে৷ ফলে বাধ্যতামূলক টিকার পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা দেখলে দ্রুতই মনে হতে পারে যে বিষয়টি নিয়ে সমাজ বিভক্ত৷
আর এক্ষেত্রে ওলাফ শলৎস যথার্থই বলেছেন: ‘‘অবশ্যই বিষয়টি উগ্রভাবে আলোচনা করা যায়৷ আর এটা কোনো সমস্যা নয়৷ কেননা এটাইতো গণতন্ত্র৷''
শেষ করার আগে চলুন বার্লিনের জার্মান ইন্সটিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল এন্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের পাওয়া ক্যুয়লারের পুরস্কারজয়ী নিবন্ধ ‘এঙ্গার এন্ড ওয়ার্ল্ডভিউ' পড়া যাক৷ লেখক মনে করেন, সামগ্রিকভাবে জার্মান সমাজে মেরুকরণ তেমন একটা হচ্ছে না, তবে ব্যক্তিগত মতামত বাড়ছে৷
‘‘জনসংখ্যার একটি ছোট অংশকে (রাজনৈতিক অভিজাত এবং মতামত তৈরিকারকরা) আরেকটি ছোট অংশ (রাগান্বিত অনলাইন ট্রল) ঘৃণাবাচক বক্তব্য এবং অপবাদ দিয়ে আক্রমণ করছে যা বিস্তৃত বিতর্কের সংস্কৃতির উপর প্রভাব তৈরি করছে৷''
দুর্ভাগজনক হলেও তিনি ঠিক বলেছেন৷