সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনাকারী সন্দেহে এক জার্মান লেফটেন্যান্টের গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়টি জার্মান রাজনীতিবিদ ও সেনা কর্মকর্তাদের অস্বস্তিতে ফেলেছে৷ প্রশ্ন উঠেছে – জার্মান সেনাবাহিনী কি শুরু থেকেই ডানপন্থিদের স্বর্গরাজ্য?
বিজ্ঞাপন
টুরিঙ্গিয়া রাজ্যের গোথায় জার্মান সেনাদের সঙ্গে মাত্র কয়েকদিন কাটিয়েছিলেন আন্দ্রে ই৷ সেখানে তিনি তার সুপারভাইজারকে সরাসরি বলেছিলেন, ‘‘আমি নিজেকে জাতীয় সমাজবাদী হিসেবে পরিচয় দিতে চাই৷’’ তবে তাকে দেখে যে কেউ সেটা বুঝতে পারতো, কেননা, তার শরীরে একটা ট্যাটু ছিল, যেটার বক্তব্য মূলত হিটলারের ‘ব্লাড অ্যান্ড অনার’৷ সে প্রকাশ্যে বলে বেড়াতো এসএস-এর প্রতি সে অনুরক্ত৷ সেখানে আরও ১০ মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছিল আন্দ্রে, শিখেছিল কীভাবে রাইফেল চালাতে হয় এবং হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়তে হয়৷ এটা আজ থেকে ১৭ বছর আগের ঘটনা৷ আন্দ্রে কেবল একজন নব্য নাৎসিই নয়, সে ডানপন্থি জঙ্গি দল ‘ন্যাশনাল স্যোশালিস্ট আন্ডারগ্রাউন্ড’ বা এনএসইউ-এর সদস্য, যাদের বিরুদ্ধে মিউনিখে এখনও বিচার চলছে৷ তাদের বিরুদ্ধে বোমা হামলা এবং ১০ জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে৷ প্রশ্ন হলো, জার্মান সেনাবাহিনী কেন তাদের বিরুদ্ধে শুরুতেই ব্যবস্থা নেয়নি?
যেসব দেশে শান্তি ফেরাচ্ছে জার্মানি
তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি ন্যাটোর সঙ্গে যোগ দেয়ার পর থেকে বার্লিন ট্রান্স-অ্যাটলান্টিক জোটটিকে নানাভাবে সহায়তা করেছে৷ সেই ১৯৯০ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে শান্তি ফেরাতে কাজ করেছে জার্মান সেনাবাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Hanschke
ন্যাটোতে জার্মানির ভূমিকা
তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে ১৯৫৫ সালে৷ তবে ১৯৯০ সাল অবধি নিজেদের কর্মকাণ্ড অত্যন্ত সীমিত রেখেছিল জার্মানি৷ শান্তিরক্ষা থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে ন্যাটোর হয়ে বিশ্বের কয়েকটি দেশে কাজ করেছে জার্মান সেনাবাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Hanschke
বসনিয়া: জার্মানির প্রথম ন্যাটো মিশন
১৯৯৫ সালে বসনিয়া-হ্যারৎসেগোভিনায় প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে জার্মান সেনা মোতায়েন করা হয়৷ অর্থাৎ বসনিয়া যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেদেশে শান্তি ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন জার্মানরাও৷ সেই শান্তিরক্ষা মিশনে ন্যাটোর সদস্য ও সহযোগী দেশগুলোর ৬০ হাজারেরও বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/H. Delic
কসভোতে শান্তিরক্ষা
কসভোতে ন্যাটো নেতৃত্বাধীন শান্তিরক্ষা মিশনের শুরুতেই সেদেশে সাড়ে আট হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়৷ ১৯৯৯ সালে সংখ্যালঘু আলবেনীয় বিচ্ছিন্নতবাদী এবং তাদের সমর্থকদের ওপর বর্বর দমনপীড়নের দায়ে সার্বিয়ার ওপর বিমান হামলা চালায় ন্যাটো৷ এখনো প্রায় ৫৫০ জন জার্মান সেনা কসভোতে অবস্থান করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V.Xhemaj
এজিয়ান সাগরে টহল
২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সমর্থিত ন্যাটো মিশনের অংশ হিসেবে এজিয়ান সাগরে মোতায়েন করা হয় জার্মান যুদ্ধজাহাজ ‘বন’৷ অভিবাসী সংকট যখন চরমে, তখন অন্যান্য কাজের মধ্যে এই মিশনের অন্যতম কাজ ছিল গ্রিস এবং তুরস্কের জলসীমায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ওপর নজর রাখা৷ জার্মানি, গ্রিস এবং তুরস্ক এ কাজে ন্যাটোর সহায়তা চেয়েছিল৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/M.Schreiber
লিথুয়ানিয়ায় জার্মান ট্যাংক
বাল্টিক দেশগুলোতে ন্যাটোর মিশনের অংশ হিসেবে লিথুয়ানিয়ায় চলতি বছর ৪৫০ জন জার্মান সেনা মোতায়েন করা হয়েছে৷ অবস্থান করছে জার্মান ট্যাংকও৷ তবে জার্মানি ছাড়া ক্যানাডা, ইংল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেনাও রয়েছে সে অঞ্চলে৷ ‘বর্ধিত সামরিক মহড়া’-র অংশ হিসেবে প্রায় এক দশক যাবৎ ন্যাটো বাহিনী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ লিথুয়ানিয়ায় অবস্থান করছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/M. Kul
এক দশকের বেশি সময় ধরে আফগানিস্তানে
আফগানিস্তানে ন্যাটো নেতৃত্বাধীন আইসাফ বাহিনীতে জার্মানি যোগ দেয় ২০০৩ সালে৷ সংখ্যার বিচারে দেশটিতে মোতায়েন বিদেশি সেনাদের মধ্যে জার্মানির অবস্থান তৃতীয়৷ আফগান মিশনে এখন পর্যন্ত ৫০ জন জার্মান সেনা নিহত হয়েছে৷ ২০১৫ সালে জার্মান সেনাদের মিশন শেষ হওয়া ও দায়িত্ব হস্তান্তরের পরও সহস্রাধিক জার্মান সেনা অবস্থান করছেন আফগানিস্তানে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/A.Niedringhaus
6 ছবি1 | 6
২০১২ সালে রক্ষণশীল দলের মিশায়েল এলকে আফগানিস্তানের কুন্দুজে কাজ করতে পাঠানো হয়েছিল৷ এর আগে ২০০৮ সালে কাসেল শহরে কট্টর ডানপন্থি দল এনপিডি'র সদস্য হিসেবে তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছিল৷ তিনি জাতীয়তাবাদী দল ‘ফ্রি রেজিসট্যান্স কাসেল’-এর সদস্য ছিলেন৷ ঐ রাজ্যটি বরাবরই নিও নাৎসিদের এলাকা হিসেবে পরিচিত৷ এরপরও তাকে আফগানিস্তানে কাজে পাঠানো হয়েছিল৷ জার্মান সেনাবাহিনী কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি?
ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার দীর্ঘদিনের ইতিহাস
১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জার্মান সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি সংকটে রয়েছে৷ সেই সময় সেনাবাহিনী আসলে ছিল ডানপন্থি জঙ্গিদের স্বর্গ, কেননা, ৫০-এর দশকের শেষ ভাগে সেনাবাহিনী হিটলারের এলিট ফাইটিং ফোর্স ভাফেন-এসএস-এর ৩০০ কর্মকর্তাকে ভাড়া করে৷ এছাড়া হিটলার বাহিনীর ১২ হাজার সদস্য, এমনকি ৪০ জন নাৎসি জেনারেলও সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিল৷ ১৯৫৬ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ফ্রানৎস-ইয়োসেফ স্ট্রাওস৷ তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন সেনা ব্যারাকগুলোর নাম রাখা হয়েছিল নাৎসি জেনারেলদের নামে৷ সেই জেনারেলরা হিটলারের হত্যা পরিকল্পনায় বাধা দিয়েছিলেন এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন৷
বর্তমান অবস্থা
বর্তমানেও জার্মান সেনাবাহিনীতে যে কোনো পরিবর্তন আসেনি তা লেফটেন্যান্ট ফ্রাংকো এ'র সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা আবারও প্রমাণ করেছে৷ ঘটনাগুলো তখনই প্রকট হয় যখন কোথাও স্বস্তিকা চিহ্নের গ্রাফিটি চোখে পড়ে৷ বলা হচ্ছে, এই নিও নাৎসিদের মনোভাব সেনাবাহিনীর ১৮ থেকে ২৫ বয়সি তরুণদের মধ্যে বেশি প্রকট৷ কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এদের চিহ্নিত করা হলেও সেনাবাহিনী থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে না৷ নিয়ম অনুযায়ী, আদালতে আগে তাদের বিরুদ্ধে যথার্থ প্রমাণ হাজির করতে হবে যে তারা কট্টর ডানপন্থি দলের সদস্য, তারপরই তাদের অপসারন সম্ভব৷
প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অবস্থান
ফ্রাংকোর মতো উচ্চপদস্থ অফিসারের উগ্র দক্ষিণপন্থি ভাবধারা সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও বাহিনীর সতীর্থ ও কর্মকর্তারা হাত গুটিয়ে বসে থেকে যে ‘ভুল’ সংহতির পরিচয় দিয়েছেন, তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী৷ এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র সফর স্থগিত করেছেন ফন ডেয়ার লাইয়েন৷ আজ বার্লিনে তদন্ত নিয়ে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে তাঁর৷
ম্যার্কেলের সমর্থন
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফন ডেয়ার লাইয়েনকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন৷ ম্যার্কেলের মুখপাত্র বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘‘জার্মান সেনাবাহিনীতে এমন একজন ডানপন্থি সদস্য থাকতে পারে এটা সেনাবাহিনীর জানা উচিত ছিল এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী যে প্রশ্নটি তুলেছেন তা যৌক্তিক এবং চ্যান্সেলর তাঁকে সম্পূর্ণ সমর্থন করছেন৷’’
ফলকের ভাগেনের/এপিবি
জার্মান সেনাবাহিনীতে যত ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি
জার্মান সেনাবাহিনীতে প্রায় প্রতিদিনই হয় যুদ্ধবিমান, না হয় হেলিকপ্টার বা অন্য কিছুর সমস্যা দেখা দেয়৷ সেসব কথাই জানা যাবে ছবিঘরে৷
ছবি: AFP/Getty Images
ইউরোফাইটার
জার্মানি সবচেয়ে আধুনিক ফাইটার জেট এটি৷ নাম ইউরোফাইটার৷ তবে নির্মাণকালীন সময়ে ত্রুটির কারণে এই জেটের উড্ডয়ন-ঘণ্টা তিন হাজার থেকে কমে অর্ধেক, অর্থাৎ দেড় হাজার হয়ে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
টর্নেডো ফাইটার ও পরিবহণ বিমান
জার্মান সেনাবাহিনী প্রায় ৪০ বছর ধরে টর্নেডো ফাইটার ব্যবহার করে আসছে৷ বর্তমানে এরকম ৮৯টি ফাইটারের মধ্যে মাত্র ৩৮টি চালু আছে৷ ট্রানজাল সি-১৬০ পরিবহণ বিমানের একই পরিণতি হয়েছে৷ ৫৭টি বিমানের মধ্যে এখন মাত্র ২৫টি ব্যবহারের যোগ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Udo Zander
ত্রুটিপূর্ণ হেলিকপ্টার
৩১টি আধুনিক টাইগার হেলিকপ্টারের মধ্যে মাত্র ১০টি এখন আকাশে উড়তে পারে৷ আর ২২টি ‘সি লিংক্স অ্যান্টি-সাবমেরিন হেলিকপ্টার’ এর মধ্যে এখন মাত্র চারটি ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় আছে৷ এনএইচ৩০ এবং সিএইচ৫৩ পরিবহণ কপ্টারেরও একই অবস্থা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Carsten Rehder
ট্যাংক
জার্মান সেনাবাহিনীতে একসময় ১৮৯টি ‘বক্সার’ ট্যাংক ছিল৷ এখন সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ৭০-এ৷ আর ১৯৭১ সাল থেকে ব্যবহৃত হওয়া ‘মার্ডার’ এপিসি-র (আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার) সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে৷
ছবি: Johannes Eisele/AFP/Getty Images
সাগরে সমস্যা
২০০১ সালের ডিসেম্বরে পাঁচটি ‘কে১৩০’ করভেটে কেনার সিদ্ধান্ত নেয় জার্মান সেনাবাহিনী৷ ২০০৭ সাল থেকে সেগুলো ব্যবহারের কথা ছিল৷ কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ গিয়ার, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও সফটওয়্যারের কারণে নির্ধারিত সময়ে সেগুলোর ব্যবহার শুরু করা যায়নি৷ তারপর যখন শুরু হলো, তখন পাঁচটির মধ্যে মাত্র দুটি তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারযোগ্য ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রতিরক্ষামন্ত্রীর জন্য চ্যালেঞ্জ
২০১৩ সালের শেষের দিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন উর্সুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন৷ দায়িত্ব নেয়ার পর তাঁর জন্য প্রথন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয় এসব ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি৷ এজন্য অবশ্য সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা দায়ী৷ কারণ তাঁরাই খুচরা যন্ত্রাংশের জন্য অর্থ বরাদ্দ কমিয়েছিলেন৷