জাহাজভাঙা: গ্রিন ইয়ার্ডের যাত্রায় সংকট বর্জ্য পরিশোধনাগার
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
দেশের একমাত্র জাহাজভাঙা কারখানার অঞ্চল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এখন পর্যন্ত ১৭টি ইয়ার্ড পরিবেশবান্ধব গ্রিন কারখানার স্বীকৃতি পেয়েছে।
এতে করে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমেছে। কিছু দুর্ঘটনা ঘটলেও শ্রমিক সুরক্ষা বেড়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। তবে এখনো ট্রিটমেন্ট স্টোরেজ অ্যান্ড ডিসপোজাল ফ্যাসিলিটি (টিএসডিএফ) বা কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়নি। এর অভাবে বিভিন্ন ইয়ার্ডে জমানো উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর বর্জ্য পরিশোধন করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৭ সালের আগে এই টিএসডিএফ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এছাড়া কিছু কিছু ইয়ার্ডের বিরুদ্ধে শ্রম শোষণের অভিযোগ করছেন শ্রমিক নেতারা। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন না করার পাশাপাশি দিনে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানোর অভিযোগ তুলছেন তারা। আবার কারখানা কমে যাওয়ায় হঠাৎ করে অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে রডের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় জাহাজ আমদানিও তুলনামূলকভাবে কমেছে।
২০০৯ সালে গৃহীত জাহাজ পুনর্ব্যবহার (ship recycling) সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি হংকং কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। এই চুক্তি বাস্তবায়নের শেষ সময় ছিল এ বছরের ৩০ জুন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, যারা গ্রিন ইয়ার্ড বা পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে সনদ পেয়েছে, এখন ওই প্রতিষ্ঠানগুলোই জাহাজ আমদানি করতে পারবে। ১৭টির পর আরো প্রায় পাঁচটি ইয়ার্ড গ্রিন সনদ প্রাপ্তির জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে চলেছে।
এর আগে গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা কারখানার ব্যাপক উত্থান শুরু হয়। উপজেলাটির ২০ কিলোমিটার সাগর উপকূলে একে একে গড়ে উঠতে থাকে জাহাজভাঙার ইয়ার্ড। তখন ন্যূনতম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই ইয়ার্ড হয়। ফলে পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। সাগরে এবং যত্রতত্র তরল বর্জ্য ফেলা, উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী ধ্বংস করা, তেজস্ক্রিয় জাহাজ আমদানি, বিস্ফোরণ, বর্জ্য শোধন না করাসহ নানামুখী কর্মকাণ্ডে বারবার খবরের শিরোনাম হয় এই খাত।
এ কারণে পরিবেশবাদী সংগঠন, বিশেষ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) হংকং কনভেনশন বাস্তবায়নের জন্য নানামুখী তৎপরতা শুরু করে। নানা চাপে পড়ে সরকার উদ্যোগ নেয়। পাঁচ-ছয় বছর আগে ইয়ার্ড ছিল প্রায় ১৫০টি। এর মধ্যে ১০৫টি কারখানাকে পরিবেশবান্ধব (গ্রিন) করার লক্ষ্যে উন্নয়নকাজ করার অনুমোদন দিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। গ্রিন করার জন্য বড় অংকের বিনিয়োগের দরকার। এই খরচ এবং ব্যবসা মন্দার কারণে বেশির ভাগ ইয়ার্ড গ্রিন করার পথে আপাতত হাঁটছে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বোর্ডের মহাপরিচালক এ এস এম শফিউল আলম তালুকদার ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে এখন পর্যন্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে সনদ পেয়েছে। এখন সনাতন পদ্ধতির জাহাজ কাটা চলবে না। জুন মাস থেকে এটা কার্যকর হয়েছে। এখন শুধু গ্রিন ইয়ার্ডগুলোই নিয়ম-নীতি মেনে জাহাজ আমদানি করতে পারবে। তবে রডের চাহিদা কমসহ নানা কারণে এখন জাহাজ আমদানি কিছুটা কমেছে।''
সরেজমিনে গ্রিন ইয়ার্ড
২০১৭ সালে দেশের প্রথম গ্রিন ইয়ার্ড হিসেবে যাত্রা শুরু করে পিএইচপি শিপব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইয়ার্ডের কার্যক্রম পরিদর্শন এবং পর্যবেক্ষণ করে এই সনদ দিয়ে থাকে। গ্রিন ইয়ার্ডের বেশির ভাগ কাজ-কর্ম স্বয়ংক্রিয়। এজন্য বড় বড় লোহার পাত ওঠানো-নামানোর জন্য চুম্বক আকর্ষক ক্রেন, লোডারসহ নানা যন্ত্রপাতি থাকে।
পিএইচপির পর চতুর্থ কারখানা হিসেবে ২০২৩ সালে গ্রিন সনদ পায় কে আর শিপরিসাইকেলিং ইয়ার্ড। সীতাকুণ্ডের কুমিরা এলাকায় এই ইয়ার্ডের অবস্থান। শনিবার (৩০ আগস্ট) বিকেলে ওই ইয়ার্ডে পা রাখতেই সাগরের দিকে চোখ পড়ে, দেখা যায় পানিতে একটা জাহাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে, আরেকটা জাহাজের প্রায় পুরোটা কাটা শেষ।
পুরো ইয়ার্ডের মেঝে পাকা। মেঝেতে তেল পড়লে তা নিঃসরণের জন্য রয়েছে নালা। নালা হয়ে এগুলো চলে যায় তেল শোধনাগারে। অপর পাশে রয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার রাখার জন্য চারদিকে গ্রিল দেওয়া একটা ঘর। ওখানে বেশ কিছু সিলিন্ডার রয়েছে। পাশে অগ্নিনির্বাপনের নানা সরঞ্জাম রাখা। আরেকটু দূরে একজন কাটারম্যান গ্যাস কাটার দিয়ে জাহাজের পাত কাটছেন। তার পুরো শরীর সুরক্ষা পোশাকে ঢাকা। তার পেছনে দুজন ফায়ার এক্সটিংগুইশার, অর্থাৎ অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র নিয়ে দাঁড়ানো। দুর্ঘটনা হলে যাতে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানো যায় সে কথা ভেবেই এই ব্যবস্থা।
এছাড়া একটা অ্যাম্বুলেন্সসহ একটি প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে। সেখানে একজন প্যারামেডিক চিকিৎসক ছিলেন। ক্ষতিকারক বর্জ্য সংরক্ষণাগার, অ্যাজবেস্টস ও অন্যান্য ক্ষতিকর বস্তুর জন্য পৃথক পৃথক সংরক্ষণাগার রয়েছে। সেখানে বর্জ্য জমা করা হচ্ছে। এছাড়া শ্রমিকদের বিশ্রাম এবং বিনোদন কক্ষ রয়েছে মূল ভবনের তৃতীয় তলায়।
কারখানাটির সত্ত্বাধিকারী মো. তছলিম উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "গ্যাস ও তেলমুক্ত করার আগে কোনো জাহাজ কাটায় হাত দেওয়া হয় না। গ্রিন ইয়ার্ডে এখন আর আগের মতো কাঁধে করে লোহার পাত ওঠানো-নামানো হয় না। সবকিছু হয় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। এছাড়া তেলজাতীয় বর্জ্যসহ যাবতীয় বর্জ্য রাখার পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে। যাবতীয় বর্জ্য পরিশোধন করা হয়। উচ্চ তাপমাত্রায় পরিশোধনযোগ্য বর্জ্য কিছু বাইরের প্রতিষ্ঠান নিয়ে যায়। প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনো শ্রমিক নেই। দুর্ঘটনাও কমেছে অনেক।”
সম্পূর্ণ গ্যাস ও তেলমুক্ত করে জাহাজ কাটার অনুমতি নিতে হয় বলেও তিনি জানান। তাছাড়া বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয় বলেও জানান মো. তছলিম উদ্দিন।
এই কারখানায় স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে ১২০ জন শ্রমিক রয়েছে। গ্রিন করার কারণে ওঠানো-নামানোয় নিয়োজিত কিছু শ্রমিক কমেছে। সেখানকার শ্রমিক আবদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ এখানে সুরক্ষা পোশাক ছাড়া এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। কয়েকবার প্রশিক্ষণ পেয়েছি।''
এই ইয়ার্ডের পাশে রয়েছে বিবিসি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড। সনাতন পদ্ধতির এই ইয়ার্ডটি এখন জাহাজ ও জনশূন্য বলা যায়। সোনাইছড়ি এলাকার বিভিন্ন ইয়ার্ডও এখন খালি পড়ে রয়েছে।
বর্জ্য শোধনাগার কবে হবে
জাহাজভাঙা শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, পরিবেশগত দিক থেকে এ শিল্পের কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে অ্যাজবেস্টসের মতো ক্ষতিকর বর্জ্য উচ্চ তাপমাত্রায় ধ্বংসের জন্য প্রস্তাবিত টিএসডিএফ বা কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পটির তেমন অগ্রগতি নেই। জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বোর্ডের উদ্যোগে বিদেশি অর্থায়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা।
প্রথমে এটি হওয়ার কথা ছিল সীতাকুণ্ড উপজেলায়। কিন্তু পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে স্থান পরিবর্তন করে তা মিরসরাইয়ের অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে প্রকল্পটির জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বোর্ডের মহাপরিচালক এ এস এম শফিউল আলম তালুকদার বলেন,"জাহাজভাঙার বর্জ্য পরিশোধনের জন্য মিরসরাইয়ে একটা জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করবে আইএমও। এ জন্য দরপত্র যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে। এটাতে জাপানের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর জাইকা অর্থায়ন করতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, ‘‘সমীক্ষা শেষে ডিপিপি করা হবে। অর্থায়ন পেলে কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৭ নাগাদ। অনেককিছুর ওপর এই প্রকল্প নির্ভর করছে।''
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের পরির্দশক মো. আশরাফ উদ্দিন জানান, ‘‘টিএসডিএফ প্রকল্পে ইনসিনারেটরের মাধ্যমে ১২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সকল ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য পোড়ানো হবে। পোড়ানোর ফলে উৎপন্ন ধোঁয়া পরিশোধন করে নির্গমন করা হবে। এছাড়া এখানে পোড়ানোর ফলে উৎপন্ন ছাই ডাম্পিং করা হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে দূষণ একেবারে থাকবে না।''
টিএসডিএফ না হওয়া পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদিত কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বর্জ্য শোধন করা হয় বলে ইয়ার্ড সূত্র জানায়। তবে অ্যাজবেস্টসের মতো বর্জ্য বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে জাহাজভাঙা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ)-র সহ-সভাপতি ও পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, "আগে মালিকেরা বলতেন, ‘আমার ইর্য়াড ঠিক আছে।' এখন তাদের মধ্যে মানসিকতার বদল ঘটেছে। গ্রিন হওয়ার পর পরিবেশের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স এবং অন্যান্য বর্জ্য শোধন করা হচ্ছে এখন। অ্যাজবেস্টস বিশেষ কায়দায় সংরক্ষণ করা হচ্ছে।টিএসডিএফ প্রকল্প হলে আরো সুরক্ষিত হবে।”
তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-র চট্টগ্রামের ফিল্ড ফ্যাসিলেটর মনিরা পারভীন রুবা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "গ্রিন ইয়ার্ড বলে একটা বাহ্যিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে কেবল। অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ ও শ্রমিকদের সেই অর্থে কী পরিবর্তন হয়েছে। যদি কোনো প্রতিনিধি দল যায়, তখন তারা শ্রমিকদের সুরক্ষা পোশাকসহ যাবতীয়গুলো ব্যবহার করে। আর পরিবেশের দিক থেকে এখনো সে অর্থে উন্নতি হয়নি।”
অভিযোগ শ্রম শোষণের
হংকং কনভেনশনে শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ও অগ্রগণ্য। বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ইয়ার্ডের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এর আগে, ২০১১ সালে শিপব্রেকিং বিধিমালা হয়। ২০১৮ সালে সরকারি মজুরি বোর্ড জাহাজভাঙা কারখানার নিম্নতম মজুরি ১৬ হাজার টাকা ধার্য করে। এই মজুরি সব ইয়ার্ডে এখনো পুরোপুরি দেয়া শুরু হয়নি বলে অভিযোগ শ্রমিক নেতাদের।
জাহাজভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক ও ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক তপন দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, "হংকং কনভেনশন অনুযায়ী শ্রমিকদের জীবনমানও গ্রিন করতে হবে। কিন্তু ন্যূনতম ১৬ হাজার টাকা মজুরিও দেওয়া হয় না। এখন ৮ ঘণ্টার জায়গায় ১২ ঘণ্টা কাজ করিয়ে ১৬ হাজার টাকা মজুরি দিচ্ছে। এটা শুভঙ্করের ফাঁকি। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারও হরণ করা হয়। জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বোর্ডে মালিক প্রতিনিধি আছে। কিন্তু কোনো শ্রমিক প্রতিনিধি নেই।”
তিনি আরো বলেন, "গত বছর ৭ সেপ্টেম্বর একটি গ্রিন ইয়ার্ডে বিস্ফোরণে ৬ জন মারা যায়। এ বছরও অন্য একটিতে দুর্ঘটনায় কয়েকজন দগ্ধ হয়। তাই শ্রমিকদের জীবন নিরাপদ হয়নি এখনো।”
তবে হতাহত শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ মালিকপক্ষ দেয় বলে এই শ্রমিক নেতা জানান।
অভিযোগ প্রসঙ্গে বিএসবিআরএ-এর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, "যে মালিক একশ-দেড়শ কোটি টাকা দিয়ে ইয়ার্ড গ্রিন করবেন, তিনি ১৬ হাজার টাকা মজুরি দিতে পারবেন না এটা বিশ্বাসযোগ্য কি? সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রম সুরক্ষার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এখন প্রশিক্ষিত শ্রমিকেরা কাজ করে থাকেন। তাদের সুরক্ষার দিকটি সবার কাছে প্রাধান্য পায়।”
দুর্ঘটনার হার
জাহাজভাঙায় সক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে ছিল এতদিন। গত বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালে বিশ্বে ৪০৯ টি জাহাজ কাটা হয়। তার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে কাটা হয় ২৫৫টি। এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম তাদের ২০২৪ সালের বিশ্বব্যাপী ভাঙা জাহাজের বার্ষিক তালিকা থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
এর মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ১২৯টি জাহাজ ভেঙেছে। এরপর ভারত ভেঙেছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯৭টি। কিন্তু গ্রিন হওয়ার পর দেশের এই সক্ষমতা কমে যেতে পারে। উল্লেখ্য, ভারত গ্রিন ইয়ার্ডে ঝুঁকেছে এক দশক আগে। ওখানে ইয়ার্ডের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশে এখনো কম।
এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম তাদের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এশিয়ার ৮০ শতাংশ ইয়ার্ডে জাহাজ নিম্নমানের পরিবেশে ভাঙা হয়েছে বলে জানিয়েছে। ওই বছর দক্ষিণ এশিয়ায় জাহাজ ভাঙার সময় নয়জন শ্রমিক প্রাণ হারান, আহত হন ৪৫ জন। এর মধ্যে বাংলাদেশে মারা যায় ছয়জন।
এছাড়া বাংলাদেশে চলতি বছর দু'জন, ২০২৩ সালে পাঁচজন, ২০২২ সালে ১০ ও ২০২১ সালে ১৪ জন মারা যায়। ২০১৮ সালে ২০ শ্রমিক মারা গিয়েছিল বলে প্ল্যাটফর্মটি জানায়।
একসময় ৫০ হাজার শ্রমিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পে জড়িত ছিল। ইয়ার্ড কমে যাওয়ায় এখন তা পাঁচ হাজারের কিছু বেশিতে নেমে এসেছে।
আমদানি কমেছে
২০বছর আগে দেশে রড তৈরির কাঁচামালের বড় জোগান দিতো জাহাজভাঙা কারখানা। এখন আমদানি করা লোহার টুকরার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু পুরোনো জাহাজের আমদানি কমে যাওয়ায় এই উৎস থেকে ভালো মানের কাঁচামালের জোগানও কমে যাচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪–০৫ অর্থবছরে মোট ১০ লাখ ৪৪ হাজার টন পুরোনো জাহাজ আমদানি করা হয়। তা থেকে ৫ লাখ টনের বেশি লোহা পাওয়া যায়। এটা ছিল রড তৈরির মোট কাঁচামালের ৮০ শতাংশ।
২০০৪–০৫ অর্থবছর থেকে পুরনো জাহাজ আমদানি কখনো ১০ লাখ টনের নিচে নামেনি। ২০২২–২৩ অর্থবছর থেকে তা ১০ লাখ টনের নিচে চলে আসে। ওই বছর ৯ লাখ ৭১ হাজার টন ওজনের পুরনো জাহাজ আমদানি হয়। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে আমদানি হয় হয় ১০৫টি পুরোনো জাহাজ, যেগুলোর মোট ওজন ৮ লাখ ৪৫ হাজার টন। এটা গত ২১ বছরে সর্বনিম্ন। এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাহাজ আসে ১৬৬টি, ওজন ছিল ৯ লাখ ৯৭ হাজার টন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আবাসন শিল্পসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কমে গেছে। এর ফলে রডের চাহিদা কমেছে। আগের যে জাহাজ ছিল, সেগুলোই এখন অনেকে বিক্রি করতে পারেনি। এছাড়া সারা বিশ্বে একটা মন্দাভাব চলছে এবং তার প্রভাবও পড়ছে বলে তারা মনে করেন।