‘কয়লা পরিবহনই বড় হুমকি’
২৯ আগস্ট ২০১৬ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘‘তারা যে বলছে কোনো ক্ষতি হবে না, এটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কিছু না৷ এটা বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে৷ এখন যত জায়গায় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়, সেটার প্রভাবটা কী পড়ে আর পাশে যে নদী থাকে, সেটা কীভাবে বিপর্যস্থ হয় তা তো আমরা দেখেছি৷''
ডয়চে ভেলে: রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শুরু থেকেই আপনারা বিরোধীতা করছেন৷ এর কারণ কী?
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ: এর প্রধান কারণ হচ্ছে সুন্দরবনের অস্তিত্বের প্রশ্ন৷ সুন্দরবন হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য অতুলনীয়৷ এর কোনো বিকল্প নেই৷ তাই এর কোনো ক্ষতি হলে সেটা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়৷ এটা একটা প্রাকৃতিক সম্পদ৷ এটা পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এবং এখানকার প্রাণবৈচিত্রের কারণে মানুষকে রক্ষা করার ক্ষমতা আছে সুন্দরবনের৷ এটা যেন একটা প্রাকৃতিক সুরক্ষা বাঁধ৷ পাশাপাশি এর মধ্যে অসংখ্য প্রাণের সমাবেশের কারণে এটা ইকোলজিকালি খুবই রিসোর্সফুল বা সম্পদশালী একটা জায়গা৷ এর ওপর মানুষ নির্ভর করে তার জীবন-জীবিকার জন্য৷ আর কয়েক কোটি মানুষ নির্ভর করে তাদের জীবনের অস্তিত্বের জন্য৷
এই বিদ্যুাৎ কেন্দ্রটা সুন্দরবনের প্রান্তসীমা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এবং ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট থেকে ৬৯ কিলোমিটার দূরে৷ যেসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এখানে ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে, তাতে আসলেই কতটা ক্ষতি হবে?
প্রথমেই বলি, বঙ্গোপসাগরে যে কয়লা আসবে, সেটা অনেক বড় জাহাজে আসবে৷ তারপর সেখান থেকে ছোট জাহাজে ভরা হবে৷ সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন নদীতে এখন যে জাহাজে চলাচল করে, তার থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ গুণ বড় এ সব জাহাজ৷ এগুলো বঙ্গোপসাগর দিয়ে ঢুকবে৷ আর বঙ্গোপসাগরের শুরুতেই তো সুন্দরবন৷ সেখানে লোনা পানি আর মিষ্টি পানির সমাবেশের কারণে ইউনিক একটা ইকোলোজিকাল সিস্টেম তৈরি হয়েছে৷ এরপর ১০ কিলোমিটার বাফার জোন রয়েছে, যার ৪ কিলোমিটার পরই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র৷ কিন্তু এই ১৪ কিলোমিটারের পথটা তো পরে আসে৷ সুন্দরবনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার টন কয়লা পরিবহন করা হবে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে৷ এি কয়লা পরিবহনের জন্য যে ক্ষতিটা হবে, সেটাই সুন্দরবনের জন্য বড় হুমকি৷
প্রতিদিন একটা করে জাহাজ আসবে, যার ধারণ ক্ষমতা ১০-১২ হাজার টন৷ এটা পুরোটাই ঢাকা থাকবে, যাতে কয়লা উড়ে গিয়ে পরিবেশ দূষণ করতে না পারে৷ তাছাড়া বড় জাহাজ থাকবে গভীর সমুদ্রে৷ তা কয়লা যদি ঢাকা থাকে আর পরিবেশ দূষণ না করে, তাহলে এর বিরোধিতা কেন?
এটা আসলে সাজানো কথা, যার কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত বা বাস্তব ভিত্তি নেই৷ কয়লা হলো এমন একটা পদার্থ, যেটা নিজে থেকেই জ্বলতে পারে৷ তাই সেখানে ক্রমাগত পানি ঢালতে হবে৷ আর ব্যবস্থাপনাগত যে জায়গাটা, সেখান থেকে গুড়াগুলো পানিতে গিয়ে দূষণ করবে না, এমন কোনো উদাহরণ আমাদের সামনে নেই৷ দ্বিতীয়ত প্রতিদিন যে জাহাজটা যাবে তাতে ১০-১২ হাজার টন কয়লা থাকবে, যেটা এখন যে জাহাজ চলে তার ১৫ থেকে ২০ গুণ বড়৷ সে কথা তো আগেই বললাম৷ তাই সেই জাহাজ থেকে তেলসহ অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে কয়লার দূষণটাও ঘটবে৷ তাছাড়া এত বছর ধরে প্রতিদিন জাহাজটা যাবে৷ তা এই নিশ্চয়তা কে দেবে যে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হবে না? একটা ৫০০ টনের কয়লার জাহাজে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে সরকারের কী ভূমিকা ছিল তা আমরা দেখলাম৷ এমনকি প্রধানমন্ত্রীর মুখেও আমরা শুনলাম যে, কয়লার জাহাজ ডুবলে কোনো দূষণ হয় না৷ এ রকম যাদের ভূমিকা, সেখানে প্রতিদিন কয়লার জাহাজ যাবে আর কোনো ঘটনা ঘটবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য কোনো দাবি না৷
সরকার যে বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের চিমনি হবে ৯০০ ফুট উচ্চতায় এবং এই চিমনি থেকে বের হওয়া বায়ু প্রকৃতি ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবে না৷ তারপর ধরুন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে মাটির নীচের পানি ব্যবহার করা হবে না, পানি নেয়া হবে পশুর নদী থেকে৷ আর যে পানিটা পশুর নদীতে ফেলা হবে, সেটা স্বাভাবিক তাপমাত্রার মতো করেই ফেলা হবে?
তারা যে বলছে কোনো ক্ষতি হবে না, এটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কিছু না৷ এটা বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে৷ এখন যত জায়গায় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়, তার প্রভাবটা কীভাবে পড়ে এবং পাশে যে সব নদী থাকে সেগুলি কীভাবে বিপর্যস্ত হয়, সেটা তো আমরা দেখেছি৷ তাই আমি মনে করি, বায়ুদূষণ রোধে প্রযুক্তি আবিষ্কারের দাবি করে তারা যেটা বলছে, সেটা ঠিক নয়৷ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ আমাদের সামনে আছে৷ যারা এই কাজটা করবে সেই এনটিপিসি এখানে যে বিশুদ্ধ টেকনোলজির দাবি করছে, তার কোনো উদাহরণ তো ভারতে নেই৷ গতমাসে তাদেরই একটা প্রকল্প মধ্যপ্রদেশে স্থগিত করেছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়৷ এই যুক্তিতে যে, ৩০ কিলোমিটার দূরে খাজুরাহোর প্রাচীন মন্দির আছে৷ তাহলে সেখানে এনটিপিসির যুক্তি কাজ করে না কেন? যেসব বিশেষজ্ঞ বলছেন যে, পানির কোনো ক্ষতি হবে না, বায়ুর কোনো ক্ষতি হবে না, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ আসবে তাতেও কোনো ক্ষতি হবে না – সেই বিশেষজ্ঞরা খাজুরাহো ৩০ কিলোমিটার দূরের ঐ প্রকল্পটির জন্য ভারত সরকারকে কেন রাজি করাতে পারে না?
আমরা যদি বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করি, তাহলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই তো দরকার? তাই না? আমাদের সামনে যে উদাহরণগুলো আছে – যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ ভাগ, জার্মানিতে ৪১ ভাগ, চীনে ৭৯ ভাগ পর্যন্ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে৷ এটা নিয়ে আপনার অভিমত কী?
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অপরিহার্য না৷ সেটা আগে ছিল৷ ১০০ বছর আগে যে টেকনোলজিতে মানুষ চলত, যে টেকনোলজিতে খাদ্য উৎপাদন হতো, যে টেকনোলজিতে মানুষ চলাফেরা করত, সেই টেকনোলজি তো এখন মানুষ ব্যবহার করবে না, করছেও না৷ বিশ্বে যে একটা টেকনোলজিকাল ডেভেলপমেন্ট হয়েছে, সেটা তো উপলব্ধি করেছে মানুষ৷ মানুষ আবিষ্কার করেছে, কোনটাতে কী ক্ষতি হয়৷ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েই মানুষের বিদ্যুৎ উৎপাদনের যাত্রা শুরু৷ চীন, ভারত, জার্মানিতে আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আধিপত্যই দেখি৷ কিন্তু তারা তাদের অভিজ্ঞতার কারণে যে পরিসংখ্যানগুলো দেন, সেটা যদি আপনি ১০ বছর আগের সঙ্গে তুলনা করেন তাহলে দেখবেন যে, আগের তুলনায় এই সংখ্যা কমে আসছে৷ এদের প্রত্যেকের পরিকল্পনা, আগামী ১০ বছরের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ড্রাস্টিক্যালি কমিয়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে যাওয়ার৷যাদের গ্যাস সম্পদ আছে, তারা গ্যাসের দিকে শিফ্ট করছে৷ আমাদের যে বিশাল গ্যাস সম্পদের সম্ভবনা আছে বঙ্গোরসাগরে, সেদিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত৷ তাছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশে৷ সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি এবং বর্জ্য ক্তি – এ নিয়ে আমরা বিশেষজ্ঞদের যে মতামত পাই, তাতে আমাদের দুশ্চিন্তারই কোনো কারণ নেই৷ এগুলোর জন্য চেষ্টা করতে হবে, সক্ষমতা বাড়াতে হবে৷ এরপরও যদি আর কোনো অল্টারনেটিভ না থাকে তাহলে কোথাও কোথাও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে, স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়মকানুন মেনে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে৷
সরকার বলছে, সুন্দরবন এলাকায় বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কথা৷ বলছে বিভিন্ন রকমের জীবিকার কথা, যেগুলো বনের ক্ষতি করছে৷ এখন ওখানে যদি একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র হয় এবং মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়, তাহলে বনকে ক্ষতি করার মানুষের যে প্রবণতা, তা অনেকাংশে কমে যাবে৷ এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
এটা হচ্ছে গরিব মানুষদের নিয়ে কুৎসা রটনা করা৷ প্রকৃত সত্যকে ঢেকে জনগণের ওপর দায় চাপানো৷ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, ওখানে যারা আগুন ধরায় তারা প্রধানত সরকারি দলের লোক৷ আর যারা জীবন-জীবিকার জন্য সুন্দনবনের ওপর নির্ভরশীল – সেটা মধু হোক, মাছ হোক বা অন্যকিছু – তাদের কারণে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হয় না৷ তারা হাজার বছর ধরেই সুন্দরবনের সঙ্গে বসবাস করে৷ সুন্দরবনের ক্ষতি করে তারা, যারা ভূমিগ্রাসী, যারা বনগ্রাসী, যারা সরকারি ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নিজেদের মুনাফা লুটতে চায়৷ এই ধরনের কতিপয় লোকের জন্যই সুন্দরবনের ক্ষতি হয়৷ কয়লাবাহী জাহাজটা যে ডুবল, তাতে সুন্দরবনের যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতি কমানোর জন্য ঐ অঞ্চলের গরিব মানুষরাই ভূমিকা রেখেছে বেশি৷
বন্ধুরা, কেমন লাগলো আনু মুহাম্মদের সাক্ষাৎকারটি? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷