২০১৬ সালে সারা বিশ্বে ৮৬২টি জাহাজ ভাঙা হয়েছে বলে জানিয়েছে ‘এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম'৷ এর মধ্যে ৬৬৮টি ভেঙেছেন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের শ্রমিকরা৷
বিজ্ঞাপন
ব্রাসেলস ভিত্তিক শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম পরিবেশ, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা ১৯টি সংগঠনের একটি জোট৷ জাহাজা ভাঙা ইয়ার্ডে শ্রমিকদের নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং পরিবেশসম্মত উপায়ে জাহাজ ভাঙার কাজ নিশ্চিত করতে কাজ করে এই প্ল্যাটফর্ম৷
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ২০১৬ সালের জাহাজ ভাঙা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করে শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম৷ এতে বলা হয়, জাহাজ ভাঙার নীতি অনুসরণে সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে জার্মানি৷ গত বছর দেশটির মোট ৯৯টি জাহাজ ভাঙা হয়৷ এর মধ্যে ৯৭টিই ভাঙা হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়, অর্থাৎ বাংলাদেশে, ভারত ও পাকিস্তানে৷ আর এই ৯৭টি জাহাজের ৪০ শতাংশ ভেঙেছেন বাংলাদেশের শ্রমিকরা৷ বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙার পরিবেশকে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বাজে মনে করা হয়, বলে জানিয়েছে শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম৷
দক্ষিণ এশিয়ার বিপজ্জনক জাহাজ কবরখানা
ভারত এবং বাংলাদেশের শ্রমিকরা পরিত্যক্ত জাহাজ ভাঙার সময় ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেন৷ পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না করায় শিপইয়ার্ডগুলোর মুনাফা বেশি হলেও শ্রমিকদের জীবন বিপন্ন হয়৷
ছবি: Tomaso Clavarino
শ্রমিকদের পাশে কেউ নেই
চট্টগ্রামের এক শিপইয়ার্ডে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে এক তরুণকে৷ শিপইয়ার্ডে কাজ করা একচতুর্থাংশ শ্রমিকের বয়স ১৮ বছরের কম৷ তাসত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার সরকারেরা শিপইয়ার্ডের শ্রমিকদের অধিকার এবং পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলো উপেক্ষা করে থাকেন৷
ছবি: Tomaso Clavarino
শোষিত
তরুণ এবং শিশু শ্রমিকরা তাঁদের বয়স্ক সহকর্মীদের চেয়ে বেশিক্ষণ কাজ করলেও, কম পয়সা মজুরি পান৷
ছবি: Tomaso Clavarino
অরক্ষিত
শ্রমিকদের হেলমেট, নিরাপত্তা জুতা বা চশমা দেওয়া হয় না৷ ফলে মাঝেমাঝেই বড় ধরনের ইনজুরির শিকার হন তাঁরা৷
ছবি: Tomaso Clavarino
পুড়ে যাওয়া শ্রমিক
চট্টগ্রাম হাসপাতালে সেজু৷ একটি জাহাজ ভাঙার সময় তাতে আগুন লেগে গেলে মারাত্মকভাবে পুড়ে যান তিনি৷
ছবি: Tomaso Clavarino
পঙ্গুত্ব
সাবেক শ্রমিক শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কাজ করতে গিয়ে তাঁর এক পা হারান৷
ছবি: Tomaso Clavarino
বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত
শুধু যে শ্রমিকরা ভুগছেন, তা নয়৷ শিপইয়ার্ডের আশেপাশের এলাকার মাটি এবং ভূপৃষ্ঠের নীচে থাকা পানিও ভারী তেল, সীসা এবং অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে এসে দূষিত হয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: Tomaso Clavarino
পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন নেই
শিপইয়ার্ডের আশেপাশের ইকোসিস্টেম এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে সেখানে কৃষি কাজ করা বা মাছ ধরা প্রায় অসম্ভব এখন৷
ছবি: Tomaso Clavarino
অভিবাসী শ্রমিক
ভারতের আলং শহরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের অবস্থান৷ তবে এখানে কাজ করা প্রায় সব শ্রমিকই উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছে৷ ২০০৯ সাল থেকে এখন অবধি এই ইয়ার্ডে ২,৬০০ শিপ ভাঙা হয়েছে৷
ছবি: Tomaso Clavarino
এক সংযত জীবন
এরপর ছোট ছোট কুঁড়েঘরে শ্রমিকরা থাকেন, যেখানে বিদ্যুৎ বা নিয়মিত পানি সাপ্লাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই৷
ছবি: Tomaso Clavarino
পর্যটকদের ভিড়
শিপব্রকেং ইয়ার্ডগুলো শুধু যে শ্রমিকদের আকৃষ্ট করে, তা নয়৷ এমনকি পর্যটকরাও এখানে আসেন ভেঙে ফেলা জাহাজগুলো ক্যামেরাবন্দি করতে৷
ছবি: Tomaso Clavarino
10 ছবি1 | 10
গত বছর জার্মানির জাহাজ নির্মাতাদের মধ্যে হানসা মারে-র ১২টি জাহাজ ভাঙার জন্য বিক্রি করা হয়৷ এছাড়া আলফা শিপ এফ., ল্যাইসৎস ও পেটার ড্যোলের সাতটি এবং ড. পেটার্স, ক্যোনিশ অ্যান্ড সি, নর্ডডয়চে ফ্যারম্যোগেন ও রিকমার্সের ছয়টি জাহাজ বাংলাদেশে ভাঙার জন্য বিক্রি করা হয়৷ খাবারের বিখ্যাত ব্র্যান্ড ড. ওয়েটকার’ও তাদের একটি পুরনো কনটেনার শিপ বাংলাদেশে পাঠিয়েছে৷
জার্মান জাহাজ নির্মাতাদের এমন পদক্ষেপের সমালোচনা করে জার্মান সরকারের কাছে উদ্বেগ জানিয়েছেন বিষাক্ততা ও মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা৷
শ্রমিকের মৃত্যু
জার্মানির রেনাটে এন. কোম্পানির একটি জাহাজ ভাঙার সময় চট্টগ্রামের সেইকো ইয়ার্ডে তিনজন শ্রমিক প্রাণ হারান৷ আহত হন আরও তিনজন৷ নভেম্বরে জার্মানির আরও একটি জাহাজ ভাঙার সময় একজন নিহত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছে শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম৷
সংস্থার নির্বাহী পরিচালক প্যাট্রিসিয়া হাইডেগার বলেন, জার্মান জাহাজ নির্মাতাদের জাহাজ ভাঙতে গিয়ে শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়৷
শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম জানিয়েছে, ২০১৬ সালে জাহাজ ভাঙতে গিয়ে বাংলাদেশে ২২ জন শ্রমিকের প্রাণ যাওয়ার খবর তারা পেয়েছে৷ এছাড়া ২৯ জন শ্রমিক মারাত্মক আহত হয়েছে বলেও জানায় সংস্থাটি৷
এদিকে, ২০১৬ সালে গ্রিসের ১০৪টি জাহাজ ভাঙতে দক্ষিণ এশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল৷ সংখ্যার হিসেবে এটি সর্বোচ্চ৷
তালিকা প্রকাশ করা হবে
ইউরোপীয় ইউনিয়ন চলতি বছর সারা বিশ্বের জাহাজ ভাঙা কোম্পানির একটি তালিকা প্রকাশ করবে, যারা পরিবেশ রক্ষা ও শ্রমিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে৷ গতবছর ইউরোপে অবস্থিত এমন ১৮টি কোম্পানির নাম প্রকাশ করেছিল ইইউ৷
এদিকে, জার্মান কনটেনার লাইন হাপাগ-লয়েড ইতিমধ্যে জানিয়েছে, এখন থেকে তারা ইইউ-র তালিকায় থাকা ইয়ার্ডগুলোতে জাহাজ ভাঙার জন্য পাঠাবে৷
পতাকা পরিবর্তন
জাহাজ নির্মাতারা জাহাজ ভাঙার ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব এড়াতে ‘জিএমএস’ ও ‘উইরানা’র মতো কোম্পানির কাছে তাদের জাহাজ বিক্রি করে৷ ঐ কোম্পানিগুলো জাহাজ ভাঙা কোম্পানির কাছে জাহাজ বিক্রির আগে পতাকা পরিবর্তন করে৷ এক্ষেত্রে পালাও, কমোরস এবং সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস নামক ছোট ছোট দেশগুলোর পতাকা ব্যবহার করা হয়৷
প্রতিবছর এক হাজারের বেশি জাহাজ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়৷ এগুলোর অধিকাংশের শেষ ঠিকানা তখন হয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে৷ এই কাজ অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং প্রাণঘাতী৷
ছবি: DW/G. Ketels
শান্তিতে থাকুক?
চট্টগ্রামে কয়েক ডজন শিপব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে৷ দুই লাখের মতো শ্রমিক হাজার কোটি টাকার এই বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ বড় বড় জাহাজ টুকরা টুকরা করার কাজ অধিকাংশক্ষেত্রে করে খালি হাতে৷ তাই শারীরিক ক্ষতি এমনকি মৃত্যু সেখানে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়৷
ছবি: DW/G. Ketels
আলমগীর – জাহাজের কবর খোঁড়েন যিনি
ডয়চে ভেলের লাইফ লিংকস অনুষ্ঠানের ‘#হেডএবাভওয়াটার’ পর্বের জন্য আমরা আলমগীরের সঙ্গে দেখা করতে চট্টগ্রাম যাই৷ সে দিনে ১৪ ঘণ্টার মতো কাজ করে৷ মজুরিও অনেক কম৷
ছবি: DW/G. Ketels
টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়
একটি মালবাহী শিপ গড়ে ২৫ থেকে ৩০ বছর ব্যবহার করা যায়৷ এরপর সেটার ইন্সুরেন্স এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এত বেড়ে যায় যে সেটি ব্যবহার আর লাভজনক থাকে না৷ ফলে অধিকাংশ জাহাজ তখন চলে যায় বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে৷ এ সব ইয়ার্ডে মূলত অদক্ষ শ্রমিকরা জাহাজ ভাঙার কাজ করে৷
ছবি: DW/G. Ketels
বিপজ্জনক বিনাশ
একটি জাহাজের ভেতরের অংশ প্রথমে ভাঙা হয়৷ কাজটি অত্যন্ত কঠিন এবং বিপজ্জনক৷ কেননা জাহাজ তৈরি করা হয় এমনভাবে, যাতে সেটা প্রতিকূল আবহাওয়ার মোকাবিলা করতে পারে এবং ভেঙে না যায়৷ তাই সেই জাহাজ কার্যত খালি হাতে ভাঙতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার শঙ্কায় থাকেন শ্রমিকরা৷
ছবি: DW/G. Ketels
ধীরে ধীরে মৃত্যু
অধিকাংশ শ্রমিককে কাজ করার সময় ‘প্রটেকটিভ গিয়ার’ দেয়া হয়না৷ তারা জাহাজ ভাঙেন খালি হাতে ‘এসেটিলিন টর্চ’ ব্যবহার করেন৷ অদক্ষ এই শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা বা বিস্ফোরণে আহত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন৷
ছবি: DW/G. Ketels
বিপজ্জনক অবস্থা
জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকরা কাজ করার সময় বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসেন যা ফুসফুসে সমস্যা, এমনকি ক্যানসারেরও কারণ হতে পারে৷ আরা যাঁরা কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে না ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ৷ এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় না৷
ছবি: DW/G. Ketels
স্টিলের উৎস
বেসরকারি উন্নয়নসংস্থা শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দু’শ-র মতো জাহাজ চট্টগ্রামে ভাঙা হয়৷ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে স্টিলের যে চাহিদা রয়েছে, তার অধিকাংশই জোগাড় হয় জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে৷ চট্টগ্রামের উত্তরে সীতাকুণ্ড হচ্ছে এই শিল্পের রাজধানী৷ সেখানে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সৈকতে আট মাইল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই শিল্প৷
ছবি: DW/G. Ketels
১৯৬৯ সালে শুরু
চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শুরু হয় ১৯৬৯ সালের দিকে৷ একটি স্টিল কোম্পানি সেসময় একটি অকেজো জাহাজ সেখানে নিয়ে যায় এবং ভাঙতে শুরু করে৷ কয়েক বছর লেগেছিল সেটি ভাঙতে৷ চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শিল্পের শুরুটা এভাবেই৷
ছবি: DW/G. Ketels
শিশুরাও কাজ করছে
জাহাজ ভাঙা শিল্পে শিশুশ্রম সাধারণ ব্যাপার৷ বাংলাদেশের মোট কর্মশক্তির এক পঞ্চমাংশের বয়স ১৫ বছরের নীচে৷ ধারণা করা হয় জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের অর্ধেকের বয়স ২২ বছরের নীচে৷ অল্প বয়সি শিশুরা গ্যাস কাটারদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে এবং মালামাল বহন করে৷ এসব শিশু লেখাপড়ার সুযোগ পাওয়া না এবং বিরূপ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হয়৷
ছবি: DW/G. Ketels
পণ্য বিক্রি
জাহাজের মধ্যে পাওয়া বিভিন্ন পণ্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন শ্রমিকরা৷ এ সবের মধ্যে আসবাবপত্র এবং ‘শো পিস’ ছাড়াও রয়েছে মালিকদের জাহাজে ফেলে যাওয়া বিভিন্ন সামগ্রী৷
ছবি: DW/G. Ketels
দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ
সীতাকুণ্ডের সমুদ্র সৈকত একসময় পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক স্থান ছিল৷ কিন্তু এখন জাহাজ ভাঙা শিল্পের কারণে সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ৷ শিপিং ইয়ার্ড থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে৷ বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে বেশ উদাসীন৷