চীনের সস্তায় স্টিল বিক্রি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে ইইউ-র উদ্যোগ দক্ষিণ এশিয়ার জাহাজ ভাঙা শিল্পে বিপর্যয় ডেকে এনেছে৷ ভারত, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা অন্য ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন৷ তাঁদের আশঙ্কা, এই শিল্পের দিন প্রায় শেষ৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিপ রিসাইক্লিং সেন্টারটি ভারতের আলাং-এ৷ গুজরাট রাজ্যের সেই এলাকায় ভারত মহাসাগরের ১১ কিলোমিটার সৈকত জুড়ে কয়েক মাস আগেও পুরনো জাহাজের নানা ধরনের পণ্যের জমজমাট ব্যবসা ছিল৷ থালা-বাসন, আসবাবপত্র, কম্পিউটার – কোনো কিছুর ব্যবসাই আর আগের মতো চলছে না৷ আলাং-এ প্রায় ৬০ হাজার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করত জাহাজ ভাঙা শিল্পকে ঘিরে৷ তাঁদের অনেকেই এখন বেকার৷ ট্রাকটার চালক মুন্না বললেন, ‘‘আগে কোনো কোনো দিন ৫, ৬, এমনকি ৭টা ট্রিপও পেতাম৷ এখন দিনে দু-একটা ট্রিপ পেতেও কষ্ট হয়৷''
গত দু'বছরে ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের প্রায় অর্ধেক জাহাজ ভাঙা কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে৷ চীন খুব কম দামে স্টিল বিক্রি শুরু করেছে৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, এরই বিরূপ প্রভাব পড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার জাহাজ ভাঙা শিল্পে৷ ভারতের সাগর লক্ষ্মী শিপ ব্রেকার্স-এর মালিক অমিত বি. পাডিয়াও তা-ই বললেন৷ জাহাজ থেকে পাওয়া ২৫ হাজার টন স্টিল আট মাস আগেও যে দামে বিক্রি করা যেত, চীন সস্তায় বিক্রি শুরু করায় সেই স্টিল এখন মাত্র ৩৬ লাখ ডলারে ছেড়ে দিতে হচ্ছে৷
চট্টগ্রাম – জাহাজের কবরস্থান
প্রতিবছর এক হাজারের বেশি জাহাজ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়৷ এগুলোর অধিকাংশের শেষ ঠিকানা তখন হয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে৷ এই কাজ অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং প্রাণঘাতী৷
ছবি: DW/G. Ketels
শান্তিতে থাকুক?
চট্টগ্রামে কয়েক ডজন শিপব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে৷ দুই লাখের মতো শ্রমিক হাজার কোটি টাকার এই বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ বড় বড় জাহাজ টুকরা টুকরা করার কাজ অধিকাংশক্ষেত্রে করে খালি হাতে৷ তাই শারীরিক ক্ষতি এমনকি মৃত্যু সেখানে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়৷
ছবি: DW/G. Ketels
আলমগীর – জাহাজের কবর খোঁড়েন যিনি
ডয়চে ভেলের লাইফ লিংকস অনুষ্ঠানের ‘#হেডএবাভওয়াটার’ পর্বের জন্য আমরা আলমগীরের সঙ্গে দেখা করতে চট্টগ্রাম যাই৷ সে দিনে ১৪ ঘণ্টার মতো কাজ করে৷ মজুরিও অনেক কম৷
ছবি: DW/G. Ketels
টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়
একটি মালবাহী শিপ গড়ে ২৫ থেকে ৩০ বছর ব্যবহার করা যায়৷ এরপর সেটার ইন্সুরেন্স এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এত বেড়ে যায় যে সেটি ব্যবহার আর লাভজনক থাকে না৷ ফলে অধিকাংশ জাহাজ তখন চলে যায় বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে৷ এ সব ইয়ার্ডে মূলত অদক্ষ শ্রমিকরা জাহাজ ভাঙার কাজ করে৷
ছবি: DW/G. Ketels
বিপজ্জনক বিনাশ
একটি জাহাজের ভেতরের অংশ প্রথমে ভাঙা হয়৷ কাজটি অত্যন্ত কঠিন এবং বিপজ্জনক৷ কেননা জাহাজ তৈরি করা হয় এমনভাবে, যাতে সেটা প্রতিকূল আবহাওয়ার মোকাবিলা করতে পারে এবং ভেঙে না যায়৷ তাই সেই জাহাজ কার্যত খালি হাতে ভাঙতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার শঙ্কায় থাকেন শ্রমিকরা৷
ছবি: DW/G. Ketels
ধীরে ধীরে মৃত্যু
অধিকাংশ শ্রমিককে কাজ করার সময় ‘প্রটেকটিভ গিয়ার’ দেয়া হয়না৷ তারা জাহাজ ভাঙেন খালি হাতে ‘এসেটিলিন টর্চ’ ব্যবহার করেন৷ অদক্ষ এই শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা বা বিস্ফোরণে আহত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন৷
ছবি: DW/G. Ketels
বিপজ্জনক অবস্থা
জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকরা কাজ করার সময় বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসেন যা ফুসফুসে সমস্যা, এমনকি ক্যানসারেরও কারণ হতে পারে৷ আরা যাঁরা কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে না ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ৷ এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় না৷
ছবি: DW/G. Ketels
স্টিলের উৎস
বেসরকারি উন্নয়নসংস্থা শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দু’শ-র মতো জাহাজ চট্টগ্রামে ভাঙা হয়৷ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে স্টিলের যে চাহিদা রয়েছে, তার অধিকাংশই জোগাড় হয় জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে৷ চট্টগ্রামের উত্তরে সীতাকুণ্ড হচ্ছে এই শিল্পের রাজধানী৷ সেখানে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সৈকতে আট মাইল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই শিল্প৷
ছবি: DW/G. Ketels
১৯৬৯ সালে শুরু
চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শুরু হয় ১৯৬৯ সালের দিকে৷ একটি স্টিল কোম্পানি সেসময় একটি অকেজো জাহাজ সেখানে নিয়ে যায় এবং ভাঙতে শুরু করে৷ কয়েক বছর লেগেছিল সেটি ভাঙতে৷ চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শিল্পের শুরুটা এভাবেই৷
ছবি: DW/G. Ketels
শিশুরাও কাজ করছে
জাহাজ ভাঙা শিল্পে শিশুশ্রম সাধারণ ব্যাপার৷ বাংলাদেশের মোট কর্মশক্তির এক পঞ্চমাংশের বয়স ১৫ বছরের নীচে৷ ধারণা করা হয় জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের অর্ধেকের বয়স ২২ বছরের নীচে৷ অল্প বয়সি শিশুরা গ্যাস কাটারদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে এবং মালামাল বহন করে৷ এসব শিশু লেখাপড়ার সুযোগ পাওয়া না এবং বিরূপ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হয়৷
ছবি: DW/G. Ketels
পণ্য বিক্রি
জাহাজের মধ্যে পাওয়া বিভিন্ন পণ্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন শ্রমিকরা৷ এ সবের মধ্যে আসবাবপত্র এবং ‘শো পিস’ ছাড়াও রয়েছে মালিকদের জাহাজে ফেলে যাওয়া বিভিন্ন সামগ্রী৷
ছবি: DW/G. Ketels
দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ
সীতাকুণ্ডের সমুদ্র সৈকত একসময় পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক স্থান ছিল৷ কিন্তু এখন জাহাজ ভাঙা শিল্পের কারণে সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ৷ শিপিং ইয়ার্ড থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে৷ বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে বেশ উদাসীন৷
ছবি: DW/G. Ketels
11 ছবি1 | 11
আলাং-এর কালথিয়া শিপ ব্রেকিং প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক চেতন কালথিয়া কয়েকদিন আগেই জাপানের বড় একটা জাহাজ কিনেছেন৷ তাতে আনন্দিত তিনি৷ তবে তিনিও জানেন, এমন আনন্দ বেশি দিনের নয়৷ চেতন বললেন, ‘‘এটাই আমার শেষ জাহাজ৷ এই শিল্প শেষ হয়ে যাচ্ছে৷''
আলাং-এ বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিপ রিসাইক্লিং সেন্টারে পুরোনো জাহাজ কেনা-বেচা অনেক কমেছে৷ ২০১৪ সালে যেখানে একশ'টিরও বেশি জাহাজ বিক্রি হয়েছিল, সেখানে এ বছরের প্রথম সাত মাসে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫০টি জাহাজ৷
বাংলাদেশ আর পাকিস্তানেও জাহাজ ভাঙা শিল্পের খুব খারাপ অবস্থা৷ বাংলাদেশের পরিস্থিতি বোঝাতে গিয়ে চট্টগ্রামের পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর পরিচালক জহিরুল ইসলাম বললেন, ‘‘তিন বছর আগে যেখানে মোট ৮০টি ইয়ার্ড ছিল, এখন সেখানে মাত্র ২৫টি ইয়ার্ড আছে৷ আমার মনে হয়, এই শিল্প বড়জোর ১০-১৫ বছর টিকবে৷''
ইউরোপীয় ইউনিয়ন চায় পরিবেশের ক্ষতি হবে না – এমন স্থানেই শুধু জাহাজ ভাঙা শিল্প থাকবে৷ চীনের কম দামে স্টিল বিক্রির পাশাপাশি এ বিষয়টিও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য শঙ্কা হয়ে দেখা দিয়েছে৷ এ বছরের মধ্যেই জাহাজ ভাঙা শিল্পের স্থান নির্ধারণের বিষয়ে নিয়ম চূড়ান্ত করবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ চীন এবং তুরস্কের মতো দেশের পক্ষে এ শর্ত মেনে ব্যবসা করা সম্ভব৷ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পক্ষে তা শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব৷