বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা শিল্পের কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সেবার উন্নতি হয়েছে দাবি করা হলেও, বাস্তব অবস্থা ভিন্ন৷ গত বছরও ১৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়৷ ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় নিয়ে জাহাজ আছে ইয়ার্ডে, কিন্তু দেখার কেউ নেই৷
বিজ্ঞাপন
গতবছর বাংলাদেশে আসা একটি ‘স্ক্র্যাপ' জাহাজ নিয়ে বেশ হইচই পড়ে যায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে৷ বলা হয়, জাহাজটিতে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য আছে৷ পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়েই ‘এমভি প্রডিউসার' নামের ঐ জাহাজটি কাটা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মাদাম বিবির হাটে জনতা স্টিল কর্পোরেশন নামের একটি ইয়ার্ডে৷ ডেনমার্কের আর্ন্তজাতিক কোম্পানি ‘মায়ের্সক'-এর এই অয়েল ট্যাংকারটি দ্বিতীয়পক্ষের হাত ঘুরে ‘প্রডিউসার' নাম নিয়ে বাংলাদেশে আসে৷
সমালোচনা শুরুর পর সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ৷ ওই কমিটি জাহাজটি কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে৷ এরপরেও অবশ্য জাহাজটি পড়ে আছে ইয়ার্ডে৷ এটিকে দূষণমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি৷ চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক হারুন অর রশীদ খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা তদন্তে জাহাজটিতে তেজস্ক্রিয় পদার্থের উপস্থিতি পেয়েছি৷ তাই জাহাজটি কাটা বন্ধ করে দিয়েছি৷ কিন্তু পরবর্তী সিদ্ধান্ত কী হবে, তা তো উপর মহলই বলতে পারবে৷''
দক্ষিণ এশিয়ার বিপজ্জনক জাহাজ কবরখানা
ভারত এবং বাংলাদেশের শ্রমিকরা পরিত্যক্ত জাহাজ ভাঙার সময় ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেন৷ পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না করায় শিপইয়ার্ডগুলোর মুনাফা বেশি হলেও শ্রমিকদের জীবন বিপন্ন হয়৷
ছবি: Tomaso Clavarino
শ্রমিকদের পাশে কেউ নেই
চট্টগ্রামের এক শিপইয়ার্ডে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে এক তরুণকে৷ শিপইয়ার্ডে কাজ করা একচতুর্থাংশ শ্রমিকের বয়স ১৮ বছরের কম৷ তাসত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার সরকারেরা শিপইয়ার্ডের শ্রমিকদের অধিকার এবং পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলো উপেক্ষা করে থাকেন৷
ছবি: Tomaso Clavarino
শোষিত
তরুণ এবং শিশু শ্রমিকরা তাঁদের বয়স্ক সহকর্মীদের চেয়ে বেশিক্ষণ কাজ করলেও, কম পয়সা মজুরি পান৷
ছবি: Tomaso Clavarino
অরক্ষিত
শ্রমিকদের হেলমেট, নিরাপত্তা জুতা বা চশমা দেওয়া হয় না৷ ফলে মাঝেমাঝেই বড় ধরনের ইনজুরির শিকার হন তাঁরা৷
ছবি: Tomaso Clavarino
পুড়ে যাওয়া শ্রমিক
চট্টগ্রাম হাসপাতালে সেজু৷ একটি জাহাজ ভাঙার সময় তাতে আগুন লেগে গেলে মারাত্মকভাবে পুড়ে যান তিনি৷
ছবি: Tomaso Clavarino
পঙ্গুত্ব
সাবেক শ্রমিক শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কাজ করতে গিয়ে তাঁর এক পা হারান৷
ছবি: Tomaso Clavarino
বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত
শুধু যে শ্রমিকরা ভুগছেন, তা নয়৷ শিপইয়ার্ডের আশেপাশের এলাকার মাটি এবং ভূপৃষ্ঠের নীচে থাকা পানিও ভারী তেল, সীসা এবং অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে এসে দূষিত হয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: Tomaso Clavarino
পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন নেই
শিপইয়ার্ডের আশেপাশের ইকোসিস্টেম এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে সেখানে কৃষি কাজ করা বা মাছ ধরা প্রায় অসম্ভব এখন৷
ছবি: Tomaso Clavarino
অভিবাসী শ্রমিক
ভারতের আলং শহরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের অবস্থান৷ তবে এখানে কাজ করা প্রায় সব শ্রমিকই উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছে৷ ২০০৯ সাল থেকে এখন অবধি এই ইয়ার্ডে ২,৬০০ শিপ ভাঙা হয়েছে৷
ছবি: Tomaso Clavarino
এক সংযত জীবন
এরপর ছোট ছোট কুঁড়েঘরে শ্রমিকরা থাকেন, যেখানে বিদ্যুৎ বা নিয়মিত পানি সাপ্লাইয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই৷
ছবি: Tomaso Clavarino
পর্যটকদের ভিড়
শিপব্রকেং ইয়ার্ডগুলো শুধু যে শ্রমিকদের আকৃষ্ট করে, তা নয়৷ এমনকি পর্যটকরাও এখানে আসেন ভেঙে ফেলা জাহাজগুলো ক্যামেরাবন্দি করতে৷
ছবি: Tomaso Clavarino
10 ছবি1 | 10
বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এখন অন্তত ৬০টি জাহাজ কাটা প্রতিষ্ঠান বা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড সচল আছে৷ যদিও কাগজে-কলমে আছে দেড় শতাধিক আর এ সব কারাখানায় বছরে আড়াইশ' থেকে তিনশ' ‘স্ক্র্যাপ' জাহাজ কাটা হয়৷ এই শিল্পে কাজ করেন প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক৷ অভিযোগ আছে, এখানে রাতে শিশু শ্রমিকদেরও কাজ করানো হয়৷
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক হারুন অর রশীদ খান আরো জানান, ‘‘বছরে ৭-৮টির বেশি জাহাজের পরিবেশের ছাড়পত্র নেওয়া হয় না৷ শিল্পমন্ত্রণালয়ের অনুমোদন দিয়েই জাহাজ কাটা শুরু হয়৷ আমরা বারবার নোটিশ দিলেও তারা অনুমতি নেয় না৷ মালিকদের কথা শিল্পমন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার পর আমাদের আর কোনো অনুমোদনের প্রয়োজন নাই৷ ফলে এখানে যে জাহাজ কাটা হয়, তা সব দূষণ বা তেজস্ক্রিয়মুক্ত কিনা তা বলা সম্ভব নয়৷ আমরা চাইলে মামলা করতে পারি৷ কিন্তু নানা কারণে সেটা সম্ভব হয় না৷''
HarunOr Rashid Khan - MP3-Stereo
বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে ১৯৬০ সালে জাহাজ ভাঙা শিল্পের গোড়াপত্তন৷ এমডি আলপাইন নামে একটি গ্রিক জাহাজ চট্টগ্রামের সমুদ্র সৈকতে বিকল হয়ে পড়লে স্থানীয় লোকজন ও স্টিল শ্রমিকরা তা টেনে সমুদ্রের তীরে এনে তা ভেঙে বিভিন্ন নির্মাণ কাজে ব্যবহার উযোগী করে তোলে৷ সেই থেকে শুরু৷ এখন বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে রড় এবং ইস্পাতের চাহিদা মেটায় এই জাহাজ ভাঙা শিল্প৷ ২০০৪-২০০৯ – এই পাঁচবছর বাংলাদেশ জাহাজ ভাঙা শিল্পে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে ছিল৷ তবে এখন ভারত সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে৷ তাই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ৷
দেশে ইস্পাতের চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশের জোগান দেওয়া হয় জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে৷ এই ব্যবসার আকার প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা৷ ২০১১ মাসের মার্চে সরকার জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা ও জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজতকরণকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে৷
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের মাদাম বিবির হাট, কুমিরা, ভাটিয়ারি, সোনাইছড়ি, জাহানাবাদ, কদমরসূল, বাঁশবাড়িয়া উপকূলজুড়ে এ সব শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোর অবস্থান৷ বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা নানা সংকটের মধ্য দিয়ে ৬০টি ইয়ার্ড এখনও চালু রাখতে পেরেছি, যদিও লাইসেন্স নেওয়া ইয়ার্ডের সংখ্যা প্রায় দেড়শ'৷ এ সব ইয়ার্ডে বছরে কমপক্ষে আড়াইশ' জাহাজ ভাঙা হয়৷ আমরা সরকারকে বছরে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব দিই৷''
Abu Taher - MP3-Stereo
জাহাজ ভাঙা শিল্পে ঝুঁকি
‘স্ক্র্যাপ' জাহাজের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো বিপজ্জনক বা তেজস্ক্রিয় বর্জ্য৷ জাহাজে অ্যাসবেস্টস, গ্লাসহোল, লুব্রিকেন্ট ওয়েলসহ নানা ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর বর্জ্য থাকে৷ তাই ‘বিপজ্জনক বর্জ্য ও জাহাজ ভাঙা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১১'-এর ১৯ (১) বিধি অনুযায়ী, পরিবেশগত ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান আছে৷ কিন্তু এই ছাড়পত্র নেওয়া হয় না৷ গত বছর দু'শরও বেশি জাহাজ কাটা হলেও ছাড়পত্র নেয়া হয়েছে মাত্র আটটির৷ চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক হারুন অর রশীদ খান বলেন, এখন শিল্প মন্ত্রণালয়ও অনুমোদন দেয়৷ ফলে মালিকরা সেখানকার অনুমোদন নিয়েই জাহাজ কাটা শুরু করে৷ পরিবেশের ছাড়পত্রের তোয়ক্কা করে না৷
একই সঙ্গে জাহাজ কাটার কাজ খুবই ঝঁকিপূর্ণ এবং বিপজ্জনক৷ প্রতিবছরই নিরাপত্তা ত্রুটি এবং কর্ম পরিবেশের অভাবে এই শিল্ডে শ্রমিক মারা যায়৷ শিপ ব্রেকার্স ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের সভাপতি তপন দত্ত ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘গতবছর ১৮ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন আর কতজন আহত হয়েছেন, তার সঠিক হিসাব নেই৷ তারা জাহাজ কাটার সময় উপর থেকে নীচে পড়ে বা আগুনে ঝলসে নিহত হয়েছেন৷ কয়েকদিন আগেও সিমি মনি মারমা নামে একজন শ্রমিক গুরুতর আহত হয়েছেন৷ গত ২ এপ্রিল শ্রমিক মারা গেছে৷''
চট্টগ্রাম – জাহাজের কবরস্থান
প্রতিবছর এক হাজারের বেশি জাহাজ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়৷ এগুলোর অধিকাংশের শেষ ঠিকানা তখন হয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে৷ এই কাজ অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং প্রাণঘাতী৷
ছবি: DW/G. Ketels
শান্তিতে থাকুক?
চট্টগ্রামে কয়েক ডজন শিপব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে৷ দুই লাখের মতো শ্রমিক হাজার কোটি টাকার এই বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ বড় বড় জাহাজ টুকরা টুকরা করার কাজ অধিকাংশক্ষেত্রে করে খালি হাতে৷ তাই শারীরিক ক্ষতি এমনকি মৃত্যু সেখানে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়৷
ছবি: DW/G. Ketels
আলমগীর – জাহাজের কবর খোঁড়েন যিনি
ডয়চে ভেলের লাইফ লিংকস অনুষ্ঠানের ‘#হেডএবাভওয়াটার’ পর্বের জন্য আমরা আলমগীরের সঙ্গে দেখা করতে চট্টগ্রাম যাই৷ সে দিনে ১৪ ঘণ্টার মতো কাজ করে৷ মজুরিও অনেক কম৷
ছবি: DW/G. Ketels
টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়
একটি মালবাহী শিপ গড়ে ২৫ থেকে ৩০ বছর ব্যবহার করা যায়৷ এরপর সেটার ইন্সুরেন্স এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এত বেড়ে যায় যে সেটি ব্যবহার আর লাভজনক থাকে না৷ ফলে অধিকাংশ জাহাজ তখন চলে যায় বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে৷ এ সব ইয়ার্ডে মূলত অদক্ষ শ্রমিকরা জাহাজ ভাঙার কাজ করে৷
ছবি: DW/G. Ketels
বিপজ্জনক বিনাশ
একটি জাহাজের ভেতরের অংশ প্রথমে ভাঙা হয়৷ কাজটি অত্যন্ত কঠিন এবং বিপজ্জনক৷ কেননা জাহাজ তৈরি করা হয় এমনভাবে, যাতে সেটা প্রতিকূল আবহাওয়ার মোকাবিলা করতে পারে এবং ভেঙে না যায়৷ তাই সেই জাহাজ কার্যত খালি হাতে ভাঙতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার শঙ্কায় থাকেন শ্রমিকরা৷
ছবি: DW/G. Ketels
ধীরে ধীরে মৃত্যু
অধিকাংশ শ্রমিককে কাজ করার সময় ‘প্রটেকটিভ গিয়ার’ দেয়া হয়না৷ তারা জাহাজ ভাঙেন খালি হাতে ‘এসেটিলিন টর্চ’ ব্যবহার করেন৷ অদক্ষ এই শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা বা বিস্ফোরণে আহত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন৷
ছবি: DW/G. Ketels
বিপজ্জনক অবস্থা
জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকরা কাজ করার সময় বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসেন যা ফুসফুসে সমস্যা, এমনকি ক্যানসারেরও কারণ হতে পারে৷ আরা যাঁরা কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে না ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ৷ এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় না৷
ছবি: DW/G. Ketels
স্টিলের উৎস
বেসরকারি উন্নয়নসংস্থা শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দু’শ-র মতো জাহাজ চট্টগ্রামে ভাঙা হয়৷ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে স্টিলের যে চাহিদা রয়েছে, তার অধিকাংশই জোগাড় হয় জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে৷ চট্টগ্রামের উত্তরে সীতাকুণ্ড হচ্ছে এই শিল্পের রাজধানী৷ সেখানে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সৈকতে আট মাইল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই শিল্প৷
ছবি: DW/G. Ketels
১৯৬৯ সালে শুরু
চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শুরু হয় ১৯৬৯ সালের দিকে৷ একটি স্টিল কোম্পানি সেসময় একটি অকেজো জাহাজ সেখানে নিয়ে যায় এবং ভাঙতে শুরু করে৷ কয়েক বছর লেগেছিল সেটি ভাঙতে৷ চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শিল্পের শুরুটা এভাবেই৷
ছবি: DW/G. Ketels
শিশুরাও কাজ করছে
জাহাজ ভাঙা শিল্পে শিশুশ্রম সাধারণ ব্যাপার৷ বাংলাদেশের মোট কর্মশক্তির এক পঞ্চমাংশের বয়স ১৫ বছরের নীচে৷ ধারণা করা হয় জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের অর্ধেকের বয়স ২২ বছরের নীচে৷ অল্প বয়সি শিশুরা গ্যাস কাটারদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে এবং মালামাল বহন করে৷ এসব শিশু লেখাপড়ার সুযোগ পাওয়া না এবং বিরূপ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হয়৷
ছবি: DW/G. Ketels
পণ্য বিক্রি
জাহাজের মধ্যে পাওয়া বিভিন্ন পণ্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন শ্রমিকরা৷ এ সবের মধ্যে আসবাবপত্র এবং ‘শো পিস’ ছাড়াও রয়েছে মালিকদের জাহাজে ফেলে যাওয়া বিভিন্ন সামগ্রী৷
ছবি: DW/G. Ketels
দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ
সীতাকুণ্ডের সমুদ্র সৈকত একসময় পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক স্থান ছিল৷ কিন্তু এখন জাহাজ ভাঙা শিল্পের কারণে সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ৷ শিপিং ইয়ার্ড থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে৷ বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে বেশ উদাসীন৷
ছবি: DW/G. Ketels
11 ছবি1 | 11
জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন বা ইপসা-র কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলি শাহীন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘চলকি বছরেও অন্তত আটজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন৷ আমরা তো ‘সাডেন ডেথ' দেখি৷ ‘হিডেন ডেথ' দেখি না৷ দুর্ঘটনার বাইরে জাহাজের ক্ষতিকর কেমিক্যাল বিশেষ করে অ্যাসবেস্টস, প্রেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ, ক্ষতিকর ধোয়ায় আক্রান্ত হয়ে অনেক শ্রমিক মারা যায়৷ অনেকে জটিল এবং কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়৷''
তিনি জানান, ‘‘শ্রমিকদের জন্য যে নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ নানা সেফটি উপকরণ, যেমন: হেলমেট, মাস্ক, গ্লাভস ব্যবহারের কথা তা ব্যবহার করা হয় না৷''
তপন দত্ত বলেন, ‘‘কিছু নিরাপত্তা উপকরণ সাজিয়ে রাখা হয়৷ যদি সরকারের কোনো সংস্থা যায় তাদের দেখানো হয়৷ বলা হয়, শ্রমিকরা এগুলো ব্যবহার করতে চায় না৷''
জানা গেছে, গত এক দশকে জাহাজ ভাঙা শিল্পে তিন শতাধিক শ্রমিক নানা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন৷ আহত হয়েছেন কয়েক হাজার৷ তাদের কেউ হাত বা পা হারিয়েছেন, কেউ চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন৷ কিন্তু ক্ষতিকর পদার্থের জন্য কত জন মারা গেছেন, কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন, তার হিসাব নেই৷
ক্ষতিপূরণ
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের দাবি করেন, আগের চেয়ে জাহাজ ভাঙা শিল্পে নিহত ও আহতের সংখ্যা অনেক কমে গেছে৷ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং উপকরণের ব্যবস্থা করায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে৷ তবে তিনি বলেন, ‘‘শ্রমিকরা অনেক সময় সেফটি উপকরণ ব্যবহার করতে চায় না৷ তখন আমাদের কিছু করার থাকে না৷ আর সড়ক দুর্ঘটনায়ও তো কত লোক মারা যায়৷ সে তুলনায় জাহাজ ভাঙা শিল্পে কাজ করতে গিয়ে নগণ্য সংখ্যক শ্রমিকই মারা যায়৷''
Mohammad Ali Sahin - MP3-Stereo
তিনি বলেন, ‘‘আমরা নিহত শ্রমিদের পরিবার প্রতি পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিই৷ আহতদের চিকিৎসার জন্য আলাদা হাসপাতাল করেছি৷''
এর জবাবে ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের সভাপতি তপন দত্ত বলেন, ‘‘নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় মাত্র এক লাখ টাকা৷ তবে অভিযোগ আছে, লোকজনের সামনে ওই টাকার চেক দিয়ে পরে তা আবার কেউ কেউ হাতিয়ে নেয়৷ কেউ মারা গেলে বা আহত হলে প্রথম চেষ্টা করা হয় তা লুকিয়ে রাখার৷ পুলিশ একাজে সহায়তা করে বলেও অভিযোগ আছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘যে হাসপাতালের কথা বলা হচ্ছে, ওটা একটা প্রাইভেট হাসপাতাল৷ ওখানে শ্রমিকরা চিকিৎসা পায় না৷ আহত শ্রমিকদের কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে তাদের দ্রুত বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷''
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘এখানকার ইয়ার্ডে রাতে গোপনে শিশু শ্রমিকদের কাজ করানো হয়৷ হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে রাত ৮টার পরও শ্রমিকদের কাজে বাধ্য করা হয়৷ শ্রমিকদের পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিসি) বলতে কিছুই নেই৷ আমরা তো মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ চাই না৷ চাই মৃত্যু রোধ৷ চাই শ্রমিকের জীবনের নিরপত্তা৷''
Tapan Datta - MP3-Stereo
জাহাজ ভাঙা শিল্প এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশও সংকটের মুখে৷ জাহাজের বর্জ্য পানি এবং মাটির ক্ষতি করছে৷ শব্দদূষণ ও কম্পন পরিবেশের ক্ষতি করছে৷ লোহার প্লেট কাটা, লোড-আনলোড এবং জাহাজের কাটা অংশ তীরে টেনে আনার সময় শব্দ দূষণ হয়, যা এলাকার বাসিন্দারদের জন্য নানা সমস্যার সৃষ্টি করছে৷ শব্দদূষণে শিশু ও বৃদ্ধরা আতঙ্কিত হন৷ এতে করে স্কুল-কলেজের পাঠদান ব্যাহত হয়৷ প্রায়ই শিপ ইয়ার্ডে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হয়, যাতে এ ভূকম্পন ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়৷ ইপসা এক জরিপ চালিয়ে দেখেছে, এই এলাকায় প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নেওয়ার জন্য জাহাজ ভাঙার দূষণ বহুলাংশে দায়ী৷ ইপসার কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলি শাহীন বলেন, ‘‘এর জন্য মনিটরিং প্রয়োজন৷ পরিবেশ অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সব সংস্থার দায়িত্ব পালন করতে হবে৷ তবে সমস্যা হচ্ছে, জাহাজ শিল্প ভাঙা শিল্পের মালিকদের মাইন্ডসেটের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না৷ সরকার কিছুটা সক্রিয় হয়েছে, কিছু নীতিমালা তৈরি হয়েছে৷ কিন্তু এই পর্যন্তই৷''
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক হারুন অর রশীদ খান বলেন, ‘‘আসলে মালিকরা এখন আইনের সুযোগ নিচ্ছে৷ কয়েকটি মন্ত্রণালয় এখন এর সঙ্গে জড়িত হওয়ায় তারা যে কোনো এক মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে ইচ্ছেমতো কাজ করে৷ তাছাড়া ‘স্ক্র্যাপ' জাহাজ ভাঙার আগে যেমন অনুমতি লাগে, তেমনি ইয়ার্ড করার আগেও অনুমতি লাগে৷ কিন্তু সেখানেই নানা সমস্যা, যার সুযোগ নেয় মালিকরা৷ তাঁদের যোগাযোগ অনেক উপরে৷''
এ সব জাহাজগুলো আনা হয় জার্মানিসহ ইউরোপ এবং এশিয়ার অনেক দেশ থেকে৷ মালিক এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ‘‘জার্মানি ছাড়া জাপান এবং কোরিয়া থেকে জাহাজ আসে৷''
পরিদর্শক হারুন অর রশীদ খান বলেন, ‘‘ইয়ার্ডের মালিকরা জাহাজ এনে তৃতীয়পক্ষকে ভাঙার দায়িত্ব দেয়৷ দ্রুত ভাঙতে পারলেই তাদের লাভ৷ পরিবেশ বা শ্রমিক তাদের কাছে মুখ্য নয়, মুখ্য হলো লাভ৷''
কেরাণীগঞ্জের ডকইয়ার্ড
ঢাকার কেরাণীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ডকইয়ার্ড৷ সেখানে অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী পণ্যবাহী জাহাজ ও লঞ্চ মেরামত করা হয়৷ শ্রমিকরা সেখানে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন৷ আছে শিশু শ্রমিকও৷
ছবি: DW/M. Mamun
বুড়িগঙ্গার তীরে
ঢাকার কেরাণীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে দীর্ঘ দিনের পুরনো ডকইয়ার্ড৷ বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে প্রায় দেড় কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এখানে পঞ্চাশটিরও বেশি জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
চলছে মেরামতি
কেরাণীগঞ্জের ডকইয়ার্ডে অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী পণ্যবাহী জাহাজ ও লঞ্চ মেরামত করা হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
বরিশালেও গড়ে উঠেছে
অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী বড় আকারের লঞ্চগুলোর বড় একটা অংশ তৈরি হয় কেরাণীগঞ্জের ডকইয়ার্ডে৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে বরিশালেও কয়েকটি ডকইয়ার্ড গড়ে উঠেছে৷ সেখানেও এখন তৈরি হয় বড় বড় যাত্রীবাহী লঞ্চ৷
ছবি: DW/M. Mamun
তৈরি হচ্ছে পণ্যবাহী জাহাজও
শুধু যাত্রীবাহী লঞ্চই নয়, কেরাণীগঞ্জে তৈরি হয় বড় আকারের পণ্যবাহী জাহাজও৷
ছবি: DW/M. Mamun
নির্মাণ খরচ কম, কারণ...
কেরাণীগঞ্জের ডকইয়ার্ডে তৈরি জাহাজগুলোতে ব্যবহৃত প্লেটের অধিকাংশই পুরনো৷ এ সব পুরনো স্টিল আসে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী এলাকার পুরনো ভাঙা জাহাজ থেকে৷ পুরনো স্টিল ব্যবহারের ফলে দেশে তৈরি এসব জাহাজ তৈরিতে খরচও হয় তুলনামূলক কম৷
ছবি: DW/M. Mamun
মরিচা পরিষ্কার
পুরনো জাহাজের বডি থেকে মরিচা সরাচ্ছেন শ্রমিকরা৷ দেশের বিভিন্ন নদীর জল নোনা হওয়ায় এ সব জাহাজে মরিচা ধরে যায় দ্রুত৷ প্রতিবছর তাই এ সব জাহাজ থেকে মরিচা সরিয়ে রং করতে হয় নতুন করে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভাসমান অবস্থায় মেরামত
ভাসমান অবস্থায় একটি কার্গো জাহাজে মেরামতের কাজ হচ্ছে৷ জাহাজের উপরের অংশে মেরামতের প্রয়োজন হলে সেটা ভাসমান অবস্থায়ই সম্পন্ন করা হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
দেশেই তৈরি হচ্ছে প্রপেলর
এটি জাহাজের প্রপেলর তৈরির একটি ওয়ার্কশপ৷ জাহাজে ব্যবহৃত এসব বড় বড় প্রপেলর এক সময়ে বিদেশ থেকে আনা হতো৷ তবে এগুলো এখন দেশেই তৈরি হওয়ায় খরচ পড়ে অর্ধেকেরও কম৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুরনো ভেঙে নতুন
প্রপেলর তৈরির জন্য ভাঙা হচ্ছে পুরনো প্রপেলর৷ এসব পিতল গলিয়েই এখানে তৈরি করা হয় জাহাজ চলাচলের অত্যাবশ্যকীয় এ যন্ত্রটি৷
ছবি: DW/M. Mamun
পরিবেশ দূষণ
খোলা আকাশের নীচেই গলানো হচ্ছে প্রপেলর তৈরির পিতল৷ এখানকার চুলায় ব্যবহৃত হয় মূলত পোড়া মোবিল৷ এসব চুলা থেকে নির্গত হয় অস্বাভাবিক কালো ধোঁয়া, যা এলাকার পরিবেশ দূষিত করে৷
ছবি: DW/M. Mamun
শিশু শ্রমিক
একটি প্রপেলর ওয়ার্কশপে কাজ করছে ১২ বছর বয়েসি মোহাম্মদ আশরাফুল৷ তার মতো আরো অনেক শিশুকেই ডকইয়ার্ডে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে দেখা যায়৷ আশরাফুল জানায়, সকাল ৯টা থেকে রাত নটা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে৷ সপ্তাহে অবশ্য একদিন ছুটি পায় সে৷ মাসে বেতন ছয় হাজার টাকা৷
ছবি: DW/M. Mamun
নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা
কেরাণীগঞ্জের ডকইয়ার্ডে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য নেই কোনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম৷ শ্রমিকরা জানেনও না এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কিছু নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরিধান করার বিধানের কথা৷ মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনায়ও পড়েন অনেকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুরনো সরঞ্জামের দোকান
কেরাণীগঞ্জের ডকইয়ার্ড এলাকায় জাহাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন পুরনো সরঞ্জামের দোকান এটি৷ এখানে তৈরি হওয়া জলযানগুলোতে ইঞ্জিন থেকে শুরু করে বেশিরভাগ সরঞ্জামই পুরনো৷ চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী এলাকার স্ক্র্যাপ জাহাজের মালামালই এই শিল্পের সবচেয়ে বড় যোগানদার৷
ছবি: DW/M. Mamun
এখনও পুরনো পদ্ধতি
জাহাজে রং করায় ব্যস্ত শ্রমিক৷ জাহাজগুলোতে এখনো পুরনো পদ্ধতিতে রং করা হয়৷ অন্যান্য কাজের মতো এ কাজেও শ্রমিকদের শারীরিক ঝুঁকি আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
14 ছবি1 | 14
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷