‘জিআই নিয়ে আমাদের আইনটা খুবই অসম্পূর্ণ’
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মাসউদ ইমরান মান্নু জিআই সংক্রান্ত অনেক বিষয়েই কথা বলেছেন ডয়চে ভেলের সঙ্গে...
ডয়চে ভেলে : ‘জিআই' বলতে কী বোঝায়? এর ধারণা কীভাবে এসেছে?
অধ্যাপক মাসউদ ইমরান মান্নু : জিআই বলতে আসলে বোঝায় জিওগ্রাফিক ইন্ডিকেশন৷ এর বাংলা হচ্ছে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য৷ অর্থাৎ, একটি পণ্যকে ভৌগোলিকভাবে চিহ্নিত হতে হবে৷ একেকটি পণ্য অনেক স্থানে উৎপাদিত হলেও, মানুষ বোঝার চেষ্টা করে এর আসল রূপ কোনটি? পণ্যের ব্যাপারে কপিরাইট বা স্বত্বের প্রশ্নও চলে আসে৷ কে এই অধিকার ভোগ করবে? আবিষ্কার বা ঐতিহ্যের অধিকার কার হবে? কীভাবে অন্যায্য প্রতিযোগিতা বন্ধ করা যাবে সেই কনভেনশন এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে৷ পরবর্তী সময়ে এই ব্যাপারগুলো দেখাশোনা করে ডাব্লিউআইপিও বা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গ্যানাইজেশন৷ এই প্রতিষ্ঠান যে কোনো পণ্যর জন্য কোনো দেশকে একক বা যৌথভাবে জিআই প্রদান করে৷ গত শতাব্দীর বিশের দশকে ইউরোপে প্রথম এর ভাবনা আসে কোনো একটি পণ্য বা সংস্কৃতির অথেনটিক বা বিশুদ্ধ অবস্থার সন্ধানের জন্য৷
জিআই-এর প্রয়োজন হলো কেন? যে কোনো জিনিস তো যে কেউ উৎপাদন করতে পারেন?
প্রয়োজন হলো এই কারণে যে, এর একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডার৷ প্রথম একটি পরিবার বিক্রি করতে শুরু করে৷ সেটা দেখেই অনেকে এই ব্যবসা শুরু করেন৷ এখন কুমিল্লা শহরে নানা নামে প্রায় সাড়ে ৪শ'র বেশি মাতৃভাণ্ডার আছে৷ অর্থাৎ, মূল যিনি বানালেন তার স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না৷ যদি তার স্বার্থরক্ষা করা যেতো, তাহলে আসল জিনিসটা রাখা যেতো৷ একই ফর্মুলা নিয়ে বানাচ্ছেন অন্যরা, কিন্তু একই টেস্ট হচ্ছে না৷ এজন্যই লিগ্যাল প্রোটেকশন তৈরি করা জরুরি৷ কারণ, এটা একটা মেধাস্বত্ব৷
কোনো দেশকে যদি কোনো পণ্যের জিআই দেওয়া হয়, তাহলে অন্য দেশ কি সেই পণ্য উৎপাদন করতে পারবে না?
পারবে৷ কিন্তু এর জন্য সেই দেশ থেকে কপিরাইট নিতে হবে৷ মনে রাখতে হবে, জিআই নেই মানে আমরা ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস হারাচ্ছি৷ এখন যে টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে৷ অনেকে বলছেন, আমরা টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই পেয়ে গেছি৷ আসলে আমরা এখনও পাইনি৷ প্রোসিডিরওটা হচ্ছে, আমরা যদি কোনো কিছুর জন্য দাবি করি, তাহলে ন্যূনতম তিন মাস সময় লাগে, যদি কেউ আপত্তি না করে৷ আর আপত্তি করলে আরো বেশি সময় লাগে৷ কেউ আপত্তি না করলে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে ৬ মাস সময় লেগে যায়৷ এখন ভারত দাবি করেছে, টাঙ্গাইলের শাড়ি হুলিয়াডাঙ্গার৷ এখানে কিন্তু একটা শেয়ার কালচার আছে৷ ইউরোপে এই সংকটা হয়েছিল৷ তখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেটা করেছিল, সেটা হলো শেয়ার কালচার৷ অনেকগুলো দেশ একই ধরনের পণ্য উৎপাদন করে৷ সে তার আইনের ভেতরে সবগুলো দেশকে নিয়ে এসেছে৷ আমরাও যদি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ায় যেতে পারতাম তাহলে অনেক সমস্যার সামাধান হয়ে যেতো৷ এটা এমন নয় যে, এক দেশ জিআই নিয়েছে, এই কারণে আরেক দেশ পাবে না৷ যেমন, ধরেন আমাদের সিলেটের শীতল পাটি জিআই পেয়েছে৷ আবার দেখেন, ঝালকাঠিতেও শীতল পাটি হয়৷ সেটাও কিন্তু ঝালকাঠির শীতল পাটি হিসেবে জিআই পেতে পারে৷
রসগোল্লা ও নকশিকাঁথাসহ যেসব পণ্যের জিআই আমরা হারিয়েছি, সেগুলো কি আবার ফিরে পাওয়ার সুযোগ আছে?
এই কথাটার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করি৷ আমরা বলছি, হারিয়েছি, বিষয়টা এমন না৷ এর প্রতিটি আমরা দাবি করতে পারি৷ সম্প্রতি আমরা গোপালগঞ্জের রসগোল্লার জন্য দাবি করেছি৷ এটা কিন্তু গোপালগঞ্জের রসগোল্লা৷ আবার ধরেন নকশিকাঁথা, আমরা যদি জামালপুরের বা মানিকগঞ্জের নকশিকাঁথা নাম দিয়ে দাবি করি, তাহলে সেটা পেতে পারি৷ এটা আসলে হারিয়ে ফেরার বিষয় না, সতর্ক হওয়ার বিষয়৷ আর মূল বিষয়টা হলো, আমাদের আইনটা খুবই অসম্পূর্ণ একটা আইন৷ খুবই হেলাফেলাভাবে এটা করা হয়েছে৷
জিআই নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো কতটা সোচ্চার, আর আমরা আসলে কতটা তৎপর?
জিআই নিয়ে আমরা একেবারেই সচেতন ছিলাম না৷ আমরা টিআরআইপিএসের অ্যাগ্রিমেন্টে সই করেছি ১৯৯৫ সালে৷ ঠিক একই বছর ভারতও এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে৷ অথচ দুই দেশ এই নিয়ে পুরো উলটো আচরণ করলো৷ ভারত পরের বছরই নিজেদের দেশে জিআই আইন প্রণয়ন করলো, এই নিয়ে বিপুল গবেষণা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন পণ্যে জিআই দাবি করতে লাগলো৷ অন্যদিকে আমরা যেন ঘুমিয়ে পড়লাম৷ আমাদের সরকার ব্যাপারটি বেমালুম ভুলে গেল৷ অবশেষে আমরা ২০১৩ সালে আইন প্রণয়ন করি আর এর প্রথম বাস্তবায়ন হয় ২০১৭ সালে৷ ততদিনে ভারত অনেকটাই এগিয়ে গেছে৷ ভারত সেই সময়ের মধ্যে ১০৮টা পণ্যের ওপর জিআই অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলে৷ ২০১৩ সালে আমরা কেন আইনটা করলাম, কারণ, ২০১১ সালে ভারত জামদানির জিআই দাবি করে ফেললো৷ তখন আমাদের মনে হলো, আইনের কথা৷ আমাদের সরকার মাত্র তিনটি জিনিস নিয়ে কাজ করেছে৷ ইন্টেকলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটসের মধ্যে তিনটি ব্যাপার আমাদের আছে, ট্রেডমার্ক, কপিরাইটস আর পেটেন্ট৷ এগুলো দেখার দায়িত্ব কার সেটাও এখনও ঠিক নয়৷ এটা আমাদের আইনেও নেই৷
জিআই নিয়ে গবেষণা কতটা জরুরি? আর গবেষণা হচ্ছে কতটা?
আমরা যখন জিআই বলি, তখন আমাদের বুঝতে হবে যে, এটা কালচারাল হেরিটেজের একটা পার্ট৷ আমাদের দেশে পড়াশোনার কোথাও লিভিং কালচারাল হেরিটেজ বলে কিছু পড়ানো হয় না৷ এটা এখনও কেউ ভাবছে না৷ এটার জন্য আমাদের ইনভেনটরি বানাতে হবে৷ সরকার ইনভেনটরি বানানোর চেষ্টাই করেনি৷ ইনভেনটরি মানে এই না যে, কোন জেলায় কী আছে? ইনভেনটরি হলো প্রোসিডিওর৷ এটা করতে হলে কালচারাল স্টাডি ভালো করে জানতে হবে৷
এই মুহূর্তে সরকারের করণীয় কী? সরকার কী সেই কাজটা করছে?
করছে কিনা সেটা আমি জানি না৷ কারণ, আমি তো আর সরকারের কোনো পর্যায়ে যুক্ত নেই৷ তবে যেটা করণীয়, সেটা হলো আন্তঃমন্ত্রণালয় ও বিভাগের একটা সমন্বয় জরুরি৷ এই বিষয়ে জানাশোনা আছে এমন ব্যক্তিদের নিয়ে কাজটা করা দরকার৷ কালচারাল হেরিটেজটা, কিন্তু কিন্তু কমনসেন্স দিয়ে হবে না, এর জন্য জানাশোনা থাকতে হবে৷ এখন আমাদের আইনটাকে সংশোধন করা দরকার৷ পাশাপাশি একটা জাতীয় কমিটি করতে হবে৷ তারা আসলে সমন্বয়টা করবে৷ এই কমিটির প্রথম কাজ হবে দেশব্যাপী একটা ইনভেনটরি তৈরি করা৷
বেসরকারি পর্যায়ে কি কোনো কাজ হচ্ছে?
আমার জানা মতে, না৷ শুধুমাত্র ২০১১ সালে যখন ভারত জামদানি শাড়ির জিআই লাভ করে, তখন সিপিডি নিজের উদ্যোগে এই নিয়ে মামলা করেছিল৷ তখন তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, আমাদের ঢাকাইয়া জামদানি আর টাঙ্গাইলের জামদানির সঙ্গে ভারতীয় জামদানির তফাৎ আছে৷ প্রমাণ দেওয়ার পর আমরা জামদানির কপিরাইট ফেরত পাই৷ বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে জামদানির অধিকার পায়, অন্যদিকে ভারতের থাকে কেবল ফুলিয়া জামদানি নামে বিশেষ পণ্যের৷ এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে আর কোনো উদ্যোগ দেখিনি৷
জিআই-এর স্বীকৃতি না থাকলে আমাদের কবে নাগাদ, কী ধরনের সংকট হতে পারে?
ডাব্লিউআইপিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ২০২৫ সাল থেকে এইসব ব্যাপার কড়াকড়িভাবে আরোপ করা হবে৷ কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তা পিছিয়ে ২০৩০ সালে নেওয়া হয়েছে৷ আবার এই আইন মধ্য আয়ের দেশের জন্য যতটা কড়াকড়ি, ততটা স্বল্প আয়ের দেশের জন্য নয়৷ যেহেতু আমরা নিজেদের মধ্য আয়ের দেশ দাবি করছি, জিআইসহ অন্যান্য কপিরাইটের ব্যাপারে আমাদের কড়াকড়িভাবে আইন মানতে হবে৷