জিকা ভাইরাসের সঙ্গে স্নায়বিক রোগ ‘গিয়াঁ-বারে সিনড্রোম' বা জিবিএস-এর সম্পর্ক সংক্রান্ত তথপ্রমাণ জড়ো করছেন বিজ্ঞানীরা৷ এখন পর্যন্ত যা জানা যাচ্ছে, তাতে স্নায়বিক রোগের পেছনে জিকার ভূমিকা খুব বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞানীরা মঙ্গলবার জানিয়েছেন, জিকা ভাইরাসের সঙ্গে সম্ভবত বিরল এক স্নায়বিক রোগের সম্পর্ক আছে৷ ধারণা করা হচ্ছে, মশাবাহিত রোগ জিকা যেসব অঞ্চলে ছড়িয়েছে সেসব অঞ্চলে স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে৷
২০১৩ এবং ২০১৪ সালে ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ায় জিকা ভাইরাস ছড়িয়েছিল৷ সেসময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে ফরাসি বিজ্ঞানীরা জিবিএস বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি শনাক্ত করেন৷ জিবিএস হলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে৷
জিকা ভাইরাস সম্পর্কে আপনার যা জানা উচিত
বর্তমানে আলোচিত এক ভাইরাস ‘জিকা’৷ ভারত, পাকিস্তানে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেলেও বাংলাদেশ এখনও এ থেকে মুক্ত৷ তবে সতর্ক থাকতে হবে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/F. Dana
লক্ষণ
জ্বর, ব়্যাশ (চামড়ায় লাল ফুসকুড়ি), গোঁড়ালিতে ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া – জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাধারণত এ সব লক্ষণ দেখা দেয়৷ এছাড়া পেশীতে ও মাথায়ও ব্যথা হতে পারে৷ জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Almeida
নামকরণের ইতিহাস
‘জিকা’ নামটি নেয়া হয়েছে উগান্ডার জিকা বন থেকে৷ ১৯৪৭ সালে হলুদ জ্বর নিয়ে গবেষণার সময় বিজ্ঞানীরা জিকা বনে একটি খাঁচায় একটি বানর রাখে৷ পরে বানরটি জ্বরে পড়লে তার দেহে একটি সংক্রামক এজেন্টের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়৷ ১৯৫২ সালে এর নাম দেয়া হয় জিকা ভাইরাস৷ এরপর ১৯৫৪ সালে নাইজেরিয়ায় এক মানুষের দেহে এই ভাইরাস পাওয়া যায়৷
ছবি: Reuters/R. Paiva
যেসব দেশে ছড়িয়েছে
২০১৫ সাল নাগাদ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ ও মধ্য অ্যামেরিকার কয়েকটি দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে৷ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন নাগরিকের শরীরেও এই ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে৷
যেভাবে ছড়ায়
এডিস ইজিপ্টি নামের মশার কামড়ের মাধ্যমে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে৷ ফলে মশার কামড় থেকে বাঁচার যে উপায়গুলো আছে সেগুলো মেনে চললেই এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচা যাবে৷
ছবি: picture-alliance/J. Gathany/Centers for Disease Control and Prevention via AP
গর্ভবতী নারীরা বেশি সাবধান!
সম্প্রতি একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না গবেষকরা৷ তাঁদের কারও মত হচ্ছে, কয়েকটি দেশে শিশুদের ‘মাইক্রোসেফালি’ রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত গর্ভবতী মা৷ এই রোগ হলে শিশুদের মস্তিষ্কের গঠন ঠিকমতো হয় না, ফলে শিশুর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়া, শারীরিক বৃদ্ধি অস্বাভাবিক বা বিলম্বিত হওয়া থেকে শুরু করে অকালে মারা যাওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়৷ বৈজ্ঞানিকভাবে অবশ্য এটি এখনও প্রমাণ করা যায়নি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/F. Dana
ভ্যাকসিন নেই
এই রোগের চিকিৎসায় এখনও কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি৷ ফলে সতর্ক থাকাটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ৷ অবশ্য এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা বিরল৷
ছবি: Reuters/J. Cabezas
6 ছবি1 | 6
চিকিৎসা সাময়িকী ‘দ্য ল্যাসেট'-এ বিজ্ঞানীদের এই গবেষণা প্রকাশ হয়েছে৷ তাঁরা ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়ার ৪২ জন রোগীকে নিয়ে কাজ করেছেন, যাঁদের ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে জিবিএস হয়েছিল৷ দেখা যায়, তাঁদের প্রত্যেকে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল এবং ৯৩ শতাংশের জিকা হওয়ার তিনমাসের মধ্যেই জিবিএস ধরা পড়েছিল৷
ফরাসি বিজ্ঞানী আর্নো ফন্তানে জানান, জিকার সঙ্গে জিবিএস-এর সম্পর্কটা এতটাই শক্ত যে ফুসফুসে ক্যানসারের সঙ্গে তামাকের সম্পর্কের সাথে তার তুলনা চলে৷
সাধারণত জিবিএস বা ‘গিয়াঁ-বারে সিনড্রোম'-এ আক্রান্তদের মধ্যে পাঁচ শতাংশের মৃত্যু হয়৷ তবে অনেকে কয়েকসপ্তাহ বা কয়েকমাস পর্যন্ত মারাত্মক অসুস্থ থাকেন৷ ফন্তানে বলেন, জিকা মহামারীতে আক্রান্ত এলাকাগুলোতে ‘ইনটেনসিভ কেয়ারের' সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি আমাদের বিবেচনা করা উচিত৷
প্রসঙ্গত, বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে জিকার সঙ্গে মাইক্রোসেফেলির, যার ফলে শিশুর মাথার আকার অস্বাভাবিক এবং ছোট হয়, সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন৷ ব্রাজিলে গত অক্টোবর থেকে এখন অবধি ছয়'শ শিশুর জন্ম হয়েছে, যাদের মাথা স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট৷ জিকার সঙ্গে অন্যান্য রোগের এই সম্পর্কের লক্ষণ প্রকাশ হওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে৷
এআই/ডিজি (এএফপি, এপি, রয়টার্স)
জিকা ভাইরাস ছড়ানো মশা মারতে মাছ ও ব্যাঙ
দক্ষিণ অ্যামেরিকায় জিকা ভাইরাসের ‘ভেক্টর’ প্রতিরোধে নানা ধরনের পন্থা নেওয়া হচ্ছে – তাদের অধিকাংশই প্রকৃতিদত্ত অথবা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে সৃষ্ট৷ লক্ষ্য হলো, মশার লার্ভা বা কীট বিনষ্ট করে মশা কমানো৷
ছবি: Reuters/U. Marcelino
মশককীট খেকো মাছ
এল সালভাদর-এর সান দিয়েগো সৈকতে কিশোররা জাম্বো নামের এক ধরনের মোটা স্লিপার মাছ ধরে আনে৷ পরে জল রাখার পিপেয় এই জাম্বো মাছ ছেড়ে দিলে, সেই মাছ মশার লার্ভে বা কীটগুলোকে খেয়ে ফেলে৷ ‘এডিস এজিপ্টাই’ মশার কামড় থেকেই জিকা ভাইরাস ছড়ায়৷ (ছবিতে ব্রাজিল-এর একটি মিষ্টি জলের মাছকে দেখা যাচ্ছে)৷
ছবি: Matheus Volcan
মশা দিয়ে মশা মারা
জিকা ভাইরাস মায়ের পেটের ভ্রুণে মাইক্রোসেফালি রোগের অবতারণা ঘটায়, যা থেকে নবজাতকের মস্তক ও মস্তিষ্কের বিকাশ স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট হয়৷ নয়ত জিকা ভাইরাসের জ্বর প্রাণঘাতী নয়৷ কলম্বিয়া আর ব্রাজিলেই জিকা ভাইরাসের প্রকোপ আপাতত সবচেয়ে বেশি৷ কলম্বিয়ার আন্তিয়োকিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা মশকদের মধ্যে ওলবাখিয়া নামের একটি জীবাণু ছড়ানোর চেষ্টা করছেন, যার ফলে এডিস মশা মানুষকে সংক্রমিত করতে পারবে না৷
ছবি: Imago
মশাখেকো ব্যাঙ
যেখানে বিপদ, সেখানেই ব্যবসা ফাঁদার সুযোগ ও সম্ভাবনা৷ তাই আর্জেন্টিনায় সাত ডলার দরে ব্যাঙ বিক্রি হচ্ছে – সেই ব্যাঙ নাকি মশার বংশ ধ্বংস করে মানুষজনকে এডিস আর জিকার হাত থেকে বাঁচাবে৷ এ কাজে ব্যাঙ নাকি মশা তাড়ানোর ক্রিমের চেয়ে বেশি কার্যকর৷
ছবি: picture alliance/WILDLIFE/P. Oxford
অরগ্যানিক কীটনাশক
‘এডিস এজিপ্টাই’ মশা শুধু জিকা নয়, ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস ও চিকুঙ্গুনিয়া জ্বরের ভাইরাসও বহন করে৷ এই মশার কীট ধ্বংসের জন্য পেরুতে কোকো, ইউকা, অ্যাসপারাগাস আর আলু মিশিয়ে একটি ‘বায়োলার্ভিসাইড’ বা অরগ্যানিক কীটনাশক তৈরি করা হচ্ছে৷
ছবি: AP
তেজস্ক্রিয়তা দিয়ে মশার প্রজনন ক্ষমতা রোধ
ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে৷ মূল ধারণাটা হলো, মশকদের উপর রশ্মি বিকিরণের ফলে পুরুষ মশারা নিষ্ফলা হয়ে পড়বে, কাজেই নারী মশারা ডিম পাড়তে পারবে না৷
ছবি: Kerry Skyring
ধোঁয়া দিয়ে মশা তাড়ানো
এককালে গোয়ালঘরে যা করা হতো, জিকা-ডেঙ্গুর তাড়নায় সেই পুরনো পদ্ধতিই এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে যখন অধিকাংশ দেশেই ডিডিটি ছড়ানো নিষিদ্ধ৷ মুশকিল এই যে, ধোঁয়া দিয়ে মশা তাড়ানো গেলেও, মশার ডিম ও কীট অক্ষত থেকে যায়৷