ধর্ষণের নগরী দিল্লি নয়, ঘটনাটা ঘটে মাতৃতান্ত্রিক কেরালার পেরুমবাভুরে৷ ৩০ বছর বয়সি এক নারীকে প্রথমে ধর্ষণ, তারপর কুপিয়ে খুন করা হয়৷ অন্ত্র, পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিরে দেয়া হয় তাঁর যৌনাঙ্গ, নৃশংসভাবে৷
বিজ্ঞাপন
মেয়েটির নাম জিশু৷ বড় অভাবের সংসার ছিল তাঁর৷ মায়ের সঙ্গে একটা এক কামরার বাড়িতে থাকতেন, এর্নাকুলাম কলেজে পড়াশোনা করতেন আইন নিয়ে৷ গত বৃহস্পতিবার সেই এক-কামরার বাড়ির মধ্যেই সন্তানের ক্ষতবিক্ষত দেহ আবিষ্কার করেন জিশুর মা৷
ঘটনার বীভৎসতা সামনে আসার পর, ২০১২ সালে ঘটে যাওয়া নির্ভয়া ধর্ষণকাণ্ডের সঙ্গে এর একটা তুলনা টানা হচ্ছে৷ মর্মান্তিক এই দুই মৃত্যুর মধ্যে কোথায় যেন একটা ‘মিল' খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে৷ কিন্তু কই? নির্ভয়ার কষ্টে যেভাবে আমরা ভারতকে, ভারতবাসীকে দরদি হয়ে উঠতে দেখেছিলাম, জিশুর জন্য তাদের হাহাকার কেন আলোড়ন তুলছে না সমাজে? কেন ঘটনার পাঁচদিন পরেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারছে না পুলিশ? কেন এখনও পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাত্র দু'জনকে আটক করেছে তারা?
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা গেছে, ঘটনার সময় পরিষ্কার দিনের আলো ছিল৷ পুলিশের সন্দেহ, প্রতিবেশীরা নিশ্চয় আওয়াজও শুনেছেন৷ তাহলে? তাহলে পুলিশ সেই প্রতিবেশীদের জেরা করছে না কেন? জিশু দলিত বলে? নাকি জিশুকে নির্ভয়ার তুলনায় কম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল?
না, প্রতিবাদ যে একেবারে হয়নি, তা নয়৷ রাজধানী তিরুবনন্তপুরমে সচিবালয়ের সামনে মঙ্গলবার সকাল থেকেই তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়েছে৷
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও #JuticeForJishu (জাস্টিসফরজিশু) – এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে অগুন্তি মানুষ দলিত এই যুবতীর হত্যার প্রতিকার দাবি করেছেন৷ তারপরও নির্ভয়ার জন্য ভারতব্যাপী যে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছিল, তার তিলমাত্র এবার দেখা যায়নি৷ অন্তত এখনও যায়নি৷ মোমবাতি হাতে রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেনি আবালবৃদ্ধবনিতা৷
অবশ্য একটা উপায় আছে৷ আগামী দু'সপ্তাহের মধ্যেই কেরালায় নির্বাচন৷ তাই দলিত জিশুর নির্মম খুনকে মন্ত্রী-আমলা সকলেই হয়ত এবার ঠিক এইভাবে কাজে লাগাতে চাইবে৷ আর আসন্ন নির্বাচনের পটভূমিতে বেশ একটা আলাদা রাজনৈতিক মাত্রাও পেয়ে যাবে এই ধর্ষণকাণ্ড৷
কিন্তু এতে করে কী বিচার পাবে জিশু? নির্ভয়া চলে যাওয়ার এতগুলো বছর পরও যে দেশে পুলিশ-প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে একটার পর একটা ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, যৌন নির্যাতনের ঘটে, সে দেশে শুধুমাত্র মানবিকতার খাতিরে প্রয়োজনে সরকারের দিকে কি আঙুল তুলতে পারবে সুশীল সমাজ?
ভারতের সুশীল সমাজ কি পারবে জিশু হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷
কেন এত ধর্ষণ? কী করলে কমবে এ জঘন্য অপরাধ?
নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তৃতা, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? বা ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিত?
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়৷ এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Fotolia/DW
উন্নত বিশ্বের নারীরাও রেহাই পান না
ধর্ষণ শব্দটি শুনলেই মনে হয় এ ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ এমনকি জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ধর্ষিতা নারীরা জানাতে ভয় পান
জার্মানিতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে ‘মেডিকেল টেস্ট’-এর ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন৷ তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে তথ্য জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন৷ অনেকদিন লেগে যায় ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে৷
ছবি: detailblick/Fotolia
ধর্ষককে ধরার জন্য দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা
ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয় – এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ধর্ষণের পর একা না থেকে কারো সাথে কথা বলা৷ গোসল, খাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে না যাবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো৷ এ পরীক্ষা করালে ধর্ষক কোনো অসুখ বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব৷ নারীর শরীরে নখের আচড় বা খামচি থাকলে ধর্ষকের চিহ্ন সহজেই পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. Ruettinger
যাঁরা ধর্ষণের শিকার, তাঁদের জন্য জরুরি বিভাগ
ধর্ষক যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, অর্থাৎ অন্তর্বাস, প্যাড এ সব তুলে রাখুন৷ ছবিও তুলে রাখতে পারেন৷ নিজেকে দোষী ভাববেন না, কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে – সেই অপরাধী, আপনি নন৷ জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে৷ তাছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে রয়েছে ‘গেভাল্ট গেগেন ফ্রাউয়েন’, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই টেলিফোন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গ্রুপ থেরাপি
যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানিতে রয়েছে গ্রুপ থেরাপি, যার সাহায্যে নারীরা আবার সমাজে সহজভাবে মিশতে পারেন এবং তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সহজে ভুলে যেতে পারেন৷
ছবি: dpa
সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধ হয় বাড়িতেই
ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২২ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে৷ তাই আদালতের নির্দেশে ভারতের পুলিশ বিভাগ এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দিল্লির ৪৪টি এলাকায়৷ চলতি বছরের গত আট মাসে ২,২৭৮টি ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌন অপরাধের তদন্তের ফলাফলে দেখে গেছে: ১,৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোকজন এবং পরিচিতজনেরা৷ অর্থাৎ নিজের বাড়িতেও মেয়েরা নিরাপদ নয়!
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
সঠিক বিচার চাই
২০১৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লিতে গণধর্ষণ ঘটনার পর, ভারতে ঘটা করে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসিয়ে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ দমনে আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হয়৷ শাস্তির বিধান আরো কঠোর করা হয়৷ কিন্তু তাতে যৌন অপরাধের সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে৷
ছবি: picture alliance/abaca
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার
বাংলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ছ’মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ করে ধর্ষণ এবং পরে হত্যার ঘটনাও অনেক বেড়েছে৷
ছবি: DW
নারীর পোশাকই কি ধর্ষণের জন্য দায়ী?
বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়াভাবে, বেপর্দায় চলাফেলার কারণে ধর্ষণের শিকার হন৷’’ পুলিশের কর্মকর্তার দাবি, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বখাটে ছেলেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷’’ এ কথা শুধু পুলিশ কর্মকর্তার নয়, ভারত-বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাই এরকম৷ ধর্ষণ বন্ধ করতে এই মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
ছোট বেলা থেকে সচেতন করতে হবে
ধর্ষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা দিলে স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে৷ তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷ ধর্ষিতা নারীকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়, সে সম্পর্কেও সচেতনতা দরকার৷ অনেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ গোটা সমাজও নারীকেই দোষ দিয়ে থাকে৷ ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ৷