সরকারে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে আর কার্যাদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে৷এই দুটি শাখায় দুর্নীতি না থাকলে সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি একেবারে ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব৷
বিজ্ঞাপন
জিয়াউর রহমানেরসামরিক ফরমান সর্বোচ্চ আদালতে নিষিদ্ধ হলেও তার প্রবর্তিত পন্থাতেই নিয়োগে দুর্নীতির সুযোগ রাখা হয়েছে৷
খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক সিনিয়র জেলা জজ মঈদুল ইসলাম ৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক সমকালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলছেন, ‘‘নিয়োগ দুর্নীতির ঘটনাগুলোয় দুদকের অনুসন্ধান-তদন্তে পাওয়া গেছে বেপরোয়া আচরণের ভয়াবহ চিত্র৷ পছন্দের প্রার্থীকে তুলে আনতে নম্বর বাড়াতে বেহুঁশ হয়ে ১০ মানের প্রশ্নের উত্তরে দেওয়া হয়েছে ১২ নম্বর; কেউ কেউ আবার আরেক কাঠি ওপরে সাদা খাতাতেই নম্বর দিয়ে রেখেছে যেখানে আউটসোর্সিং করে (চুক্তিভিত্তিক) অন্য প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে পরীক্ষা নিয়েছে, সেখানেও কম্পিউটারে করা হয়েছে কারসাজি, জালিয়াতি৷অফিস-আদালতগুলোর বাজেটের কোটি কোটি টাকা ব্যয় তো আছেই৷’’
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার পাঁচ কৌশল
বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইন্ডিকেটরস গ্রুপ’-এর পরিচালক আওগুস্তো লোপেজ-কার্লোস এক ব্লগ পোস্টে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার কয়েকটি কৌশল আলোচনা করেছেন৷ ছবিঘরে থাকছে সে’সব কথা৷
ছবি: Getty Images
সরকারি চাকুরেদের জন্য ভালো বেতন
যাঁরা সরকারি চাকরি করেন তাঁদের বেতন যদি খুব কম হয়, তাহলে আয় বাড়াতে তাঁরা ‘অনানুষ্ঠানিক’ পথ অবলম্বন করতে পারেন৷ বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সরকারি চাকুরেদের কম বেতন ও দুর্নীতির মধ্যে সম্পর্ক পাওয়া গেছে৷
ছবি: DW
অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা
যে সমস্ত দেশের নাগরিকদের সরকারি কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার সুযোগ আছে সেসব দেশে দুর্নীতি কম হয়৷ অর্থাৎ যেখানে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, শিক্ষিতের হার বেশি এবং সক্রিয় সুশীল সমাজ রয়েছে সেখানে দুর্নীতির হার কম৷ কেননা এর ফলে বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, সরকারের নীতি নিয়ে আলোচনা করা যায়৷
ছবি: Colourbox/Hin255
লাল ফিতার দৌরাত্ম কমানো
বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিবেদন বলছে, যে সব দেশে ব্যবসা শুরু করতে, সম্পত্তি নিবন্ধন করতে, আন্তর্জাতিক ব্যবসায় জড়িত হতে নানা ধরনের সার্টিফিকেট, আইন, লাইসেন্স ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সে’সব দেশে দুর্নীতি বেশি হয়৷ তাই বিশ্বব্যাংকের এক গবেষক দুর্নীতির জন্ম দিতে পারে এমন আইনকানুন বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷
ছবি: DW
ভর্তুকি নয়
জ্বালানি খাতে ভর্তুকির নানা সমস্যা আছে৷ প্রায়ই এর সুবিধাভোগী হন ধনীরা৷ এছাড়া ভর্তুকি মূল্যে কেনা জ্বালানি চোরাচালানের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হন অনেকে৷ তাই ভর্তুকির মতো ব্যয়বহুল পদ্ধতির চেয়ে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষদের অর্থ সহায়তা দেয়া যেতে পারে৷
ছবি: DW/W.Jantschits
স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার
সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নাগরিকদের সরাসরি যোগাযোগ যত কমানো যাবে, দুর্নীতি কমানো ততই সম্ভব হবে৷ এক্ষেত্রে বিভিন্নক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সহায়তা নেয়া যেতে পারে৷ সরকারি কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনলাইনে টেন্ডার আহ্বানের মতো বিষয়াদি চালু করলে দুর্নীতির সুযোগ কমবে৷
ছবি: Getty Images
5 ছবি1 | 5
পাঠক লক্ষ্য করুন, ১০-এর মধ্যে ১২ দেওয়া বা সাদা খাতাতে নম্বর দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে৷ তৃতীয় পক্ষ বা আউটসোর্সিং করে যে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে সেখানে কম্পিউটারে কারসাজি করা হয়েছে, জালিয়াতি করা হয়েছে৷
আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগ, ইন্টারেস্টিং তাই না? মজার বিষয় হলো, দুর্নীতি দমন কমিশনও নিয়োগের ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং পদ্ধতিই প্রয়োগ করে থাকে৷ সহকারী পরিচালক বা পরিদর্শক পদে যারা নিয়াগ পান বা পেয়ে থাকেন, তাদের ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ করার একটি সুযোগ দুদক কর্তৃপক্ষের থাকে৷ কিন্তু কেন এই তৃতীয় প্রতিষ্ঠান বা আউটসোর্সিং, কেন পিএসসি নয়?
১৯৭৭ সালের ৫৭ নম্বর অধ্যাদেশে প্রতিষ্ঠিত পিএসসির দায়িত্ব সংবিধানের ১৪০(১)(ক) অনুচ্ছেদে দেওয়া 'প্রজাতন্ত্রের কর্ম', অর্থাৎ পুরোপুরি সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়াতেই সীমাবদদ্ধ৷ দুদকের মতো নির্দিষ্ট আইনে প্রতিষ্ঠিত সরকারি আর সব কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার দায়িত্ব ১৪০(১)(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেওয়ার আর ব্যবস্থা করা হয়নি তাতে৷
দুর্নীতিতে শীর্ষ ১০ দেশ
দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করে থাকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)৷ ২০১৮ সালের ধারণা সূচকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ত্রয়োদশ অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ৷ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ১০ দেশ সম্পর্কে জেনে নিন ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/U.Baumgarten
১০. লিবিয়া
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১০ম লিবিয়া৷ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি, ঘুষ আর স্বজনপ্রীতি দেশটিকে এই অবস্থানে এনেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/G. Khan
৯. আফগানিস্তান
দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে আফগানিস্তান৷ অবশ্য, বৈশ্বিকভাবে তাদের অবস্থান নবম৷ দুর্নীতির দিক থেকে আফগানিস্তানের পরেই আছে বাংলাদেশ৷
ছবি: DW/H. Sirat
৮. ইকুটেরিয়াল গিনি
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় অষ্টম অবস্থানে আছে ইকুটেরিয়াল গিনি৷ দুর্নীতির দায়ে ফ্রান্সে সাজাও খেটেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট টিওডোরো ওবিয়াং-এর ছেলে টিওডোরিন ওবিয়াং৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Lecocq
৭. গিনি বিসাউ
দুর্নীতির ধারণাসূচকে সপ্তম অবস্থানে আফ্রিকার দেশ গিনি বিসাউ৷ ২০১৪ সালে দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রকাশের সময় টিআই বলেছিল, দেশটিতে দুর্নীতির জন্য সহায়ক একটি পরিবেশ তৈরি করেছে সরকার৷ মাদক পাচারের অন্যতম আন্তর্জাতিক রুটও দেশটি৷
ছবি: DW/B. Darame
৬. সুদান
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে আছে সুদান৷ প্রাকৃতিক সম্পদ সংস্থান এবং দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে সেখানে দুর্নীতির সুযোগ আরো বেড়েছে৷
ছবি: Reuters/M. N. Abdallah
৫. উত্তর কোরিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তীব্র বিরোধের মধ্যে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে আছে উত্তর কোরিয়া৷ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত দেশটির বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ পশ্চিমা দেশগুলোর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Young-Joon
৪. ইয়েমেন
দুর্নীতির তালিকায় নিচের দিক থেকে চতুর্থ অবস্থানে আছে ইয়েমেন৷ উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত দেশও এটি৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
৩. সাউথ সুদান
২০০৫ সালে সুদান থেকে স্বাধীন হওয়া দেশটির অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ মুষ্টিমেয় ধনীদের হাতে৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ধারণা সূচকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় সাউথ সুদান আছে তিন নম্বরে৷
ছবি: Getty Images
২. সিরিয়া
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দ্বিতীয় নম্বরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া৷ ইসলামিক স্টেটকে কেন্দ্র করে নানামুখী যুদ্ধ চলছে সেখানে৷ ক্ষমতাসীন বাশার আল আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ করে আসছে পশ্চিমা দেশগুলো৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleinman
১. সোমালিয়া
২০১৮ সালের ধারণাসূচক অনুযায়ী, সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে সোমালিয়া৷ গৃহযুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ নানা সংঘাত আর দারিদ্র্য নিয়ে চলা দেশটির অনেক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করে থাকেন৷
ছবি: SIMON MAINA/AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
তাই এসব চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা পিএসসির মাধ্যমে নেওয়া যাচ্ছে না৷
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনে করা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হলে এবং সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে চতুর্থ তফসিল থেকে ওই সম্পর্কিত ৩ক ও ১৮ অনুচ্ছেদ বাদ পড়লে ওই সামরিককালের অন্যান্য অধ্যাদেশের সঙ্গে এই ৫৭ নম্বর অধ্যাদেশও কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে৷ কাজেই এখানে ১৯৭৩ সালের ২৪ নম্বর পিও পুনর্বহাল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, যাতে দুটি পিএসসির প্রথমটির মাধ্যমে বেসামরিক সব গেজেটেড সরকারি পদের এবং সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি সব স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, কর্পোরেশনসহ সব সংবিধিবদ্ধ সংস্থার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদের নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা হবে এবং দ্বিতীয় পিএসসির দায়িত্বে থাকবে এমএলএসএস পদ ছাড়া বাকি সব নন-গেজেটেড সরকারি পদের এবং সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি সব স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, কর্পোরেশনসহ সংবিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোর তৃতীয় শ্রেণির পদের নিয়োগের সুপারিশ করা৷
কিন্তু তা না করে বরং ২০১৩ সালের এক নম্বর অধ্যাদেশ ও পরে ছয় নম্বর আইন দিয়ে ১৯৭৭ সালের ৫৭ নম্বর অধ্যাদেশটিই কার্যকর করে রাখা হয়েছে; যেখানে সংবিধিবদ্ধ সরকারি সংস্থাগুলোর চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা পিএসসির আওতা থেকে একেবারেই বাদ, বাদ বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের সরকারি অফিসগুলোর যেসব পদের নিয়োগ ক্ষমতা ওইসব অফিসপ্রধানের হাতে সেসব পদও৷
পাঠক লক্ষ্য করছেন নিশ্চয়ই, জিয়াউর রহমানের সামরিক ফরমান বাতিল করা হলেও যত্ন করে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে নিয়োগের ক্ষেত্রে চালু করা তার পদ্ধতিকে, যেখানে জেনে-বুঝে সুযোগ রাখা হচ্ছে নিয়োগ দুর্নীতির বা অসমতার৷
নিয়োগে অসমতার সুযোগ নিয়ে একজন রাজনৈতিক কর্মী আমাকে বলছেন, দল করি সঙ্গে এই আশাও করি যে, দল আমাকে মূল্যায়ন করবে৷ আর নিজেদের কর্মীদের মূল্যায়নের ঘোষণা সরকারের গুরুত্বপূর্ণদের কাছ থেকে আমরা প্রকাশ্যে পাই৷
আমাদের প্রস্তাব, দলের নেতা-কর্মীদের আপনারা অবশ্যই মূল্যায়ন করুন, কিন্তু সেটা নিজেদের দলের সম্পদ দিয়েই, রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে নয়৷ এই রাষ্ট্র যেমন যারা আপনাদের জন্য ত্যাগ করেছে তাদের, তেমনি যারা আপনাদের সমর্থন করে না তাদেরও৷