প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের খেতাব ‘বীর উত্তম’ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধ কাউন্সিল৷ বঙ্গবন্ধু হত্যায় পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন- এমন কারণে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা৷
বিজ্ঞাপন
জামুকার এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘‘আমাদের কাছে পাঠালে আমরা দেখবো৷ আগে পাঠাক৷’’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমার জানা মতে এর আগে মুক্তিযুদ্ধের কোনো খেতাব বাতিলের সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি৷’’ আইনমন্ত্রী মনে করেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিল করতে নতুন কোনো আইনের প্রয়োজন হবে না৷
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমান সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ তিনি জেড ফোর্সের কামান্ডার ছিলেন৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলেই তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দেয়া হয়৷ এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব৷ এই খেতাব পেয়েছেন মোট ৬৮ জন৷ ১৯৭৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে খেতাবের তালিকায় স্বাক্ষর করেন৷
আনিসুল হক
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর এক পর্যায়ে সামরিক শাসক হিসেবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান৷ এরপর রাষ্ট্রপতি হন এবং রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করেন৷
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধ কাউন্সিল (জামুকা)-র মঙ্গলবারের বৈঠকে জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়৷ একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনি শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী ও মোসলেহ উদ্দিনের রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলেরও সুপারিশ করা হয়৷
বৈঠকে বলা হয়, জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ করায় তার খেতাব বাতিল করা হবে৷
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শাজাহান খান বলেন, ‘‘আমরা (জামুকা) জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ এখন একটা কমিটি করে দিয়েছি৷ তারা বসে সিদ্ধান্ত নেবেন যে কিভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় তা বাতিল করা হবে৷ এর সঙ্গে আরো কারো নাম আসবে কিনা তা-ও তারা দেখবেন৷ এরপর আমরা আইন মন্ত্রণালয়ে ভোটিংয়ের জন্য পাঠাবো৷ জামুকা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ পরের বিষয় আইন মন্ত্রণালয় দেখবে৷’’
শাজাহান খান
বঙ্গবন্ধুর যে খুনিদের খেতাব বাতিল করা হচ্ছে তাদের সবাই দণ্ডপ্রাপ্ত৷ তবে জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের প্রস্তাব সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘‘কনভিক্টেড না হলেও এটা তো স্বীকৃত এবং সবাই জানে যে, জিয়াউর রহমান এবং খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত৷ এটা তো সর্বজনস্বীকৃত৷ সামাজিকভাবে তারা দোষী৷’’
এদিকে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব, মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব জানিয়েছেন বিষয়টির সঙ্গে তাদের ফোরাম যুক্ত নয়৷ তিনি বলেন, ‘‘জামুকা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত৷ এই প্রক্রিয়ার সাথে আমি কখনো যুক্ত ছিলাম না৷ কিন্তু আমি মনে করি, জিয়াউর রহমান ঐতিহাসিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন৷ তিনি জেড ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন৷ পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে তাকে বীর উত্তম খেতাব দেয়া হয়েছে৷’’
‘‘কিন্তু পরকর্তীকালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হয়ে মুক্তিযদ্ধের আদর্শ, চেতনা এবং ইতিহাসের সাথে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে যেভাবে পুনর্বাসিত করেছেন, তাতে আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধের পর তাকে যে খেতাবটি দেয়া হয়েছে সেটা বহন করার ক্ষমতা বা সাধ্য তিনি রাখেন না৷’’
মাহবুব উদ্দিন খোকন
দণ্ডিত হওয়া না হওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘এটা জামুকা এবং সরকারের বিষয়৷ সেটা তারা চিন্তা-ভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে৷’’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এবং সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন মনে করেন, জামুকা এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রমাণ করলো তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছে না, সরকারের ইচ্ছায় কাজ করছে এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করছে, ‘‘জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের খেতাব দিয়ে গেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বাবা৷ পরবর্তী রাজনৈতিক ভূমিকা কার কেমন সেই বিবেচনায় এটা বাতিল হতে পারে না৷ খেতাব বাতিল করে তাকে কি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অস্বীকার করা যাবে?’’
তিনি মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মুক্তিযুদ্ধের খেতাবও বাতিল করা ঠিক না৷ বিএনপি খেতাব বাতিলের উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এ বিষয়ে পার্টি সিদ্ধান্ত নেবে৷’’
চেষ্টা করেও এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি৷
বিএনপির চার দশক
৪৫ বছরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি৷ দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া৷ যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত আছেন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷ এত বছরে কী ছিল দলটির পথচলা?
ছবি: Getty Images/Keystone
প্রেক্ষাপট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা সদস্যদের গুলিতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন৷ এরপর প্রায় তিন বছর বাংলাদেশে ছিল অনির্বাচিত সরকার৷ সে সময় দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান৷ পরে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এলে রাজনৈতিক দল গঠন করেন৷
ছবি: imago/Belga
প্রতিষ্ঠা
বিএনপি গঠন করার আগে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠন করা হয়েছিল৷ পরে তা বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে প্রধান করে গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি৷ ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনা রেস্তোরাঁয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠ করে দলের যাত্রা করেন জিয়াউর রহমান৷
ছবি: imago/United Archives International
নির্বাচন ও মৃত্যু
জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থাতেই ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন৷ এ নির্বাচনে বিএনপি ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে৷ তখন মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জেতে৷ নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবার মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন৷
ছবি: Getty Images/Keystone
খালেদার রাজনীতিতে আসা
জিয়ার মৃত্যুর পর নেতাকর্মীদের আহ্ববানে তিনি ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন৷ ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন৷ ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় প্রথম বক্তৃতা করেন৷ ১৯৮৪ সালের ১০মে পার্টির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন৷
ছবি: AP
এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও খালেদা জিয়া
জিয়ার মৃত্যুর পর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন৷ তবে তাঁকে হটিয়ে ১৯৮৩ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন৷ বিএনপি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ এই আন্দোলনে বেগম জিয়া ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দু’জনই ছিলেন, যদিও আপোষহীনতার কারণে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
সরকার গঠন
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ এ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে বিএনপি৷ ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রশ্নবিদ্ধ আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে৷ কিন্তু আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদে মাত্র ৪৫ দিন টিকতে পারে সেই সরকার৷
ছবি: AP
শেষবার সরকারে
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে জিতে আবারো সরকার গঠন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট৷এই সরকারই ছিল বিএনপির শেষ সরকার৷ এই সরকারের মেয়াদ শেষ হবার পর নানা বিতর্ক ও ঘটনার প্রেক্ষাপটে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল প্রায় দুই বছর৷ সে সময় খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়কেই জেলে যেতেও হয়েছিল৷ পরে অবশ্য দু’জনই ছাড়া পান৷
ছবি: Getty Images
জোটের রাজনীতি
বিএনপি এ পর্যন্ত বারবার জোট করেছে৷ প্রথম সাতদলীয় জোট করে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে৷ এরপর জামায়াতে ইসলামীসহ গড়ে চারদলীয় জোট৷ পরবর্তীতে জোটে দলের সংখ্যা বাড়তে থাকে৷ সেটি ঠেকে বিশ দলীয় জোটে৷
ছবি: bdnews24.com
রাজনৈতিক ভুল ও কারাগারে খালেদা
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট৷ এই নির্বাচনে অংশ না নেয়াকে অনেকেই রাজনৈতিক ভুল বলে মনে করেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে থাকা নানা মামলার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আদালত তাঁকে কারাদণ্ড দেয়৷ আরো কয়েকটি মামলা চলছে তাঁর বিরুদ্ধে৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Abdullah
বিদেশে তারেক রহমান
মানি লন্ডারিংসহ নানা মামলায় বর্তমানে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন জিয়াপুত্র ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷ নানা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি দেশে ফিরতে পারছেন না৷ এসব সংকট নিয়ে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে কিছুটা দুর্বল অবস্থায় আছে বলে মনে করেন অনেকেই৷