বিশ্ব অর্থনীতি আজ পরিবর্তনের মুখে: জাতীয় স্বার্থ আবার বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়ছে অথবা কমছে৷ এই পরিস্থিতিতে হামবুর্গের জি-টোয়েন্টি শীর্ষবৈঠক কি ধরনের বার্তা দিতে পারে?
বিজ্ঞাপন
হামবুর্গ একটি হানসিয়াটিক শহর৷ হানসা বলতে বোঝায় মধ্যযুগে সৃষ্ট একটি সংঘ, বিভিন্ন জার্মান ব্যবসায়ী ও পরে শহর যার সদস্য ছিল – এক হিসেবে হানসাকে সে আমলের মুক্ত বাণিজ্য এলাকা বলা চলে৷ আজ কিন্তু মুক্ত বাণিজ্যের বাজার বিশেষ ভালো যাচ্ছে না – তা সত্ত্বেও যে বিশ্বঅর্থনীতিতে পূর্বাপর তেজি চলেছে, সেটাই আশ্চর্যের কথা৷ আশ্চর্য হবার কিছু নেই, বলেছেন হামবুর্গের বিশ্ব অর্থনীতি প্রতিষ্ঠান এইচডাব্লিউডাব্লিউআই-এর পরিচালক হেনিং ফ্যোপেল৷ তাঁর মতে শুধুমাত্র দেশের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব অর্থনীতিকে দেখার ও তার ফলশ্রুতি স্বরূপ সংরক্ষণবাদী প্রবণতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্যান্য দেশেও ছড়াচ্ছে, যার অর্থ, ‘‘বিশ্বায়ন আবার অংশত ফিরিয়ে নেওয়া হতে পারে৷''
হামবুর্গে জি-টোয়েন্টি শীর্ষবৈঠক উপলক্ষ্যে যে সব বিশ্বায়ন বিরোধীরা প্রতিবাদ প্রদর্শনের জন্য সেখানে সমবেত হয়েছেন, এই বিকাশধারাকে তাদের স্বাগত জানানোরই কথা৷ তাদের মতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ক্রমেই আরো বেশিভাবে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ফলে নানা ধরনের বিকৃতির সৃষ্টি হয়েছে৷ অপরদিকে আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলির বক্তব্য যে, বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের জনসংখ্যার একটি বড় অংশের দারিদ্র্য কমেছে ও জীবনযাত্রার মান বেড়েছে৷
অনুরূপভাবে মুক্ত বাণিজ্য বনাম সংরক্ষণবাদের টানাপোড়েনও হামবুর্গের জি-টোয়েন্টি শীর্ষবৈঠকের চূড়ান্ত ঘোষণার বয়ানে ছাপ রাখতে পারে, বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা৷ মার্চ মাসে জার্মানির বাডেন-বাডেনে জি-টোয়েন্টি অর্থমন্ত্রীদের শীর্ষবৈঠকে ঠিক তাই ঘটেছিল, যখন মার্কিন প্রতিনিধিদল চূড়ান্ত ঘোষণার একটি অনুচ্ছেদ রুখে দেয়৷ এর কয়েক সপ্তাহ পরে ইটালির তাওরমিনায় জি-সেভেন শীর্ষবৈঠকে যা হোক একটা আপোশে আসা সম্ভব হলেও, সে আপোশের কি কোনো মূল্য আছে?
জার্মানিতে জি-টোয়েন্টির অতিথিরা যেখানে থাকবেন
শুক্রবার জার্মানির হামবুর্গে শুরু হচ্ছে দুই দিনব্যাপী জি-টোয়েন্টির শীর্ষ সম্মেলন৷ সারা দুনিয়া থেকে আসা অতিথিদের জন্য প্রায় নয় হাজার হোটেলরুম প্রয়োজন পড়বে৷
ছবি: picture alliance/dpa/M. Scholz
হামবুর্গ সেনেটের অতিথিশালা
নিরাপত্তার খাতিরে বিশ্বের শীর্ষ নেতারা কোথায় থাকবেন তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি৷ তবে ইতিমধ্যে বেশ কিছু অনুমান প্রকাশিত হয়েছে৷ যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হামবুর্গ সেনেটের অতিথিশালায় থাকবেন বলে জানা যাচ্ছে৷ অতীতে সেখানকার অতিথি হয়েছেন প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানা সহ বিখ্যাত অনেক ব্যক্তি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/U. Perrey
পার্ক হায়াৎ
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন ও ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এই হোটেলে থাকতে পারেন৷ সম্মেলনের সময় হোটেলগুলো দূর্গ হয়ে ওঠবে৷ চারদিকে থাকবে পুলিশি পাহারা৷ সম্মেলনে নিরাপত্তা দিতে প্রায় ২০ হাজার পুলিশ মোতায়েন থাকবে৷
ছবি: Park Hyatt
দ্য ওয়েস্টিন
হামবুর্গ শহরের নতুন আকর্ষণ ‘এলবফিলহারমোনি’-তেই অবস্থিত এই হোটেল৷ এখান থেকে এলবে নদীর দারুণ সব দৃশ্য দেখা যায়৷ শোনা যাচ্ছে, সৌদি আরবের প্রতিনিধি দল সেখানে অবস্থান করবেন৷ সেটি সত্যি হলে সম্মেলন উপলক্ষ্যে যে কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে তা দেখতে সৌদি প্রতিনিধিদের বেশি দূরে যেতে হবে না৷ শুধু কয়েক তলা নীচে নামলেই চলবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Marks
রাইশসহোফ হোটেল হামবুর্গ
হামবুর্গের প্রধান রেলস্টেশনের কাছে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ভবনে গড়ে ওঠা হোটেলটি ২০১৫ সালে পুনঃসংস্কার করা হয়৷ সেখানে রুম আছে ২৭৮টি৷ ব্রাজিল, ব্রিটেন, ভিয়েতনাম ও ভারতের প্রতিনিধিদের সেখানে থাকার কথা৷
ছবি: picture alliance/dpa/C. Charisius
গ্র্যান্ড এলিজে
১৯৮৫ সালে নির্মিত এই হোটেলে ৫১১টি রুম আছে৷ সম্মেলনের সময় এর কয়েকটিতে চীনা অতিথিরা থাকতে পারেন৷ সব অতিথিকে একই চোখে দেখায় বিশ্বাস করে এই হোটেলের কর্তৃপক্ষ৷ ফলে স্টেফি গ্রাফ কিংবা ক্লিফ রিচার্ড যে-ই ঐ হোটেলে যান না কেন তাঁদেরকে সাধারণ অতিথিদের সমানই অর্থ দিতে হয়৷ ভিআইপি বলে তাদের জন্য আলাদা কোনো ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা নেই৷
ছবি: Grand Elysée
সোফিটেল হামবুর্গ আল্টার ওয়াল
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান সম্ভবত এই হোটেলে থাকবেন৷ হোটেলটির সাজসজ্জায় ফরাসি শিল্পের ছোঁয়া পাওয়া যায়৷
ছবি: Sofitel Hamburg
ফেয়ামন্ট হোটেল ফিয়ার ইয়ারেসসাইটেন
কোনো বিশ্বনেতা শেষ পর্যন্ত এই হোটেলে থাকবেন তা এখনও জানা যায়নি৷ তবে হোটেল কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ট্রাম্প আর পুটিনকে ‘না’ বলেছে৷ যদিও গত বছরের ডিসেম্বরে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এই হোটেলে ছিলেন৷
ছবি: Fairmont Hotel Vier Jahreszeiten
ম্যুভেনপিক হোটেল হামবুর্গ
আগে ছিল লাল ইটের তৈরি একটি পানির টাওয়ার৷ ১৯১০ সালে তৈরি টাওয়ারটি পরে হোটেলে পরিণত করা হয়৷ ১৭ তলায় অবস্থিত টাওয়ার সুট থেকে হামবুর্গের ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্য দেখা যায়৷ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ ও তাঁর স্ত্রী এই হোটেলে থাকতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Marks
হোটেল অ্যাটল্যান্টিক কেম্পিনস্কি
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল থাকবেন এই হোটেলে৷ জি-টোয়েন্টি সম্মেলন চলাকালীন আপনি যদি এই হোটেলগুলোর একটিতে থাকতে চান (যদি এখনও রুম খালি থাকে) তাহলে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি অর্থ দিতে হতে পারে৷
ছবি: picture alliance/Arco Images GmbH/R. Erl
9 ছবি1 | 9
মুক্ত ও ন্যায্য
মিউনিখের ইফো ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত জনমত সমীক্ষা প্রতিষ্ঠানের গাব্রিয়েল ফেলবারমাইর-এর মতে, বিশ্ব অর্থনীতির গঠন প্রণালীর উপর জনসাধারণের আস্থা থাকা প্রয়োজন, যার জন্য প্রয়োজন দেশ ও সরকারবর্গের মধ্যে সহযোগিতার৷ যে কারণে জি-টোয়েন্টির চূড়ান্ত ঘোষণায় মুক্ত ও যতদূর সম্ভব ন্যায্য বাণিজ্যের প্রতি সমর্থনের উল্লেখ থাকা উচিৎ৷ অতীতে বিভিন্ন চূড়ান্ত ঘোষণায় এ ধরনের বক্তব্য থেকেছে এবং তা সত্ত্বেও অংশগ্রহণকারী দেশগুলি তাদের সংরক্ষণবাদী নীতি চালিয়ে গেছে৷ তবুও মুক্ত বাণিজ্যের প্রতি এ ধরনের ‘লোক-দেখানো' সমর্থনের মূল্য আছে, বলে ফেলবারমাইর মনে করেন৷
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ন্যায্য' বাণিজ্য চুক্তির দাবি তোলার পর থেকে জার্মানি তথা ইউরোপের নেতৃবর্গ যে মুক্ত এবং ন্যায্য বাণিজ্যের ধুয়ো তুলতে শুরু করেছেন, বৈদেশিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ফেলবারমাইর-এর মতে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷ এছাড়া ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে আসার পর থেকে ইউরোপীয়রা মুক্ত বাণিজ্য বা জলবায়ু সুরক্ষার মতো প্রসঙ্গে ক্রমেই আরো বেশি করে জাপান, চীন বা ভারতের মতো এশিয়ার দেশগুলির দিকে ঝুঁকছে৷ হামবুর্গের বিশ্ব অর্থনীতি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হেনিং ফ্যোপেল-এর মতে, বিশ্বের রাজনীতি অর্থনীতিতে যে বিভিন্ন দেশের ওজন ও তাৎপর্য বদলাচ্ছে, এটা তারই লক্ষণ৷
ট্রাম্পের ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট' নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা ও সামরিক-অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে দেশটির পতনের সূচনা হতে পারে, বলে ফ্যোপেল মনে করেন৷ চীন এই সুযোগে বিশ্বের প্রথম সারির অর্থনীতিগুলির পর্যায়ে উঠে আসতে পারে৷ এভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক গঠনপ্রণালীর একটা নতুন যুগ শুরু হতে চলেছে, বলে ফ্যোপেলের ধারণা৷
ফেলবারমাইর-এর মতে হামবুর্গের জি-টোয়েন্টি শীর্ষবৈঠক থেকে একটি বিশ্বাসযোগ্য সংকেত আসা উচিত যে, সহযোগিতা আজও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল নীতি – বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোহিতার মনোভাব নিয়ে দ্বিধা যখন ব্যাপক৷
ছবিতে জি-টোয়েন্টি সম্মেলনের প্রতিবাদ
জি-টোয়েন্টি সম্মেলনের আগেই শুরু হয়ে গেছে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ৷ হামবুর্গের রাস্তাঘাট ও নদীতে বিভিন্ন গ্রুপ এরই মধ্যে নানান সৃজনশীল উপায়ে প্রতিবাদ শুরু করে দিয়েছেন, যা চলবে সম্মেলন শেষ হওয়া পর্যন্ত৷
ছবি: Reuters/F. Bimmer
রাবারের তৈরি মানবমূর্তি
গেল রবিবার আন্তর্জাতিক সংগঠন অক্সফামের একটি প্রতিবাদের ভাষা ছিল এমনই৷ ধনী-গরিবের মাঝে বৈষম্য কমানোর ডাক দিয়ে এই মূর্তিগুলো বানায় তারা, যা দেখে বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি যে কাদের উদ্দেশ্যে এই আহ্বান৷
ছবি: Reuters/F. Bimmer
সন্ধ্যায় বেড়ানো?
পার্কে বেড়াবেন? হামবুর্গের এন্টেনভের্ডার পার্কে একটি ক্যাম্পকে এরই মধ্যে তুলে দিয়েছে পুলিশ৷ গেল কয়েক সপ্তাহ ধলে এই ক্যাম্পিংয়ের প্রস্তুতি চলছিল৷ পুলিশ মনে করছে, প্রায় এক লাখ প্রতিবাদকারী এই ইভেন্টটিতে যোগ দিতে পারেন৷ এদের মধ্যে অন্তত ৮,০০০ বামপন্থি উগ্রবাদী থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, যারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Marks
নদীতে নৌবহর
ব্যানার ও রঙীন জ্যাকেট পড়ে আলস্টার নদীতে নৌবহর সাজিয়েছে প্রতিবাদকারীরা৷ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে অনেকেই সমর্থন দিয়েছেন বিভিন্ন এনজিও-র এই প্রতিবাদে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Macdougall
জনগণের ক্ষমতা
প্রতিবাদকারীরা অনেক প্ল্যাকার্ড ইংরেজিতে লিখে এনেছেন৷ কারণ, তাঁরা চান তাদের বার্তাগুলো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাক৷ বেশিরভাগ বার্তাই পরিবেশ সুরক্ষার জন্য তৈরি৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Macdougall
জম্বি সেজে প্রতিবাদ
হামবুর্গ শহরের কোনো গলিতে হঠাৎ দেখা হয়ে যেতে পারে কোনো জম্বির সঙ্গে৷ প্রতিবাদকারীদের অনেকেই জম্বি সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন শহরজুড়ে৷ তবে এটি শুধুই প্রতিবাদের একরকম শৈল্পিক ভাষা৷ এর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই৷
ছবি: DW/A. Drechsel
প্রতিবাদ ক্যাম্প বিতর্ক
শহরে প্রতিবাদ ক্যাম্প করতে দিচ্ছে না জার্মান পুলিশ, যা নিয়ে বিতর্ক চলছে৷ হামবুর্গে এরই মধ্যে পুলিশবাহিনীর অতিরিক্ত ২০,০০০ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে, সঙ্গে রয়েছে ২৮টি হেলিকপ্টার, বাহিনীর ১৮৫টি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর, ৪০টি জলকামান এবং প্রায় ৩,০০০ টহল গাড়ি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Sabrowsky
সবার জন্য শান্তির বার্তা
সম্মেলনকেন্দ্রে যাওয়ার পথে ভবনের দেয়ালে বড় করে শান্তির বার্তা প্রকাশ করেছে একটি নার্সিং হোম৷ সেখানে লেখা হয়েছে, আমরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে স্বাগত জানাই৷