বাংলাদেশের অ্যাক্টিভিস্ট আনু মুহাম্মদের কাছে হত্যার হুমকি নতুন কিছু নয়৷ অর্থনীতির এই অধ্যাপক অতীতে পিটুনির শিকার হয়েছেন, হয়েছেন নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়নের শিকার, এমনকি গ্রেপ্তারও হয়েছেন৷ সবই হয়েছে তাঁর আন্দোলনের কারণে৷
বিজ্ঞাপন
গতবছর অক্টোবরে মুঠোফোনে এক ক্ষুদেবার্তা পান আনু মুহাম্মদ– ‘‘ডেথ কিপস নো ক্যালেন্ডার, অ্যান্ড আনসাটুল্লাহ নোজ নো টাইম!'' এ রকম হুমকি তিনি আগেও পেয়েছেন৷ তাই বেশি আমলে নেননি৷ কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর আরো একটি বার্তা আসে৷ ইংরেজিতে তাতে লেখা: ‘‘সে ‘ইয়েস' টু রামপাল, আদারওয়াইজ ইউ উইল বি হ্যাকড টু ডেথ ইনক্রেডিবলি বাই আস!''
পুলিশের কাছে এই বিষয়ে অভিযোগের পর জানা যায়, আনসাটুল্লাহ সম্ভবত আনসারুল্লাহ'র নামের বানান ভুল করে লেখা হয়েছে৷ আনসারুল্লাহ বা আনসার আল ইসলাম হচ্ছে আলকায়দার সঙ্গে সম্পর্কিত উগ্র ইসলামপন্থিদের গ্রুপ৷ এই গ্রুপ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন নাস্তিক লেখক এবং সমকামী অ্যাক্টিভিস্টকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে৷ ২০১৪ সালে সমাজতত্ত্ব বিভাগের এক অধ্যাপককে হত্যার দায়ও স্বীকার করেছিল এই গ্রুপ৷
সুন্দরবন ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া
বিদ্যুৎ অবশ্যই দরকার, বিশেষ করে গরিবদের তো আরো বেশি দরকার৷ তারপরও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা হবে মর্মান্তিক৷ একদিকে দেশের-দশের প্রয়োজন, অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্জয়ের ভয়৷ কী বলছে দেশের মানুষ?
ছবি: picture-alliance/dpa/Pacific Press/M. Hasan
মোশাহিদা সুলতানা, শিক্ষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতুর মতে, সুন্দরবনের পাশে এত বড় একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না৷ তাঁর মতে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প আছে৷
ছবি: DW
সায়েম ইউ চৌধুরী, পাখি ও বন্যপ্রাণী গবেষক
৪০ বারেরও বেশি সুন্দরবনে গেছেন সায়েম৷ তিনি জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি সার কারখানা থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়৷ পুকুরের মাছ, গাছপালা, প্রাণী – সব মারা পড়ে৷ এ রকম ছোট একটা সার কারখানার দুর্ঘটনা থেকে আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার সক্ষমতা যেখানে নেই, সেখানে এত বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা হলে আমাদের সরকার কী-ই বা করার থাকবে?
ছবি: DW
মারুফ বিল্লাহ, স্থানীয় বাসিন্দা
মারুফ বিল্লাহর জন্ম রামপালেই৷ ছোটবেলা থেকেই তিনি সুন্দরবনকে ধ্বংস হতে দেখে আসছেন৷ আর এখন সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ধ্বংসের আরেক পায়তারা করছে সরকার৷ তিনি জানান, সিডর আর আইলার পরে আমরা দেখেছি ঐ জনপদকে সে যাত্রায় বাঁচিয়েছিল সুন্দরবন৷ এখন যদি আমরাই তাকে মেরে ফেলি, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে? তাই তাঁর প্রশ্ন, জীবন আগে, নাকি বিদ্যুৎ আগে?
ছবি: DW
সাইমুম জাহান হিয়া, শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইমুম জাহান হিয়া মনে করেন, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন৷ এর পাশে বিশাল আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে যে কখনো কোনো দুর্ঘটনা হবে না – এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে, এটা ঠিক, তবে সেটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে নয়৷
ছবি: DW
হাসিব মোহাম্মদ, শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব মোহাম্মদ কয়েকবার সুন্দরবনে গেছেন৷ আসলে এই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র তাঁকে সবসময় টানে৷ তাই এ বনের কোনোরকম ক্ষতি করে তিনি এর কাছাকাছি রামপালের মতো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চান না৷ গত বছরের কয়েকটি ছোট ছোট জাহাজ সুন্দরবনে ডোবার পর যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাহাজ চলাচল বেড়ে গিয়ে দুর্ঘটনাও বাড়বে৷
ছবি: DW
মিমু দাস, শিক্ষার্থী
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মিমু দাসও মনে করেন, সুন্দরবনের এত কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা ঠিক হবে না৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করবে৷ মিমু বিদ্যুৎকেন্দ্র চান, তবে সেটা অন্য কোথাও৷
ছবি: DW
আদনান আজাদ আসিফ, মডেল ও অভিনেতা
মডেল ও অভিনেতা আদনান আজাদ আসিফ একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারও৷ কয়েক বছর ধরে সময় পেলেই তিনি সুন্দরবনে ছুটে যান৷ বিশ্বের সবেচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসস্থল৷ তাঁর মতে, সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস৷ আর এমনিতেই নানা কারণে এখানে বাঘের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে৷ তাই এর কাছাকাছি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো প্রকল্প করে এ বনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না৷
ছবি: DW
আমিনুর রহমান, চাকুরিজীবী
ঢাকার একটি পরিবহন সংস্থায় কাজ করেন আমিনুর রহমান৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার৷ তাই বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে দেশের জন্য ভালোই হবে৷ তাছাড়া তিনি শুনেছেন যে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিই করবে না৷
ছবি: DW
আব্দুল আজীজ ঢালী, মধু চাষি
সুন্দরবনে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধু আহরণ করেন সাতক্ষীরার আব্দুল আজীজ ঢালী৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বনের সঙ্গে থাকতে চান তিনি৷ সুন্দরবনে থাকলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কিছুই জানেন না আব্দুল আজীজ৷
ছবি: DW
ভবেন বিশ্বাস, মাছ শিকারি
ভবেন বিশ্বাসের জীবিকার অন্যতম উৎস সুন্দরবন৷ উদবিড়াল দিয়ে এ বনে তিনি মাছ ধরেন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে৷ তাঁর বাবা ও ঠাকুরদাদার এ পেশা এখনো তিনি ধরে রেখেছেন৷ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এ খবর তিনি শুনে থাকলেও, এর ভালো বা খারাপের দিকগুলো – কিছুই জানা নেই তাঁর৷ তবে সুন্দরবনকে তিনি ভালোবাসেন, খুব ভালোবাসেন৷
ছবি: DW
10 ছবি1 | 10
গোষ্ঠীটির নজর এখন সম্ভবত ষাট বছর বয়সি অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের দিকে, কেননা, তিনি বাংলাদেশের সুন্দরবনের কাছে রামপালে নির্মিতব্য দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতা করছেন গত সাত বছর ধরে৷ আনু মোহাম্মদসহ এই প্রকল্পের বিরোধিতা করা অ্যাক্টিভিস্টরা মনে করেন, সুন্দরবনের কাছে এমন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে তা ম্যানগ্রোভ বনটিকে ক্রমান্বয়ে ধ্বংস করে দেবে৷
ভারত-বাংলাদেশ যৌথউদ্যোগ নির্মিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কারণে সুন্দরবনের কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে সেটা নিয়ে অবশ্য পরস্পরবিরোধী মন্তব্য রয়েছে৷ অ্যাক্টিভিস্টরা মনে করেন, বিশ্বের অন্যতম বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্টটিতে থাকা কুমির থেকে পাইথন অবধি সকল প্রাণিই ক্ষতির শিকার হবে৷ গাছপালাও ধ্বংস হয়ে যাবে৷
আনু মুহাম্মদ অবশ্য এই আশ্বাসে মোটেই আশ্বস্ত নন৷ বরং তিনি মনে করেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হবে এক ‘বিপর্যয়'৷ আর সেই বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর তিনি, তা যতই হুমকিধামকি আসুক না কেন৷ গতবছরের অক্টোবরে তাঁকে যে মোবাইল নম্বর থেকে হুমকি দেয়া হয়েছিল, সেটি ছিল আওয়ামী লীগের ইসলামপন্থি অঙ্গসংগঠন আওয়ামী ওলামা লীগের এক নেতার নামে নিবন্ধিত৷ যদিও সেই নেতা দাবি করেছেন, তিনি আনু মুহাম্মদকে হুমকি দেননি৷