জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড় খুঁড়ে স্বর্ণ উত্তোলন করেন কঙ্গোর বাসিন্দারা৷ দারিদ্র্য ঘোচাতে কতটা সহায়ক তাদের এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ?
বিজ্ঞাপন
‘‘বনের পশুর মতো গুহায় প্রবেশ করি৷ ক্লান্ত হয়ে গেলে একটু বিশ্রাম নেই,’’ এভাবেই স্বর্ণ উঠাতে গিয়ে নিজের পরিশ্রমের কথা বলছিলেন আফ্রিকার দেশ কঙ্গোর হার্ডি বিসিমওয়া৷
২২ বছরের বিসিমওয়া দেশটির সাউথ কিভু প্রদেশের লুহিহির একটি খনিতে নানা কসরত করে স্বর্ণ আহরণের চেষ্টা করেন৷ মাথায় বসানো থাকে টর্চ লাইট৷ টর্চের আলোয় চলে খননকাজ৷ নেই কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা৷ আর তাই থাকে জীবন হারানোর মারাত্মক ঝুঁকি৷
কংঙ্গোর ওই অঞ্চলটিতে স্বর্ণ উত্তোলনের ইতিহাস বেশিদিনের নয়৷ দুই বছর আগে স্থানীয়রা সেখানে একটি পাহাড় আবিষ্কার করে, যে পাহাড়ের নীচে গুপ্তধনের মতোই স্বর্ণ লুকিয়ে আছে বলে ধারণা করা হয়৷
এমন ধারণায় স্থানীয়রা ওই পাহাড়কে ঘিরে ভিড় করতে থাকে৷ কাঠ আর ত্রিপলের ঘর বানিয়ে এখানে প্রায় দুইশ পরিবার বাস করছে৷
তবে স্বর্ণ উত্তোলনের বিষয়টি কিন্তু অত্যন্ত ভয়াবহ৷ কেননা, স্থানীয় গোত্রগুলোর মধ্যে এ খনিজ সম্পদ নিয়ে কোন্দল তো আছেই, সেই সাথে গুহায় শ্বাসকষ্টে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে৷
কঙ্গোর সোনার খনি
ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো, সংক্ষেপে ডিআরসি৷ আফ্রিকার দেশটির উত্তরাঞ্চলের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস সোনার খনি৷ শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খনি থেকে সোনা আহরণ করে৷ বহু হাত ঘুরে, অবশেষে তা পরিণত হয় জ্বলজ্বলে সোনার বারে৷
ছবি: Robert Carrubba
হাড়ভাঙা খাটুনি
খনির অনেক গভীর থেকে নৈপুণ্যের সাথে মাটি থেকে সোনা আলাদা করছেন এক শ্রমিক৷ খনির দলে থাকেন দুই ধরনের শ্রমিক, যারা খনন করেন, এবং যারা সোনার আকর মাটির ওপরে নিয়ে আসেন৷ একজন শ্রমিককে দিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা খনিতে কাজ করতে হয়৷
ছবি: Robert Carrubba
খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি
এই খনিতে এক গ্রাম সোনার জন্য ২০০ কেজি আকরিক সংগ্রহ করতে হয়৷ ছোট ছোট সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে খনির মধ্য দিয়ে আসা যাওয়া করতে হয় শ্রমিকদের৷ মাটিভর্তি বস্তা আসছে, সেটি বয়ে নিয়ে যেতে হবে বাইরে৷ কৃষিকাজের পর সোনার খনিই শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস৷
ছবি: Robert Carrubba
প্রতি বস্তায় ৩০ কেজি
সোনার মাটিভর্তি বস্তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন একজন শ্রমিক৷ প্রতি বস্তা বহন করার জন্য একজন শ্রমিক পান ৫০০ কঙ্গোলিজ ফ্রাংক (প্রায় ২৫ টাকা) দিন শেষে কয়েকশ টাকা পান শ্রমিকরা৷ খনিতে সবচেয়ে কম বেতন পাওয়াদের মধ্যে আছেন এই বহনকারীরা৷ এদের বেশিরভাগই এসেছেন অন্য এলাকা থেকে৷
ছবি: Robert Carrubba
পাথরবেষ্টিত সোনা
পাথর ও মাটির খাঁজে খাঁজে আটকে থাকে বিশুদ্ধ সোনা৷ সোনা আহরণের জন্য সেই পাথর ভেঙে টুকরো করতে হয়৷ এজন্যই আছে আলাদা শ্রমিক৷ মেশিনে নয়, প্রচণ্ড পরিশ্রমের এই পুরো কাজটাই হয় হাতে৷ এমন একটি প্লাস্টিকের গামলা থেকে সোনা আলাদা করতে সময় লাগে কয়েক ঘণ্টা৷
ছবি: Robert Carrubba
দামি কাদা
ভাঙা আকরিক পানিতে মিশিয়ে কাদা তৈরি করছেন একজন শ্রমিক৷ ঘনত্ব বেশি হওয়ায় শুধু সোনাই পড়ে থাকে নীচে, বাকি পানি ও মাটি চলে যায় গড়িয়ে৷ তারপর জমে থাকা সোনা পারদের সাহায্যে ছেঁকে তোলা হয় আরেক প্লাস্টিকের গামলায়৷
ছবি: Robert Carrubba
এবার হবে বিক্রি
খনির আশেপাশেই দোকান বসিয়ে এই অপরিশোধিত সোনা কিনে নেন কিছু স্থানীয় ব্যবসায়ী৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে সোনা ও পারদের এক ধরনের ধূসর মিশ্রণ৷ ছোট ছোট খনি মালিকরা এই অপরিশোধিত সোনা বিক্রি করেন৷
ছবি: Robert Carrubba
পরিশোধন প্রক্রিয়া
বড় ব্যবসায়ীরা উত্তপ্ত চুলায় অপরিশোধিত সোনা নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে গলিয়ে ফেলেন৷ উদ্দেশ্য, অপ্রয়োজনীয় জিনিস দূর করা৷ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের চেয়ে অনেক বড় পরিমাণে সোনার চালান দিয়ে থাকেন বড় ব্যবসায়ীরা৷ প্রতি সপ্তাহে বিক্রি হয় কয়েক কেজি সোনা৷ ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের চেয়ে লাভের হার কম হলেও মাস শেষে আয়টা হয় বেশ বড়ই৷
ছবি: Robert Carrubba
মূল্যবান গুড়া
উত্তপ্ত সোনা ঠান্ডা হওয়ার পর একটি ইলেকট্রনিক দাঁড়িপাল্লায় মাপা হয়৷ এই পর্যায়ে এসে সোনা অন্তত ৯২ থেকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধিত হয়৷ অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে তা নির্ভর করে কোন খনি থেকে আহরণ করা হয়েছে তার ওপর৷
ছবি: Robert Carrubba
আরো পরিশোধন
এবার ১,৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সোনা গলানো হয় আরেকটি উত্তপ্ত চুলায়৷ পরিণত করা হয় একটি মণ্ডে৷ গ্রাফাইট সোনার সাথে বিক্রিয়া করে না৷ তাই গ্রাফাইটের তৈরি একটি ছাঁচে ঢালা হয় তরল সোনা৷ কয়েক কেজি সোনা গলাতে লাগে মাত্র ২০ মিনিট৷
ছবি: Robert Carrubba
ঠান্ডা হবার অপেক্ষা
এতো উত্তপ্ত সোনা পুরোপুরি ঠান্ডা হতে সময় লাগাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু এতো অপেক্ষার ধৈর্য আছে কার! এজন্য মোটামুটি ঠান্ডা হলেই ছাঁচ থেকে সোনা বের করে সরিয়ে রাখা হয় একপাশে৷ ধীরে ধীরে লাল থেকে হলুদ, হলুদ থেকে সোনালি, ফুটে ওঠে মূল্যবান এই ধাতুর আসল চেহারা৷
ছবি: Robert Carrubba
সোনার বার
এবার দেশবিদেশে রপ্তানি হওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত খনি থেকে আহরিত সেই সোনা৷ ছবির সোনার বারটির ওজন ৪ দশমিক তিন কেজি৷ প্রস্তুতের দিনে ইংল্যান্ডের লন্ডনে এর দাম ছিলো এক লাখ সাতষট্টি হাজার ডলার (প্রায় এক কোটি ৪১ লাখ টাকা)৷ বছরে প্রায় ১১ টনের মতো সোনা উৎপাদন করে কঙ্গো, কিন্তু এর বেশিরভাগই অবৈধভাবে দেশের বাইরে চলে যায়৷ সরকারি হিসেবে ২০১৫ সালে মাত্র ২৫৪ কেজি সোনা রপ্তানি করেছে ডিআরসি৷
ছবি: Robert Carrubba
11 ছবি1 | 11
স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থা ডিডিয়ের সিযা-র একজন প্রতিনিধি জানান, গত পাঁচ মাসে লুহিহিতে সাতজন মারা গেছেন৷ তাদের কেউ কেউ গোত্র-কোন্দলে আর কেউ কেউ গুহার ভেতরে শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন৷
এতসব ঝুঁকি আর নিরাপত্তাহীনতার পর খুব বেশিকিছু যে পাওয়া যাচ্ছে তা কিন্তু নয়৷
সর্বশেষ সাতবারের চেষ্টায় বিসিমওয়া একবার স্বর্ণ পেয়েছিলেন৷ তবে আশা ছাড়ছেন না তিনি৷ বলছেন, ‘‘ঈশ্বরের কৃপা থাকলে আমি স্বর্ণ পাবো, যা দিয়ে আমার পরিবারকে নিয়ে চলতে পারবো৷''
মধ্য-আফ্রিকার দেশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে স্বর্ণ ও কোবাল্টসহ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে৷ তারপরও দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের অবস্থান দারিদ্র্য সীমার নীচে৷ বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, তাদের দৈনিক আয় দুই ডলারেরও কম৷
তাদেরই একজন বেরটিন মুরুহা৷ ১৯ বছরের মুরুহা ২০১৯ সালের স্কুলের চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি৷ তিনি এখন খনি থেকে স্বর্ণ উত্তোলনের চেষ্টা করেন৷ গত এক বছরের চেষ্টায় কিছুটা স্বর্ণ পেয়েছেন মুরুহা ৷
এদিকে এত পরিশ্রমের পর যে সোনা হাতে তারা পান তারও আবার ন্যায্য দাম পান না৷ স্থানীয় কারবারিদের কাছে প্রতি কেজি সোনা ৪৫০ ডলারে বিক্রি করতে হয়, আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় যা অনেক কম৷ আর কয়েক গ্রাম সোনার দাম যে কত কম তা সহজেই অনুমান করা যায়৷ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বর্ণ তোলায় নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন তাই খুব একটা হয় না৷
লুহিহির বাসিন্দা সিফা নাশোবোলে বলেন, ‘‘আমরা যে আসলে স্বর্ণ উত্তোলন থেকে লাভবান হচ্ছি তা কিন্তু নয়৷ কারণ, সব স্বর্ণ চলে যায় কারবারিদের কাছে৷''
আরআর/এসিবি (এএফপি)
সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের মালিক যে ১০ দেশ
স্বর্ণ মজুদের ক্ষেত্রে শীর্ষ দেশগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ফোর্বস ম্যাগাজিন৷ তালিকায় শীর্ষ আছে অ্যামেরিকা, আর দশম ভারত৷ ছবিঘরে দেখে নিন কাদের স্বর্ণের পরিমাণ কতো৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS.com/Miami Herald
১০. নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসের প্রধান ব্যাংকে মজুদ আছে ৬১২ টন স্বর্ণ৷ সম্প্রতি ব্যাংকটি বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত এনেছে৷
ছবি: imago/J. Tack
৯. ভারত
ভারতীয়দের স্বর্ণের প্রীতি সর্বজনবিদিত৷ পৃথিবীতে স্বর্ণের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোক্তাও দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি৷ বর্তমানে ৭৮৭ টন স্বর্ণের মজুদ আছে ভারতের৷
ছবি: dapd
৮. জাপান
বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ অর্থনীতির দেশ জাপানে স্বর্ণের মজুদ আছে ৮৪৬ টন৷ ২০১৬ সালে স্বর্ণ রিজার্ভে সুদের হার শূন্যতে নামিয়ে আনে দেশটি, যার ফলে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের আদান-প্রদান বেড়ে যায়৷
ছবি: DW
৭. সুইজারল্যান্ড
১ হাজার ৪০ টন স্বর্ণের মজুদ আছে সুইজারল্যান্ডের৷ মজুদের পরিমাণের বিচারে সপ্তম অবস্থানে থাকলেও মাথাপিছু মজুদের ক্ষেত্রে দেশটি এক নম্বরে আছে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইউরোপের স্বর্ণ বেচাকেনার প্রধান কেন্দ্র ছিল সুইজারল্যান্ড, একইসঙ্গে মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তি উভয়ের লেনদেন ছিল তাদের সঙ্গে৷
ছবি: Reuters/R. Sprich
৬. চীন
চীনে স্বর্ণের মজুদ আছে ২০১১ টন৷ স্বর্ণ মজুদের ক্ষেত্রে পিপলস ব্যাংক অব চায়না ষষ্ঠ অবস্থানে থাকলেও তা দেশটির মোট রিজার্ভের মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ৷ বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর হিসাবে স্বর্ণ রিজার্ভে ব্যাংকটির অবস্থান ১০ম৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Schiefelbein
৫. রাশিয়া
গত ছয় বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বর্ণের ক্রেতা রাশিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক৷ মোট ২,২২৯ টন স্বর্ণের মজুদ নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে আছে দেশটি৷ ২০১৭ সালে ২২৪ টন স্বর্ণ কেনার কারণে চীনকে টপকে পঞ্চম স্থানে আসতে পেরেছে রাশিয়া৷
ছবি: picture-alliance/TASS/S. Bobylev
৪. ফ্রান্স
গত কয়েক বছরে কিছু পরিমাণ বিক্রির পরও স্বর্ণ মজুদে চতুর্থ স্থানে আছে ফ্রান্স৷ বর্তমানে ইউরোপীয় দেশটির স্বর্ণ মজুদের পরিমাণ মোট ২,৪৩৬ টন৷
ছবি: picture-alliance/imagebroker/S. Randebrock
৩. ইটালি
বহু বছর ধরে একই পরিমাণ স্বর্ণের মজুদ বজায় রেখেছে ইটালি৷ বর্তমানে তাদের ২,৪৫১ দশমিক ৮ টন স্বর্ণের মজুদ রয়েছে৷ ডলারের দর উত্থান-পতনের বিপরীতে নিজেদের অবস্থান ঠিক রাখার স্বার্থে মজুদ ধরে রাখার কথা বলে থাকে দেশটি৷
ইউরোপীয় দেশ হিসাবে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের মজুদ আছে জার্মানিতে৷ দেশটির মোট স্বর্ণের মজুদ ৩,৩৭১ টন৷ ২০১৭ সালে দেশটি ফ্রান্স ও অ্যামেরিকার দু’টি ব্যাংক থেকে ৬৭৪ টন স্বর্ণ দেশে ফিরিয়ে এনেছে৷
ছবি: picture-alliance / dpa
১. অ্যামেরিকা
স্বর্ণ মজুদের ক্ষেত্রে অনেক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে অ্যামেরিকা৷ বর্তমানে দেশটির মোট ৮,১৩৩ দশমিক ৫ টন স্বর্ণের মজুদ রয়েছে৷ তালিকার পরবর্তী তিন দেশের স্বর্ণের পরিমাণ অ্যামেরিকার পরিমাণের প্রায় সমান৷