জীবনের মূল্য দিতে শিখবে বাংলাদেশ?
২১ আগস্ট ২০১৮সকালে অফিস যাত্রায় কিছুটা পথ হেঁটে স্টেশনে পৌঁছালেই ঘড়ির কাঁটা ধরে আসছে বাস, ট্রাম, ট্রেন৷ স্টেশন ও এসব পরিবহনের কোনোটায় উঠতে নেই ভিড়, উঠার জন্য হুড়োহুড়ির তো প্রশ্নই ওঠে না৷ এরপর সাত-আট মিনিটের মধ্যেই পোঁছে যাচ্ছেন ৫-৬ কিলোমিটার দূরত্বের গন্তব্যে৷
অপরদিকে একই দূরত্বের অফিসে যেতে সময় লাগছে ঘণ্টাখানেক, কখনো কখনো তারও বেশি৷ আর যাত্রাপথ? প্রায়ই রীতিমতো লড়াই করতে হয় বাসে উঠতে৷ গরমের দিনে গায়ে গায়ে লাগালাগি করে ঘাম নিয়ে নামতে হয় বাস থেকে৷
এই দুই চিত্র জার্মানির বন শহর ও আমাদের প্রিয় ঢাকার৷ দুই শহরের মধ্যে তুলনা চলে না৷ কারণ, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর একটি জার্মানি আর ঢাকা উন্নয়নশীল বাংলাদেশের রাজধানী৷
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের তথ্য মতে, ১৪১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বন শহরের জনসংখ্যা তিন লাখ ১৩ হাজার ১২৫ জন৷ আর ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকায় বাস করছে পৌনে দুই কোটির বেশি মানুষ৷
শুধু মানুষই বেশি নয় ঢাকার রাস্তায়, বহুগুণে আছে গাড়ি৷ তবে সেগুলো জনগণের জন্য নয়, ব্যক্তিগত৷ অপরদিকে বনের প্রায় প্রত্যেক বাড়ির সামনে গাড়ি থাকলেও রাস্তায় চলতে দেখা যায় হাতে গোনা কয়েকটি৷ অর্থাৎ, গাড়ির মালিকরা এখানে গণপরিবহণও ব্যবহার করছেন, যাতে বাড়তি চাপ পড়ছে না সড়কে৷
ঢাকার রাস্তায় কয়েকশ' গাড়ির মধ্যে সাধারণ মানুষের চড়ার জন্য মাঝেমধ্যে আসে বাস৷ সকালে অফিস টাইম ও বিকালে ঘরে ফেরার পালায় এসব বাসে একটু জায়গা পাওয়া বড়ই চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়৷ পত্রিকায় বাসের দরজার হাতল ধরে ঝুলে থাকা যুবকের ছবি দেখে বুক কেঁপে উঠেছে আরেক শহরে থাকা বড় ভাইয়ের৷ দ্রুত ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন, বলেছেন এ রকমভাবে যেন কখনও বাসে না উঠি৷
এরপরেও একবার ঘটেছে ভয় জাগানো ঘটনাটি৷ মহাখালী থেকে ধানমণ্ডিতে যেতে ফ্লাইওভারের গোড়া থেকে বাস উঠতে গিয়ে জায়গার অভাবে দাঁড়িয়েছিলাম দরজার হাতল ধরে৷ আমার পরেও ছিলেন একজন৷ অন্য একটি বাস এসে চাপ দিলে আঘাত পেয়েছিলেন ওই ব্যক্তি, বেঁচে গিয়েছিলাম আমি৷
কিন্তু বাঁচেননি তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন৷ আরেক বাসের ধাক্কায় এক হাত হারানোর পর প্রাণ হারিয়েছেন তিনি৷ সেই সঙ্গে শেষ হয়েছে বাবা-মা-হারা মাদ্রাসাপড়ুয়া দুই ভাইকে নিয়ে এই পৃথিবীতে তাঁর টিকে থাকার সংগ্রাম৷
গত এপ্রিলের শুরুর দিকে রাজীবের মৃত্যুর ধাক্কা জনমানস থেকে সরার আগেই এ রকম আরেক ঘটনায় এক পা বিচ্ছিন্ন হয়ে মারা যান গৃহকর্মী রোজিনা ইসলাম৷ গত ২০ এপ্রিল রাতে বনানীতে রাস্তা পার হওয়ার সময় বিআরটিসির একটি বাসের চাপায় তাঁর ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷
ঢাকাবাসীর মনে ছাপ ফেলা এসব দুর্ঘটনার বাইরে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান অনেকে৷ আর ঈদ এলে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে যায় কয়েক গুণ৷ বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত রোজার ঈদ ঘিরে ১১ থেকে ২৩ জুনের মধ্যে ঢাকা ছাড়া ও ফেরার পথে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ২৭৭টি দুর্ঘটনায় মোট ৩৩৯ জন নিহত এবং এক হাজার ২৬৫ জন আহত হয়েছেন৷
ঈদযাত্রায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে ২৫ জুন মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হয়৷ দূরপাল্লায় চালকদের যাতে একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে না হয়, সেজন্য বিকল্প চালক রাখার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ এর সঙ্গে সড়কের পাশে বিশ্রামাগার তৈরি, সিগনাল মেনে চলা, অনিয়মতান্ত্রিক রাস্তা পারাপার বন্ধ, সিট বেল্ট বাঁধা এবং চালক ও তার সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দেন তিনি৷
খবরটি বেশ ফলাও করে প্রচার হলেও তার বাস্তবায়নের কোনো তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি, যদিও আরেকটি ঈদযাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ৷
এরমধ্যে গত ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর রাস্তায় নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা৷ নিরাপদ সড়ক দাবিতে টানা এক সপ্তাহের বেশি ঢাকা অচল করে আন্দোলন করেছেন তাঁরা৷ লাইসেন্স পরীক্ষার পাশাপাশি তাঁরা চালকদের ট্রাফিক সিগনাল মেনে গাড়ি চালাতে বাধ্য করেছেন৷ নিয়ম না মানায় তাঁদের কাছে আটকে যেতে হয়েছে মন্ত্রী থেকে শুরু করে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও৷ প্রথমবারের মতো চালকদের নির্ধারিত লেনে রিকশা চালাতে বাধ্য করার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে৷
ছাত্র বিক্ষোভে দিনের পর দিন চলাচলে কষ্ট হলেও তাঁদের দাবিগুলোর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ৷ এছাড়া আর কোনো উপায় আছে আমাদের? এভাবে দুর্ঘটনা ঘটলে তার শিকার আমি বা আমার স্বজন হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা আছে?
একে দুর্ঘটনা বলা যায় না৷ দুর্ঘটনা প্রতিদিন ঘটে না৷ নিয়ত এভাবে মৃত্যু হত্যা–একটি মানুষ, সে যে পরিবারেরই হোক না কেন তার জন্য স্বজনদের যে মমতা, ভালোবাসা, তা কোনো অর্থেই দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের তাঁর ছেলে-মেয়ের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে কম নয়৷
প্রতিটি মানুষ তাঁর সবটুকু দিয়ে সন্তানকে মানুষ করে৷ হৃদয়ের গভীরতর অনুভূতির ছোঁয়ায় তিলে তিলে গড়ে তোলা সেই সন্তানের এভাবে মৃত্যু মেনে নেওয়া কার পক্ষে সম্ভব? অথচ আমরা কত সহজভাবে নিয়েছি এই মৃত্যু! সংবাদপত্রে কাজ করার সুবাদে আমি বুঝতে পারি, দুর্ঘটনায় এক-দুজনের মৃত্যু এখন আর কোনো বড় খবর নয় বাংলাদেশে৷
সব সয়ে যাওয়া এই মোটা চামড়ায় কিছুটা আঁচড়ে দিয়েছে শিশুরা৷ আমাদের ঘুম ভেঙেছে, যে কথা এরইমধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও স্বীকার করেছেন৷ সম্প্রতি তিনি বলেছেন, স্কুলের ছেলে-মেয়েরা তাঁদের চোখ খুলে দিয়েছে৷
আর সড়কের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের, চাপটার বড় দরকার ছিল৷
অনিয়ম রোধে এই চাপের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি স্বীকার করলেও নিরাপদ সড়কের জন্য তিনি কিছু করবেন? নাকি নিজেদের ওপর থেকে আন্দোলনের চাপ সরলেই তিনিও সরে যাবেন তাঁর কথা থেকে৷
আগের মতোই এসি রুমে বসে অফিস, পুলিশ প্রটোকল নিয়ে চলবে মন্ত্রীর চলাচল: অপরদিকে একের পর এক দেহ প্রাণহীন হবে সড়কে? এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা৷
তবে সড়কে মৃত্যু ঠেকাতে শুধু কর্তৃপক্ষ নয়, দায়িত্বশীল হতে হবে সাধারণ মানুষকেও৷ সবার আগে ট্রাফিক সিগনাল মেনে চলতে হবে৷ একটু কষ্ট হলেও জীবনটা বাঁচাতে উঠতে হবে ফ্লাইওভারে৷ চলন্ত গাড়ির ভিড়ে সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে রাস্তা পার হওয়া নিশ্চয়ই ভালোও দেখায় না৷
আর উন্নত ব্যবস্থা চাইলে নিজেদের ওই দায়িত্বটুকুও পালন করতে হবে৷ জার্মানরা তো সিগনাল ছাড়া রাস্তায় পা-ই বাড়ায় না৷