1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জুম বাগানে আগুন, ত্রাণ না নিয়ে আদিবাসীদের প্রতিবাদ

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৯ মে ২০২২

বান্দরবানের লামা উপজেলায় আদিবাসীদের কমপক্ষে ৩০০ একর জুম বাগান লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রির দৃর্বৃত্তরা পুড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ। ফলে ৪০টি পরিবার পথে বসেছে। ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশাসনের ত্রাণ সহায়তা নেননি তারা।

ছবি: Dipayan Khisa

তাদের অভিযোগ, যারা বাগান পুড়িয়ে দিয়েছে তাদেরকেও সাথে নিয়ে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে এসেছিলেন প্রশাসনের লোকজন।

গত ২৭ এপ্রিল সকাল থেকে প্রায় ১২ ঘন্টা ধরে ওই জুম বাগান পোড়ানো হয় বলে অভিযোগ। কয়েক কিলোমিটার দূরে পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় বিকেলে।  ফায়ার সার্ভিসের লোকজন যায় দুপুরে। এই মৌসুমে জুমের ফসল বিক্রি করে ওই আদিবাসীদের সংসার চলে । সেই ফসল পুড়িয়ে ফেলায় তাদের এখন বলতে গেলে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।

সব পুড়িয়ে দিয়েছে

লামা উপজেলাা লাংকমপাড়া, রেংয়েনপাড়া ও জয়চন্দ্রপাড়ায় জুমের বাগানগুলো পুডিয়ে দেয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের একজন রেংয়েন কার্বারি বলেন, "আগুন দিয়ে ধান, আনারস, কাঁঠাল, আম , বড়ই, কলার বাগান পুরোপুরি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাঁশঝাড়গুলোও রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি ছরার সবজি বাগান। সব ধ্বংস হয়ে গেছে। লামা রাবার বাগানের অনেক লোকজন একসাথে এসে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমাদের কিছু করার ছিল না।”

বাঁশঝাড়গুলোও রেহাই পায়নি: রেংয়েন কার্বারি

This browser does not support the audio element.

তিনি আরো বলেন, "আমরা লামা ছাড়াও আলি কদম, বান্দরবান সব জায়গার পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু পুলিশ ঠিক সময়ে আসেনি। আমাদের ৪০টির মতো পরিবারের লোকজন এখন না খেয়ে আছি। ছেলে-মেয়ে, নাতি-পুতি নিয়ে এক বেলা খেয়ে থাকি।”

তিনি বলেন, "পুলিশ প্রথমে মামলা নেয়নি। আদালতে যাওয়ার পর আদালতের নির্দেশে পরে মামলা নিয়েছে। দুইজনকে  ধরেছে। কিন্তু শুনছি তারা জামিন পেয়ে যাবে। তারা জামিন পেলে আমাদের অবস্থা আবার খারাপ হবে।”

লামা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ পর রবিবার ক্ষতিগ্রস্ত ওই আদিবাসীদের গ্রামে চালসহ আরো কিছু খাদ্যপণ্য নিয়ে যাওয়া হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা জাভেদ কায়সার জানান, আদিবাসীরা ত্রাণ নিতে অস্বীকার করেন, ফিরিয়ে দেন৷ এ প্রসঙ্গে রেংয়েন কার্বারি বলেন, " প্রশাসনের লোকজনের সাথে আমাদের জুম বাগানে যারা আগুন দিয়েছেন তারাও ছিলেন। সেই কারণেই আমরা ত্রাণ নেইনি।” নির্বাহী কর্মকর্তাও স্বীকার করেন রাবার বাগানের একজন ছিলেন, তবে তাকে তারা চিনতেন না।

আগুনের ভয়াবহ চিত্র

ডয়চে ভেলের হাতে জুমের বাগান পুড়িয়ে দেয়ার যে ছবি ও ভিডিও ফুটেজ এসেছে তাতে আগুনের ভয়াবহতা স্পষ্ট। ওই এলাকার জুমের পাহাড় ও ছরায় পোড়া গাছপালা ছাড়া আর কিছুই নেই। এমনকি ঘাসও পুড়ে গেছে। বাঁশঝাড়ের কিছু বাঁশ পুড়ে খাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফলদ গাছগুলো জীবন্ত অঙ্গার হয়েছে। ফসল আর ফল পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত আরেকজন ইংচ্যং ম্রো বলেন, "সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাবার বাগানের লোকজন আগুন দেয়। তাদের সাথে আরো অনেক লোক ছিল। তারা ছিল লাঠিসোঁটা এবং সশস্ত্র অবস্থায়। আগুন রাত সাড়ে ১০টার দিকে নেভে। আগুনে জুম বাগানসহ চারটি বাড়ি এবং জুমের মাচাও পুড়ে যায়।” 

তারা ছিল লাঠিসোঁটা এবং সশস্ত্র অবস্থায়: ইংচ্যং ম্রো

This browser does not support the audio element.

তিনি বলেন, তাদের এলাকা থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরেই একটি পুলিশ ফাঁড়ি আছে। তাদের খবর দেয়ার পরও তারা আসে বিকেল সাড়ে চারটার পরে। তবে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন দুপুর ১টার দিকে আসে। কিন্তু আশপাশে পানি না থাকায় আগুন নিভাতে তাদের দেরি হয়।

রাবার বাগানের শ্রমিকরা এখনো হুমকি দিচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, "শ্রমিকদের বলা হয়েছে, তারা যদি আমাদের মেরে ফেলতে পারে, তাহলে প্রতিজনের জন্য ১০ লাখ টাকা করে দেবে। পুলিশকে তারা ম্যানেজ করবে। জুমের পোড়া পাহাড়ে এখন আমরা যেতে পারছি না। আবার চাষ করতে পারবো কিনা জানি না।”

না খেয়ে আছেন তারা

আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা জানান, এখন ওই এলাকায় খাদ্য সংকট প্রবল। বলতে গেলে তারা না খেয়ে আছেন। সবচেয়ে কষ্টে আছে শিশুরা। তারা খাবার না পেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। পানীয় জলেরও সংকট চলছে ওই এলাকায়।

তিনি বলেন,  এখন জুমের ফসল বপণ করার মৌসুম। এই সময়ে এমনিতেই তাদের অভাব থাকে, তারা নানা ফল ও সবজি বিক্রি করে এই সময়ে চলে। কিন্তু সেগুলো পুড়িয়ে দেয়ায় তারা চোখে অন্ধকার দেখছেন। এই পরিস্থিতিতে নতুন ফসল বপণও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই পর্যন্ত তারা কোনো ধরনের খাদ্য বা অন্য কোনো সহয়তা পাননি।

তিনি অভিযোগ করেন, "এখানকার পুলিশ ও প্রশাসন দখলদারদের পক্ষেই কাজ করে। তা না হলে এটা পোড়ানো সম্ভব হতো না।”

পুলিশ প্রশাসন যা বলছে

এই ঘটনায় আদালতের নির্দেশে মোট আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরো অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ এ পর্যন্ত মাত্র দুইজনকে আটক করেছে। তারা হলেন: লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রির ম্যানেজার মো. আরিফ হোসেন ও লম্বা খোলা গ্রামের বাসিন্দা মো. দেলোয়ার হোসেন। তবে আগুন দেয়ার মূল হোতা রাবার ইন্ডাষ্ট্রির পরিচালক মো. কামাল উদ্দিন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন ও জহিরুল ইসলামকে পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করেনি। তাদের নেতৃত্বেই আগুন দেয়া হয় বলে অভিযোগ। তবে লামা থানার ওসি মো. শহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, " আমরা দুইজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ড চেয়েছিলাম। কিন্তু আদালত তাদের রিমান্ড বা জামিন কোনোটাই দেয়নি। অন্য আসামিরা পলাতক আছে, গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।”

এলাকার পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে: মো. শহিদুল ইসলাম চৌধুরী

This browser does not support the audio element.

তিনি দাবি করেন, "পুলিশ খবর পেয়েই গিয়েছে, তবে পাহাড়ি রাস্তা হওয়ায় যেতে  একটু দেরি হয়েছে। এলাকার পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে। ওই ভূমিতে এখন সবাই যেতে পারবেন। আদালত সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি।”

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অনেক চেষ্টার পর রাবার ইন্ডাষ্ট্রির সুপারভাইজার জসিম উদ্দিনকে পাওয়া যায়। তিনি দাবি করেন, " স্যাররা কেউ পালিয়ে যাননি। তারা নানা কাজ-কর্মে ব্যস্ত আছেন। আর আমরা যেসব জমি কিনেছি, সেখানেই অবস্থান করছি। ওইদিন কারা আগুন দিয়েছে তা আমরা জানি না। শুনেছি এমনিতেই আগুন লেগেছে। আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।”

তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় ভূমি দস্যুদের সহায়তায় ওই এলাকায় আরো ৩০০ একর জমি দখলের অভিযোগ আছে। সেই অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমাদের রাবার বাগান অনেক বড় হবে। আমরা জমি কিনছি।”

লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা জাভেদ কায়সার বলেন, "আগুনের ঘটনার পর আমি ওই এলাকায় গিয়েছি। সেখানে এখনো রাবার বাগানের লোকজন আছে। আগুন কারা লাগিয়েছে, তা জানার জন্য আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি।  আর মামলাও হয়েছে। আগুনে ধান, ফল ও সবজি বাগান পুড়ে গেছে।”

তিনি আরো বলেন, "ওই জমি এখন কারুর  না। ওটা ওভাবেই পড়ে আছে।”

তার কথা, " আমরা চেষ্টা করেছি তাদের খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা দিতে, কিন্তু তারা নেয়নি। আমরা জানতাম না, ওই সময়ে সেখানে রাবার কোম্পানির লোকজন ছিল।”

এর জবাবে ইংচ্যং ম্রো বলেন," ওটা ছিল যারা আগুন দিয়েছে তারাসহ ওই এলাকার চেয়াম্যানের দেয়া চাল ও ত্রাণ। আমরা তা নেইনি, নেবো না। আমরা সরকারের সহায়তা চাই।” তিনি অভিযোগ করেন," স্থানীয় প্রভাবশালীরাও এই আগুন দেয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়িত।”

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ