আন্দোলনে শহীদদের পরিবার বিচার নিয়ে হতাশার কথার জানিয়েছেন, জানিয়েছেন কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার কথা৷
শহীদ আবু সাঈদের স্মৃতিতে গ্রাফিত্তি৷ ছবি: DW
বিজ্ঞাপন
গত বছরের ১৬ জুলাই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন আবু সাঈদ৷
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ৷ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ৷
আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়৷ এই ঘটনায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের গণঅভ্যুত্থানে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
আবু সাঈদের দুই দিকে দুই হাত তুলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিটা বাংলাদেশের মানুষের মনে গেঁথে গেছে৷ কিন্তু মৃত্যুর এক বছর পর তার পরিবারের সদস্যদের মুখে শুধুই হতাশা। না পেয়েছেন বিচার, না পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ।
আবু সাঈদের ভাই আবু হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ। সে তো আইকনিক শহীদ। তার আত্মত্যাগ জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে রাজপথে লড়াই করতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, আসলে সবাই প্রত্যাশা করেছিল দিনে দুপুরে আবু সাঈদকে গুলি করে মারা হয়েছে এর বিচার দ্রুততম সময়ে হবে। বিচার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে। তদন্ত করতেই এক বছর পার হয়েছে। এখনও আমরা আশাবাদী ড. ইউনূসের শাসনামলেই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। ”
জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত আরও কয়েকজনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে। সবার পরিবারেই বিচার নিয়ে হতাশা। যে কারণে স্বজনরা জীবন দিয়েছেন, সেই প্রত্যাশিত বাংলাদেশ এখনও মেলেনি। খুন, চাঁদাবাজি, নিরাপত্তাহীনতার এই দেশ নিয়ে হতাশার কথা জানিয়েছেন তারা। এখন পর্যন্ত সরকার মোট ৮৪৪ জন শহীদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে।
কোটাসংস্কার আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ
কোটা সংস্কার নিয়ে দ্বিতীয় দফা টানা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১ জুলাই৷ আন্দোলন সংঘর্ষে রূপ নেয় ১৫ জুলাই৷ প্রথম আলোর বরাত দিয়ে ২৫ জুলাই পর্যন্ত ২০২ জন হওয়ার কথা জানিয়েছে এপি৷ ছবিঘরে থাকছে ঘটনা পরিক্রমা৷
ছবি: Rajib Dhar/AP/picture alliance
৯ জুলাই, মঙ্গলবার
হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থীর আবেদন৷ আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা চার ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নেন৷ আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে পরদিন সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়৷
ছবি: Zabed Hasnain Chowdhury/IMAGO/SOPA Images
১২ জুলাই, শুক্রবার
কোটা সংস্কারের দাবিতে শুক্রবার ছুটির দিনেও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল শেষে শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন৷ রেলপথ অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
১৩ জুলাই, শনিবার
সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা৷ পরের দিন রোববার গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি বরাবর এ স্মারকলিপি দেবেন আন্দোলনকারীরা৷ তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, বিচারাধীন বিষয়ে সরকারের এখন কিছু করার নেই৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
১৪ জুলাই, রোববার
গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’ এ মন্তব্যের মাধ্যমে তাদের অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরে চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ হয়৷
ছবি: Mamunur Rashid/NurPhoto/picture alliance
১৪ জুলাই, রোববার
একই দিনে পদযাত্রা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডের কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন৷
ছবি: Press Information Depart of Bangladesh
১৫ জুলাই, সোমবার
রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলন থেকে আত্মস্বীকৃত রাজাকার ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতা বা আচরণের প্রকাশ ঘটেছে৷ এর জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত৷ বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে৷ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে৷
ছবি: Habibur Rahman/IMAGO/ABACAPRESS
১৬ জুলাই, মঙ্গলবার
সারা দেশে দিনভর ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ হয়৷ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকার সমর্থকেরা৷ এতে নিহত হন ছয়জন৷ রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটে নিহত হন৷
ছবি: Zabed Hasnain Chowdhury/NurPhoto/IMAGO
১৭ জুলাই, বুধবার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন অব্যাহত৷
ছবি: Zabed Hasnain Chowdhury/NurPhoto/IMAGO
১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার
দেশব্যাপী প্রতিরোধ, সহিংসতা, সংঘর্ষ ও গুলি৷ মোট নিহত ২৭ জন৷ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশ ছিল প্রায় অচল৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার
রাজধানী ছাড়াও দেশের ৪৭টি জেলায় দিনভর বিক্ষোভ, অবরোধ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, পুলিশের হামলা-গুলি ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে৷ এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত দেড় হাজার৷ সারা দেশে বিজিবি মোতায়েন৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
১৯ জুলাই, শুক্রবার
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে৷ রাজধানী ঢাকা ছিল কার্যত অচল, পরিস্থিতি ছিল থমথমে৷
ছবি: AFP
১৯ জুলাই, শুক্রবার
দেশের বিভিন্ন জেলাতেও ব্যাপক বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সহিংসতা হয়৷ রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি, সেনাবাহিনী মোতায়েন৷ টেলিয়োগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা সম্পূর্ণ বন্ধ৷ একদিনেই নিহত ৮৪৷
ছবি: Rajib Dhar/AP/picture alliance
২০ জুলাই, শনিবার
দেশজুড়ে কারফিউ ও সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি সাধারণ ছুটি ঘোষণা৷ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, ধাওয়া ও গুলি৷ উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা ও মিরপুর৷ এ ছাড়া মোহাম্মদপুরেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ শনিবার নিহত ২৬ জন৷এদিন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
২১ জুলাই, রোববার
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়, কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩%; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ %; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ % এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ % নির্ধারণ করা হলো৷ রোববার নিহত ১৯ জন৷ সমন্বয়ক নাহিদকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তি৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP
২২ জুলাই, সোমবার
কোটাপ্রথা সংস্কার করে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তৈরি করা প্রজ্ঞাপন অনুমোদন প্রধানমন্ত্রীর৷ সব মিলিয়ে ছয় দিনে মোট ১৮৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়৷
ছবি: Zabed Hasnain Chowdhury/NurPhoto/IMAGO
২৩ জুলাই, মঙ্গলবার
কোটাপ্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি৷ মঙ্গলবার পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে ১৯৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে৷ মৃত্যুর এই হিসাব কিছু হাসপাতাল, মরদেহ নিয়ে আসা ব্যক্তি ও স্বজনদের সূত্রে পাওয়া বলে জানিয়েছে দৈনিক প্রথম আলো৷ সব হাসপাতালের চিত্র পাওয়া যায়নি বলেও জানিয়েছে তারা৷
ছবি: Rajib Dhar/AP/picture alliance
২৩ জুলাই, হাসপাতালের তথ্য
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিশু-কিশোর এবং নারীও রয়েছেন৷৷ আহতদের অনেকে চোখে রাবার বুলেট ও ছররা গুলি এবং শরীরের অন্যান্য জায়গায় গুলির ক্ষতচিহ্ন নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷
ছবি: Rajib Dhar/AP/picture alliance
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, সংঘর্ষে তিনজন পুলিশ সদস্য এবং একজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছেন৷ ১ হাজার ১১৭ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন৷ এর মধ্যে গুরুতর আহত ১৩২ জন৷ তিনজন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রয়েছেন৷
ছবি: Anik Rahman/AP/picture alliance
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির বর্ণনা
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদ সংস্থা এপিকে জানিয়েছেন, সংঘর্ষের সময় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভির সদর দপ্তরে হামলা চালানো হয়েছে৷ এছাড়া ঢাকার ফ্লাইওভারে দু’টি টোল প্লাজা, এক্সপ্রেসওয়েতে এবং দুইটি মেট্রোরেল স্টেশনে আগুন দেয়া হয়েছে৷ কয়েকশ’ সরকারি ভবনে আগুন দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন আইনমন্ত্রী৷
ছবি: K M ASAD/AFP
ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য
ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এপিকে জানিয়েছেন, ছয় দিন বন্ধ থাকার পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় আংশিকভাবে চালু করা হয়েছে৷ তার অভিযোগ, আন্দোলনকারীরা প্রধান তথ্য কেন্দ্রে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে ফলে ফাইবার অপটিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে৷
ছবি: AFP
গ্রেপ্তার
সারা দেশ থেকে এখন পর্যন্ত আড়াই হাজারেও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা এএফপি৷ সারাদেশে অন্তত ২৭ হাজার সেনা মোতায়েন আছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ৷ ২৪ জুলাই কারফিউ শিথিল করা হলেও এখনো তা বহাল আছে৷
ছবি: Abu Sufian Jewel/AFP
21 ছবি1 | 21
বাড়ছে বিচার নিয়ে হতাশা
জুলাই আন্দোলন চলাকালে প্রথম নারী শহীদ নাঈমা সুলতানা। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে রাজধানীর উত্তরার বাসার বারান্দায় শুকাতে দেওয়া কাপড় আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সে। চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক গোলাম মোস্তফা ও আইনুন নাহার দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে নাঈমা ছিল দ্বিতীয়। সে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ত।
বিজ্ঞাপন
নাঈমার মা আইনুন নাহার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিচারের অগ্রগতি আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ড. ইউনূস আমাদের কথা দিয়েছিলেন ২০২৪ এর প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার উনি করবেন। কিন্তু দীর্ঘ এক বছরে আমরা সেই বিচার দেখিনি। অথচ নাঈমা হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। স্নাইপার নাঈমাকে গুলি করেছে। সবকিছু ডকুমেন্ট থাকার পরও আমরা বিচারটা দেখতে পাচ্ছি না। আমরা এই বিচারটা চাই। যাতে ভবিষ্যতে যেই সরকারই আসুক এভাবে নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের হত্যা করতে না পারে। আমরা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছি। একদিন আমরা সেখানে গিয়ে কথাও বলে এসেছি। এরপর কি হয়েছে তা আমরা জানি না। কেউ আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেনি। আমরা সরকারের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চপত্র পেয়েছি। কিন্তু সেটা তিন মাস হয়ে গেলেও অ্যাকটিভ হয়নি। অন্যদেরটা একটিভ হলেও আমাদেরটা হচ্ছে না। অথচ দ্বিতীয় দফায় ২০ লাখ টাকা দেওয়া শুরু হচ্ছে।”
‘আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, আবু সাঈদকে গুলি করে মারার বিচার দ্রুততম সময়ে হবে’: আবু হোসেন
This browser does not support the audio element.
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার আশরাফ আলী ও রেহানা বিবির তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ছিল রিতা আক্তার (১৭)। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ের জন্য চাপ দেয়া হয় রিতাকে৷ কিন্তু রিতা মা-বাবাকে বলেছিল, "ডাক্তার হব। মা-বাবাকে উপার্জন করে না খাওয়ানো পর্যন্ত বিয়ে করব না।” পড়ার প্রতি রিতার আগ্রহ দেখে পরিবারটি গ্রাম থেকে ঢাকার মিরপুরে চলে আসে। গত বছরের জুন মাসে ঢাকায় আসে রিতা। তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয় দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজে। ৫ আগস্ট বেলা দেড়টায় পরিবার খবর পায়, আন্দোলনে থাকার সময় মিরপুর ১০ নম্বরে ফুটওভারব্রিজের সামনে রিতা মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে। চার হাসপাতালে ছোটাছুটি করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মর্গে মেয়ের পা দেখে শনাক্ত করেন মা রেহানা বিবি।
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখন পর্যন্ত আমরা কোন বিচার পাইনি। গতকাল শুনলাম ড. ইউনূস বলেছেন, তারা এই সরকারের সময়েই বিচারগুলো করবেন। আমরা বিচারের আশায় পথ চেয়ে বসে আছি।”
‘আমরা বিচারের আশায় পথ চেয়ে বসে আছি’: রেহানা বিবি
This browser does not support the audio element.
রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল গোলাম নাফিজ। ওই শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান থেকেই এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল সে। গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে বন্ধুদের সঙ্গে শাহবাগে যাওয়ার সময় ফার্মগেটে ওভারব্রিজের নিচে গুলিবিদ্ধ হয় সে। রিকশার পাদানিতে পড়ে থাকা নাফিসের নিথর দেহের ছবি কাঁদিয়েছে সব মানুষকে। তাদের বাসা মহাখালীতে।
নাফিজের বাবা গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিচার তো এখনও পাইনি। বিচারের আশায় আমরা দিন গুনছি। আমরা এখনও আশা করি, ড. ইউনূসের শাসনামলেই এই বিচারের কাজ শেষ হবে।”
হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট অন্য আরো ৮ জনের সঙ্গে গুলিতে নিহত হন সাংবাদিক সোহেল আখুঞ্জি। দৈনিক লোকালয় বার্তা নামে হবিগঞ্জের একটি স্থানীয় দৈনিকে কাজ করতে তিনি। তার স্ত্রী মৌসুমী আক্তার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার স্বামীর বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ নেই। আমার ছোট ছোট তিনটা বাচ্চা। ছোট মেয়ের বয়স আড়াই বছর। ফলে মামলা করার সামর্থ্য আমাদের নেই। ওখানে ৯ জন একসঙ্গে মারা গিয়েছিলেন। ওই ঘটনায় একজন মামলা করেছিলেন। ফলে আমরা আলাদাভাবে আর মামলা করিনি। ঘটনার পরপর পুলিশ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল বলে শুনেছি। পরে আর কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। বিচারের আশায় দিন গুনছি আমরা।”
ঢাকার দেয়ালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছোঁয়া
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকার দেয়ালগুলো ভরে ওঠে বিপ্লবী স্লোগানে৷ সবাই মিলে ঢাকার দেয়ালগুলো বর্ণিল গ্রাফিতিতে রাঙিয়ে তুলেছেন৷
ছবি: DW
গ্রাফিতিতে ভাষা আন্দোলন ও দেশাত্মবোধ
রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব, মোহাম্মদপুর ও বিভিন্ন এলাকায় স্লোগানের সঙ্গে অনেকে গ্রাফিতি এঁকেও প্রতিবাদ জানান৷ বিভিন্ন রোডে এসব গ্রাফিতি আঁকেন তারা৷ বিভিন্ন দেয়ালেও গ্রাফিতির মাধ্যমে নানা দাবি তুলে ধরা হয়েছে৷
ছবি: DW
আমরা তোমাদের ভুলবো না
শিক্ষার্থীদের দেয়াল লিখন এবং গ্রাফিতিতে স্থান পেয়েছে ছাদে গিয়ে গুলিতে নিহত ছোট্ট রিয়াসহ যারা মারা গিয়েছেন তাদের নাম৷
ছবি: DW
পানি লাগবে পানি?
মৃত্যুর আগে মুগ্ধর স্নিগ্ধ হাসিতে বলা ‘পানি লাগবে পানি?’ শোভা পাচ্ছে দেয়ালগুলোতে৷
ছবি: DW
লাশের মিছিল ও রক্তাক্ত বাংলাদেশ
আন্দোলনে নিহতদের রক্তে রঞ্জিত লাল সবুজের বাংলাদেশ৷ দেয়ালে থাকছে তার প্রমাণ৷
ছবি: DW
সবাই মিলে গড়বো দেশ
ছোট বড় সব বয়সিরা এক সাথে মিলে রাঙিয়ে তুলছে ঢাকার দেয়ালগুলো৷
ছবি: DW
গড়বো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ
সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলে নতুন বাংলাদেশ হবে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার- এই প্রত্যাশা শোভা পাচ্ছে দেয়াললিখনে৷
ছবি: DW
৩৬ জুলাই
২০২৪ সালে বাংলাদেশে জুলাই মাস শেষে আগস্ট আসেনি৷ জেন জি-র ভাষায় ৩৬ জুলাই দেশ স্বাধীনতা পায়৷ সেই তারিখটিই তুলির আঁচড়ে দেয়ালে লিখে রাখা হচ্ছে৷
ছবি: DW
7 ছবি1 | 7
কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ কতদূর?
আবু সাঈদের ভাই আবু হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার ভাই তো জীবন দিয়েছেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে। প্রথম যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা কোটার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমার ভাই বা অন্যরা জীবন দিয়েছেন সেই বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের পরিপূর্ণ রূপ আমরা পাইনি। আমরা এখনও দেখছি, সেই চাঁদাবাজি, দিনে দুপুরে মানুষ হত্যা হচ্ছে। আমরা চাই সামনে যে নির্বাচিত সরকার আসবে তারা যেন স্বৈরশাসন থেকে শিক্ষা নেয়। তারা যেন জনবান্ধব সরকার হয় সেটা আমরা প্রত্যাশা করি। তবে এক বছর পর এসেও কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যমুক্ত দেশ আমরা পাইনি।”
নাঈমা সুলতানার মা আইনুর নাহার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "চারদিকের খবর দেখে তো বোঝা যায় কি অবস্থা! এখনও খুন হচ্ছে। মানুষের জীবন যাচ্ছে। এই হত্যাগুলোর বিচার যদি করা যেত তাহলে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হতো।”
‘সবকিছু ডকুমেন্ট থাকার পরও আমরা বিচারটা দেখতে পাচ্ছি না’: আইনুন নাহার
This browser does not support the audio element.
রিতা আক্তারের মা রেহেনা বিবি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখনও তো অস্থায়ী সরকার। আমরা দেখছি, ড. ইউনূস চেষ্টা করছেন। স্থায়ী সরকার না আসা পর্যন্ত বোঝা যাবে না। যে গুলিতে আমার মেয়ে মারা গেল, এমনভাবে যেন আর কারো মেয়েকে জীবন দিতে না হয়। এমন স্বৈরাচারী সরকার যেন না আসে। যেভাবে পাখির মতো গুলি করে আমার মেয়েকে মারা হয়েছে, অন্য সন্তানদের মারা হয়েছে এমন সরকার যেন আর না আসে।”
গোলাম নাফিজের বাবা গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখনও তো মানুষ খুন হচ্ছে। চাঁদাবাজি হচ্ছে। এমন বাংলাদেশের জন্য তো আমার ছেলে জীবন দেয়নি। আমরা প্রত্যাশা করি, এই দেশটা অনেক সুন্দর হবে। এখানে কোন অপরাধ থাকবে না, চাঁদাবাজি থাকবে না। আমার ছেলের মতো কাউকে জীবন দিতে হবে না।”
সোহেল আখুঞ্জির স্ত্রী মৌসুমী বলেন, "যে বাংলাদেশের জন্য আমার স্বামী জীবন দিয়েছেন সেই বাংলাদেশ তো আমরা পাইনি। এখনও তো দেশে নিরাপত্তা নেই। ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। বাড়ি থেকে বের হতে ভয় লাগে। বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যেতে ভয় লাগে। এমন বাংলাদেশ তো চাইনি। আমরা চাই দেশটা যেন শান্ত থাকে। সবার যেন নিরাপত্তা থাকে। যে ভাইয়েরা মারা গেছে, তাদের হত্যাকারীদের ধরা হয়নি। বিচার হয়নি, এমন দেশ তো আমরা চাইনি।”
গত বছরের ২০ জুলাই শনির আখড়ায় টিসিবির পণ্য বিক্রি করছিলেন ইউসুফ সানোয়ার। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। ইউসুফ সানোয়ারের বোন বিউটি বেগম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখনও আমরা কোন বিচার পাইনি। বিচারের আশায় আছি। এক বছর পর এসে মনে হচ্ছে, সবাই স্বার্থপর হয়ে গেছে। আগে যারা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, এখন কাছে গেলে কথাও বলেন না। আমরা চাইলেও কারও সঙ্গে দেখা করতে পারি না। এমন অবস্থায় আদৌ বিচার পাব কিনা জানি না। এমন দেশের জন্য তো আমার ভাই জীবন দেয়নি।”