জুলাই সনদ ও গণভোট: দলগুলো কি সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবে?
৬ নভেম্বর ২০২৫
সরকারের আল্টিমেটামের মধ্যেই বিএনপি তার নির্বাচনি কার্যক্রমের গতি বাড়িয়েছে৷ আর জামায়াত তাদের দাবি নিয়ে আন্দোলন বেগবান করছে৷ জামায়াতসহ সমমনা আট ইসলমী দল ১১ নভেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছে৷
গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘গণভোট কবে অনুষ্ঠিত হবে ও এর বিষয়বস্তু কী হবে এসব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ’ রয়েছে তা দূর করার জন্য তারা যাতে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে৷ ‘দ্রুততম সময়ে (সম্ভব হলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে) সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা প্রদান করার আহ্বান জানানো হয়' সরকারের পক্ষ থেকে৷
সরকারের ওই আল্টিমেটামের পর বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা শুরু করেছে৷বিএনপি৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৭ আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণা করেছে৷ গণসংহতি আন্দোলনও প্রার্থী তালিকা দেয়া শুরু করেছে৷ তরুণদের দল এনসিপিও ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে বলে জানিয়েছে৷ জামায়াতে ইসলামী আগেই ৩০০ আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে৷ কিন্তু জামায়াতসহ সমমনা আটটি ইসলামী দল জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট এবং সংসদের উভয় কক্ষে পিআর (আনুপাতিক) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে৷ বিএনপি অনড় রয়েছে একইদিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনে৷ এনসিপিও এ বিষয়ে নিজেদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে৷
তবে সরকারের আহ্বানের তিন দিন পেরুলেও নিজেদের মধ্যে সমঝোতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনও বড় কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না৷
আন্দোলন রেখেই আলোচনা করতে চায় জামায়াত
জাময়াতসহ তাদের সমমনা ৮টি দল জাতীয় নির্বাচনের আগে নভেম্বরেই গণভোট চায়৷ বৃহস্পতিবার পাঁচ দফা দাবি আদায়ে যমুনা অভিমুখে পদযাত্রা করে সরকারকে স্মারকলিপি দিয়েছে৷ তাদের দাবির মধ্যে উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথাও আছে৷ এর আগে গত বুধবার একই দাবিতে তারা নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করে৷ ইসলামি আটটি দলের মধ্যে রয়েছে-জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি৷ তারা ১১ নভেম্বর তারা ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছে৷ তাদের পাঁচ দফা দাবি হলো: জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি এবং ওই আদেশের ওপর নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট আয়োজন করা; আগামী জাতীয় নির্বাচনে উভয় কক্ষে বা উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি চালু করা; অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য লেভেল প্লেইয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; ‘ফ্যাসিস্ট' সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং ‘স্বৈরাচারের দোসর' জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা৷ তারা বুধবারও নির্বাচন কমিশনে গিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি জানিয়েছে৷
সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতার আহ্বান জানানোর পর ওইদিনই (৩ নভেম্বর) জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুলাহ মোহাম্মদ তাহের সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান৷ তিনি একইসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টাকে আলোচনায় রেফারির ভুমিকায় দেখতে চান৷ জামায়াতের ওই আহ্বানে এখনো সাড়া দেয়নি বিএনপি৷
এদিকে বৃহস্পতিবার পল্টন মোড়ে দলের ‘গণমিছিল-পূর্ব' এক সমাবেশে সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘‘সোজা আঙুলে যদি ঘি না উঠে, তাহলে আঙুল বাঁকা করবো৷ কিন্তু ঘি আমাদের লাগবেই৷ সুতরাং যা বোঝাতে চাই বুঝে নিন৷ নো হ্যাংকি প্যাংকি, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট লাগবেই৷''
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নিতে দলের নায়েবে আমীর ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ তারা বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা বলছেন৷ বিএনপির সঙ্গে তারা ফোনে কথা বলেছেন৷ বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খানকে বিএনপি দায়িত্ব দিয়েছে৷ প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু আলোচনা হয়েছে৷ আরো আলোচনা হবে৷''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সরকার সাত দিনের যে কথা বলেছে সেটা বাড়তে পারে৷ আলোচনা চলছে প্রয়োজনে সময় বাড়বে৷ আমরা মনে করি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতা হওয়া উচিত৷ সব পক্ষ যারা অবস্থান থেক কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও সমঝোতা প্রয়োজন৷ তবে আমাদের দাবি আদায়ে সাত দলকে সাথে নিয়ে আমাদের আন্দোলন চলমান থাকবে৷''
একইদিনে গণভোট ও নির্বাচনের পক্ষে এখন এনসিপি
অন্যদিকে এনসিপিসহ সমমনা নয়টি দল সমঝোতার একটি উদ্যোগ নিচ্ছে৷ ওই ৯টি দল বুধবার বৈঠকও করেছে৷ দলগুলো হলে: এনসিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, ভাসানী জনশক্তি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন৷
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘‘আমরা নয়টি দল আসলে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে করার পক্ষে৷ আমাদের মধ্যে এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে৷ আর সংস্কারও করতে হবে৷ তবে নির্বাচন নিয়ে আমরা একট ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি৷ বিভিন্ন ইস্যু তুলে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে৷ আমরা সেই ব্যাপারে সতর্ক আছি৷ আমরা যেসব বিষয়ে একমত হয়েছি তা নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গেও কথা বলতে চাই৷ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে৷ কিন্তু এখনো চূড়ান্ত কোনো সাড়া পাইনি৷''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তী সরকারশেষ সময়ে সমঝোতার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে দিয়ে আসলে দায়িত্ব এড়ানোর কৌশল নিয়েছে৷ এই কাজটি তাদের৷ তারা প্রায় দেড় বছর ধরে তাহলে কী করলো৷ এরমধ্যে সরকারের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে৷''
এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক মনিরা শারমিন বলেন, ‘‘আমরা এর আগে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চাইলেও এখন মনে করি সরকার চাইলে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট করতে পারে৷ আমাদের মূল বিষয় হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন৷ আমরা সেদিকে জোর দিচ্ছি৷''
এই বিষয়ে তিনি বিএনপি ও জামায়াত দুই দলের সমালোচনা করেন৷ বলেন, ‘‘জামায়াত জুলাই সনদ, গণভোট, উভয় কক্ষে পিআর এই বিষয়গুলোকে আসলে বার্গেইনিং চিপ হিসাবে ব্যবহার করছে৷ আর বিএনপিতে সংস্কার নিয়ে নানা আপত্তিকর কথা বলছে৷''
এই ৯টি দল নির্বাচনি জোট নিয়ে আলোচনা করেছে৷ মনিরা শারমিন বলেন, ‘‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নে প্রয়োজনে আমাদের আন্দোলনে যাওয়ারও পরিকল্পনা আছে৷ জুলাই সনদের আদেশ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জারি করবেন, রাষ্ট্রপতি নয়৷ রাষ্ট্রপতি জারি করলে সেটা আমরা মানবো না৷''
সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএনপি
বিএনপির কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩ নভেম্বর হঠাৎ করেই দলটির নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পেছনে কারণ রয়েছে৷ ওইদিন দুপুরে সরকারের পক্ষ থেকে ব্রিফিং-এ বক্তব্য দেয়ার পরই তারা নির্বাচনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়৷ সরকার নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট ঘোষণা না দেওয়ায় দলটির এই ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে আওয়াজ বাড়াতে চায়৷
সমঝোতা নিয়ে কাজ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব না হলেও ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সের সঙ্গে৷ তিনি বলেন, ‘‘আসলে এখন পুরো দেশের মানুষ নির্বাচনমুখী৷ নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষ এখন ঐক্যবদ্ধ৷ আমাদের অবস্থান পরিষ্কার৷ আমরা বলেছি জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে করার জন্য৷ যাতে খরচ কম হয়৷ আর আমরা তো সংস্কারের পক্ষে৷ জুলাই সনদ নিয়ে যে প্রতারণা করা হয়েছে তাও আমরা বলেছি৷ আমরা এখন নির্বাচনের সাথে আছি৷''
তিনি জানান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার যে আহ্বান জানানো হয়েছে তা বিএনপি আমলে নিয়েছে৷ বলেন, ‘‘হাইকমান্ড এটা নিয়ে ভাবছে৷ হয়তো কোনো একটা উদ্যোগ নেয়া হতে পারে৷ তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্তের কথা আমার জানা নাই৷ তবে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হয় এমন যে কোনো প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমরা৷''
এই বিষয়ে সরকারই সিদ্ধান্ত নিতে পারে উল্লেখ করেন তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলো বসে সিদ্ধান্ত নিলে অযথা সময়ক্ষেপণ হবে৷ আর এখন রাজনৈতিক দলগুলো একসাথে বসার পরিবেশ আছে বলে আমি মনে করি না৷''
এ নিয়ে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি৷ তবে একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি জানিয়েছেন সরকার রাজনৈতিক দলগুলো কী করছে সেদিকে নজর রাখছে৷ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন৷ দলগুলো শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতায় না আসলে সরকার এককভাবেই নির্বাচন ও গণভোটের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে৷ তবে তার আগে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরেক দফা বৈঠকের সম্ভাবনা আছে৷