‘সেনা-সমর্থিত’ সরকারের সময় ডিআইজি প্রিজন ছিলেন মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের কারাগার সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা এবং ধারণার কথা জানিয়েছেন তিনি৷
‘সেনা-সমর্থিত’ সরকারের সময় ডিআইজি প্রিজন ছিলেন মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকীছবি: Private
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে: আপনি তো ডিআইজি প্রিজন হিসেবে অনেক দিন দায়িত্ব পালন করেছেন৷ দুর্নীতির কোন দিকগুলো আপনার চোখে পড়েছে?
মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী: বড় জেলে সবাই পোস্টিং চায়৷ কারণ, ওই সব কারাগারে বন্দির সংখ্যা বেশি৷ বন্দি বেশি হলে লাভও বেশি-এই মনোভাব নিয়ে যারা কারাগারে কাজ করেন, তারা কখনোই কারাগারের ভালো করতে পারবেন না৷ ঘুরে ফিরে কারা পোস্টিং নেয় সেটা দেখলেই বোঝা যায়৷ গত পাঁচ বছরে যেসব অনিয়ম হয়েছে তার কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? জেলখানার ক্যান্টিনে দুর্নীতি হয়, দেখা-সাক্ষাতে দুর্নীতি হয়, জামিনে দুর্নীতি হয়, থাকা নিয়ে দুর্নীতি হয়৷ ভিতরে গাঁজা, হেরোইন পাচারের মাধ্যমে দুর্নীতি হয়৷ এরকম ১০-১২টি খাতে দুর্নীতি হয়৷ বর্তমান আইজি প্রিজন সাহেব আমার জানামতে সৎ মানুষ৷ তিনি যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে শুদ্ধি অভিযানে নামেন, তাহলে অনিয়ম দূর হবে৷ নিরাপত্তা বাড়বে৷
কারাগারে জেল হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে৷ বন্দি পালিয়ে যায় মই বেয়ে৷ করোনার মধ্যে বাইরে থেকে নারী এসে পুরুষ বন্দির সাথে আলাদা রুমে সময় কাটায়- এগুলো কীভাবে সম্ভব হয়?
‘কারাগারে কোন জায়গায় দুর্নীতি নাই সেটা বলেন’
This browser does not support the audio element.
কোনো ঘটনার যদি যথাযথ তদন্ত হয় এবং দায়ীরা শাস্তি পায় তাহলে কিন্তু এ ধরনের ঘটনা আর ঘটে না৷ কিন্তু তদন্তে ও শাস্তি দেয়ায় যদি গাফিলতি থাকে. তার সুযোগ যারা দুষ্ট তারা নেয়৷ ১০-১২ লাখ টাকা দিয়ে যদি কোনো কারারক্ষী চাকরি পায়, তাহলে তো সে সেই টাকা তোলার চেষ্টা করবে৷ ৩রা নভেম্বরে জেল হত্যার সময় জেলখানায় তো পুরোই অনিয়ম ছিলো৷ তারপরও তো ডিআইডি ঢুকতে পারমিশন দেননি৷ তারপর তো প্রেসিডেন্ট নিজে টেলিফোন করেছে৷
কারা সংস্কারের কোনো কমিশন এ পর্যন্ত হয়েছে?
আমি মোনেম কমিশনের কথা শুনেছি৷ আমি নিজেও ওই কমিশনের প্রতিবেদনটা পড়ার জন্য খুঁজেছি৷ কোনো জেলের জেলার আর জেল সুপার যদি ভালো হন, তাহলে ওই জেলের ৮০ ভাগ অনিয়ম বন্ধ হতে বাধ্য৷
তাদের তাহলে কাজ কী?
যে-কোনো জেল খানার গেট থাকে একটা৷ ওই গেট যদি সঠিক নজরদারিতে থাকে, তাহলে তো আর সমস্যা হয় না৷ সেটা করা গেলে, ভালো লোক পোস্টিং দেয়া গেলে দুর্নীতি কমানো সম্ভব৷
দুনীতি, অনিয়ম সুর্নিষ্টভাবে কোথায় হয়?
কারাগারের দশ চিত্র
কারাগার মানেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর আর তার ভিতরে বন্দিজীবন। সে জীবনের গল্প খুব কমই প্রকাশ পায় বাইরে। তবুও কারাগারের ভিতরের অমানবিকতা, অনিয়মসহ বিভিন্ন ঘটনা নানা সময়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশে।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Abed
জেল হত্যা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারীরা জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচ কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করে রাখে৷ ৩ রা নভেম্বর সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয় তাদের। বাংলাদেশে কারাগারের ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ও বিশ্বে বিরল এ ঘটনা।
ছবি: bdnews24.com/Dipu Malakar
হত্যা, না আত্মহত্যা?
২০১৯ সালে পঞ্চগড় জেলা কারাগারে পলাশ কুমার নামের এক আইনজীবীকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। হাসপাতালে মৃত্যুর আগে তিনি বলেছেন, ‘‘কারাগারের ভিতরে দু‘জন লোক তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়৷’’ যদিও পঞ্চগড়ের জেলার সেসময় দাবি করেন, বাথরুমে লাইটার দিয়ে পলাশ নিজেই শরীরে আগুন দিয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে কক্সবাজার জেলা কারাগারে এক হাজতির গলায় ফাঁস লাগানো লাশ পাওয়া যায়। সেটিও হত্যা, না আত্মহত্যা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
ছবি: picture-alliance/ZB/P. Endig
খালাসের পর ১৩ বছরের জেল
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে জজ মিয়াকে সাজানো মামলায় কারাবন্দি করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার৷ এর আগে ২০০১ সালে মেয়েকে বিষ দিয়ে হত্যার অভিযোগে জাবেদ আলী নামের এক ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়৷ দুই বছর পর উচ্চ আদালত থেকে তিনি বেকসুর খালাস পেলেও রায়ের কপি জেলখানায় না পৌঁছানোয় ১৩ বছর অকারণে জেল খাটেন তিনি।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Abed
কারাগারে বিয়ে
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ধর্ষণ মামলার আসামিদের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীদের বিয়ের খবর প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে। ২০২০ সালের নভেম্বরে কুমিল্লার আদালতে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়েছে৷ ১৯ নভেম্বর ফেনী কারাগারেও একই ধরনের বিয়ে হয়৷ একইদিনে নাটোরেও এমন একটি ঘটনা ঘটে৷ ২২ অক্টোবর উচ্চ আদালতের নির্দেশে রাজশাহীতে যাবজ্জীবন আসামি ও ভুক্তভোগীর কারাফটকে বিয়ে হয়৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ
বাংলাদেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার আছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, কারাগারগুলোর বন্দি ধারণ ক্ষমতা ৪০ হাজার ৯৪৪ আর বন্দির সংখ্যা ৮৮ হাজার ৮৪ জন। পরিস্থিতি এমন যে অতিরিক্ত গরমে হাজতিরা অসুস্থ হওয়া, এমনকি হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তবে নতুন কারাগার নির্মাণ এবং পুরাতন কারাগার সম্প্রসারণ করে ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
ছবি: Reuters
টাকা থাকলে আয়েশে
তবে কারাগারে সবার সময় যে খারাপ কাটে তা নয়। টাকা থাকায় বেশ আয়েশেই দিন কাটে অনেকের। কয়েক দিন আগে প্রচারে এসেছে এমন এক ঘটনা৷ গাজীপুরে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আছেন অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত হল-মার্কের জিএম তুষার আহমদ। কারা কর্মকর্তাদের কক্ষে তিনি এক নারীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। জেলার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এর বিনিময়ে তিনি ঘুস দিয়েছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হাসপাতালে জেল খাটা
কোনো অপরাধে বা অভিযোগে বন্দি হলে জেলখানার ১৪ শিক এড়ানোর একটি উপায় অসুস্থ হয়ে যাওয়া। অস্বাভাবিক আচরণ করে ফাঁসি স্থগিত ও পরে রাজনৈতিক প্রভাবে ছাড়া পেয়েছেন এমন ঘটনাও আছে। গত বছরের ২৫ জানুয়ারি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘সম্রাটসহ ৭ বন্দি হাসপাতালে শুয়েবসে জেল খাটছেন’। তাদের মধ্যে আছেন স্বর্ণ চোরাচালান মামলার আসামি, ব্যবসায়ী, সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতা। ।
ছবি: DW
কারাগারে বিচারালয়
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালে কারাগারে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। গত বছর নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি বেশিরভাগ সময়ই বন্দি ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচারও চলে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এই বিচারকাজের জন্য পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনকে আদালত হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।
ছবি: Getty Images/AFP/S. Jahan
জেলখানা যখন জাদুঘর
পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারটি বাংলাদেশের দুই শতকের ইতিহাসের সাক্ষী। ১৮৬০-এর দশকে অনেক সিপাহীকে সেখানে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। পাকিস্তান শাসনামলে বঙ্গবন্ধুসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতারা বারবার বন্দিত্ব বরণ করেছিলেন এই কারাগারে। এখানেই ঘটে জেল হত্যার ঘটনা। ২০১৬ সালে কারাগারটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করে সরকার। সেখানে টিকিট কেটে ইতিহাসে বিচরণ করতে পারেন দর্শনার্থীরা।
ছবি: bdnews24.com/Dipu Malakar
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র?
দুটি কিশোর ও একটি কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র আছে গাজীপুর ও যশোরে। উদ্দেশ্য যেসব শিশু-কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাদের সংশোধন, শিক্ষা, বৃত্তিমূলক দক্ষতা ও মানসিকতার উন্নয়ন ঘটানো। বিভিন্ন সময়ের সংবাদে দেখা যায়, সেগুলো শিশুদের জন্য নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে যশোরে কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তিন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। ১৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয় এই ঘটনায়। (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Mustafiz Mamun
10 ছবি1 | 10
কারাগারে কোন জায়গায় দুর্নীতি নাই সেটা বলেন৷ প্রথম দুর্নীতি শুরু হয় নিয়োগ দিয়ে৷ বন্দিদের থাকা নিয়ে দুর্নীতি হয়৷ এরপর ক্যান্টিন৷ সেখানে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ১৮শ’ টাকা৷ করোনার কারণে এখন দুর্নীতিবাজরা শোনা যায় কারাগারে ভিডিও কলের ব্যবস্থা করে দেয়৷
এই পরিস্থিতি হলে কারাগারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় না?
কারাগারে দু-একবার যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে বন্দিদের মধ্যে তার একটা কারণ হলো দুর্নীতি৷ বন্দিরা দুর্নীতি বন্ধের দাবি করেছে৷ সবার বেতন বেড়েছে, কিন্তু দুর্নীতি কমেনি৷ তাই নরদারি বাড়াতে হবে৷
কিন্তু জেলার, জেল সুপারদের বিরুদ্ধেই তো অভিযোগ৷ তাহলে কী হবে?
হ্যাঁ, সেজন্যই তো আমি বলেছি জেলার, জেল সুপার ভালো হলে দুর্নীতি কমে যাবে৷ তারা তো টাকা-পয়সা দিয়ে পোস্টিং নেয়৷
তারা টাকা-পয়সা দিয়ে পোস্টিং নিলে তাহলে তো আরো উপরের লোক টাকা নেয়৷ তারা কারা? তাহলে তাদের দায় নেই?
তাদের নাম তো আর আমি বলতে পারবো না৷ তারা উপরের লোক৷
এমন তো নয় যে আপনি যখন ডিআইজি প্রিজন ছিলেন তখন দুর্নীতি হয়নি৷ সেই সময় সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
জেলখানার ৮০ ভাগ লোক ভালো৷ ২০ ভাগ লোক খারাপ৷ আমি জোর গলায় বলছি, কর্তৃপক্ষের যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে এই দুর্নীতি কমতে বাধ্য৷