দুর্নীতির অভিযোগে একাধিক সাবেক মন্ত্রী ও আমলা এখন কারাবন্দি। কী করছেন তারা, একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন কি?
বিজ্ঞাপন
কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে এখন নক্ষত্র সমাবেশ। একের পর এক হাই প্রোফাইল বন্দির ঠিকানা এখন প্রেসিডেন্সি জেলের পহেলা বাইশ ওয়ার্ড। কারণ এখানেই আছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, আছেন সাবেক প্রাথমিক শিক্ষামন্ত্রী মানিক ভট্টাচার্য। টিভি৯ জানাচ্ছে, এছাড়া বিভিন্ন সেলে আছেন কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, সুবীরেশ ভট্টাচার্য, শান্তিপ্রসাদ সিনহা, অশোক সাহারা। সকলেই শিক্ষা-দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সাবেক প্রশাসক।
এই সাবেক মন্ত্রী ও প্রশাসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তারা যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে টাকার বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীদের শিক্ষকের চাকরি দিয়েছেন। এখন সিবিআই ও ইডি-র তদন্তে তাদের নাম উঠে এসেছে। আদালতের রায়ে তারা জেলবন্দি। ফলে পহেলা বাইশ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে এখন আলোচনার শেষ নেই।
মানিককে আমল নয় পার্থের
এই অভিযুক্তদের মধ্যে সবচেয়ে শেষে এসেছেন মানিক ভট্টাচার্য। তিনি যখন জেলের অফিসে যাচ্ছিলেন, তখন তাকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সেলের পাশ দিয়ে যেতে হচ্ছিল। সূত্র জানাচ্ছে, যাওয়ার পথে তিনি বলেন, পার্থদা, কেমন আছেন? পার্থ কোনো জবাব দেননি। বরং মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চলে যান। মানিককে নিয়ে এগিয়ে যান জেলকর্মীরা।
চুপচাপ পার্থ
পার্থ জেলে একাই থাকতে পছন্দ করছেন। ১৫ অগাস্ট পতাকা উত্তোলনের সময়ও তিনি যাননি। জেলে ঋষি অরবিন্দকে যেখানে রাখা হয়েছিল, সেই সেল দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। সেটাও হয়নি। একসময় যাদের সঙ্গে তিনি নিয়মিত কথা বলতেন, তাদের সঙ্গেও কোনো কথা বলছেন না।
মানিকের কাহিনি
মানিককে মঙ্গলবার জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তার আগে তিনি ছিলেন সিবিআই হেফাজতে। মঙ্গলবার মানিক জেলের মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে তাতে শোন। খেয়েছেন রুটি, ডাল ও তরকারি।
পুজো আছে, নেতা নেই
তাদের নামেই চলে এই পুজোগুলি। এবছরও হচ্ছে পুজো। কিন্তু নেতারা নেই। কেউ জেলে, কেউ পরলোকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নাকতলার পুজো
শহরবাসীর কাছে নাকতলার পুজো মানেই ‘পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুজো’। কিন্তু সম্প্রতি সেই পার্থ চট্টোপাধ্যায় ইডি-র হাতে গ্রেফতার হয়ে সংশোধনাগারে। পার্থের পুজো আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বোধন করলেও এইবছর নাকতলার পুজো উদ্বোধনে যাননি মুখ্যমন্ত্রী।
ছবি: Subrata Goswami/DW
উদ্বোধনে নেই
হেভিওয়েট নেতা পার্থকেও প্রতিবছর অন্যান্য পুজোর উদ্বোধন করতে হতো, কিন্তু এই বছর তিনি আলিপুর জেলে বন্দিদশা কাটাচ্ছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মোটা কাপড়
পার্থের পুজো নাকতলা উদয়ন সংঘের এইবছরের থিম ‘মোটা কাপড়’। যদিও পার্থহীন এই বছরের পুজোর জৌলুস এতটুকু কমেনি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
এবং অর্পিতা
পরপর দু’বছর নাকতলা উদয়ন সংঘের পুজোর মুখ ছিলেন অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। ২০১৯ এবং ২০২০, দুই বছরই উদয়ন সংঘের পুজোর পোস্টার থেকে হোর্ডিং, সর্বত্র জ্বলজ্বল করতেন অর্পিতা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অর্পিতা প্রধান অতিথি
প্রধান অতিথি হয়ে পুজোর পুরস্কার প্রদানও করেছেন অর্পিতা। নিজের আবাসন থেকে পুরনো পাড়ার পুজো, সর্বত্রই কোনও না কোনওভাবে দেখা গিয়েছে তাকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অর্পিতা জেলে
পার্থের সঙ্গী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ও এই পুজোয় প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কেষ্টর পুজো
বোলপুরের নীচুপট্টি এলাকার এই বাড়ির সামনেই লাগানো হয়েছে তার এলাকার পুজোর ব্যানার। এবারের পুজো পাড়ায় নয় জেলেই কাটাতে হবে বীরভূমের কেষ্টকে। ইডি গ্রেপ্তার করেছে তাকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পারিবারিক গ্রাম
বীরভূমের নানুরের হাটসেরান্দি গ্রাম। অনুব্রতর পারিবারিক দুর্গাপুজো এখানে ‘মোড়ল বাড়ির পুজো’ নামেই খ্যাত। সেইবাড়ির মেজো ছেলে এই বছর পুজোয় থাকবে না। কমেছে পুজোর জাঁকজমকও।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পারিবারিক দুর্গামন্দির
পারিবারিক দুর্গামন্দির প্রতিবারের মত রং করা হয়েছে। প্রথামাফিক পালিত হবে সব নিয়মই, কিন্তু অন্যান্য বারের মত এই বছর পুজোয় গ্রামে আসবে না ‘মোড়ল’ বাড়ির কেষ্ট।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কলকাতা থেকে মাছ
গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, কলকাতা থেকে চিংড়ি, ইলিশ, ভেটকি আসতো পুজোয়। খাসির মাংস হতো। সঙ্গে হরেক মিষ্টি। অনুব্রত জেলবন্দি থাকায় তেমন কোনও আয়োজন হচ্ছে না এ বার।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সুব্রত নেই
প্রায় একবছর হতে চলল তিনি নেই। জীবদ্দশায় নিয়ম করে সময় পেলেই একবার ক্লাবে আসতেন। এই বছরের পুজোর সন্ধেগুলোয় আর রঙিন নকশা পেড়ে ধুতি পরে বসে থাকতে দেখা যাবে না ক্লাবের সভাপতিকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ক্লাব মনে রেখেছে
এখনও একডালিয়া এভারগ্রিন ক্লাবের ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে রয়েছেন তিনি। সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে ছবি সামনে রেখেই এইবছর খুঁটিপূজা করা হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মণ্ডপে তার ছবি
এই পুজোকে ঘিরে নানান জায়গায় লাগানো রয়েছে ক্লাবের সাবেক সভাপতির স্মৃতিচিত্র। পুজোমণ্ডপে ঢোকার মুখেও রয়েছে তার ছবি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
13 ছবি1 | 13
এই মানিকের সঙ্গে পার্থের হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ বিনিময় হতো বলেও তদন্তকারী সংস্থাগুলির দাবি। মানিক কাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, সেরকম মেসেজও পার্থ পেয়েছিলেন এবং তিনি তা মানিককেই ফরোয়ার্ড করতেন। এছাড়াও দুই জনের মধ্যে মেসেজ বিনিময় হয়েছিল।
বিধানসভায় পার্থ ও মানিক মাঝেমধ্যে দরজা বন্ধ করে বৈঠক করতেন বলেও অভিযোগ। কিন্তু তার সঙ্গেও কথা বললেন না পার্থ।
মানিকের বিরুদ্ধে ইডির অভিযোগ
মঙ্গলবার ইডির আইনজীবীরা আদালতে জানিয়েছেন, মানিকের পরিবারের সদস্যদের নামে প্রায় ১০ কোটি টাকার হদিশ পাওয়া গেছে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থায় ওই টাকা রাখা ছিল। মানিকের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তিন কোটি টাকা রাখা ছিল।
কলকাতায় ইডি হানা দিলেই মিলছে টাকার পাহাড়
পার্থ-ঘনিষ্ঠ অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া গিয়েছিল ৫২ কোটি। এবার কলকাতায় ব্যবয়াসীর বাড়ি থেকে ১৭ কোটি পেল ইডি। এর আগে হালিশহরের পুরপ্রধান রাজু সাহনির বাড়ি থেকে পাওয়া গেছিল ৮০ লাখ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ব্যবসায়ী আমির খানের বাড়ি
কলকাতার গার্ডেনরিচে ব্যবসায়ী নিসার আহমেদ খানের ছেলে আমির খানের বাড়ি থেকে উদ্ধার হলো ১৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আগে থেকে খবর পেয়ে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট(ইডি)-এর কর্মীরা আমির খানের বাড়ি, অফিস মিলিয়ে ছয় জায়গায় হানা দেয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রাশি রাশি নোট
আমির খানের খাটের তলায় প্লাস্টিকের প্যাকেটে টাকা রাখা ছিল। সেই রাশি রাশি নোট উদ্ধার করে ইডি। বেশিরভাগ ৫০০ টাকার নোট। দুই হাজার ও দুইশ টাকার নোটও ছিল।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
টাকা গুনতে মেশিন
টাকা গোনার জন্য স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার কর্মকর্তাদের সাহায্য নেয় ইডি। সেখান থেকে আসে টাকা গোনার মেশিন। আসেন ব্যাংক কর্মীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে টাকা গোনা হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কে এই আমির খান?
আমির খান ও তার সহযোগীরা মিলে একটি গেম অ্যাপ চালাত। 'ই নাগেটস' নামে এই মোবাইল গেমিং অ্যাপের সাহায্যে গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নিত তারা। গ্রাহকরা গেম খেললে কমিশন পেতেন। অ্যাপের ওয়ালেট থেকে কমিশনের টাকা তুলতে পারতেন। তার জন্য ওয়ালেটে টাকা রাখতে হত। বেশি কমিশন পাওয়া যাবে ভেবে গ্রাহকরা প্রচুর টাকা সেখানে রাখতেন। তারপর সেই টাকা হাতিয়ে নেয়া হত বলে ইডি সূত্র জানাচ্ছে। অনেক ভুয়া অ্যাকাউন্টের খোঁজ মিলেছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
এর পিছনে কারা?
আমির খানের সঙ্গে এখনো কোনো রাজনৈতিক দলের যোগাযোগের কথা সামনে আসেনি। কিন্তু রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছে, রাজনীতিক থেকে ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে কী করে এভাবে কোটি কোটি টাকা পাওয়া যাচ্ছে? এভাবে উদ্ধার করা টাকার পাহাড় কলকাতা আগে দেখেনি। তৃণমূল বলছে, বিজেপি কেন্দ্রীয় সংস্থা দিয়ে রাজ্যের ব্যবয়াসীদের টার্গেট করছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মন্ত্রীর বক্তব্য
গার্ডেনরিচ হলো রাজ্যের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের এলাকা। প্রথমে ফিরহাদ বলেন, ''বন্দর এলাকা বলেই ব্যবসায়ীদের চেনা র দায় কি আমার নাকি? ইডি রাজ্যের ব্যবসায়ীদের টার্গেট করছে।'' একদিন পরেই তিনি সুর বদল করে বলেন, ''ইডি তার কাজ করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।''
ছবি: picture-alliance/ZumaPress
বাড়ির মানুষ
তল্লাশি চালানোর সময় বাড়ির মানুষ তা দেখার চেষ্টা করেন। এক নারী তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। তবে বাড়ির মানুষ এই টাকা নিয়ে মুখ খোলেননি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনী
ইডি যখন তল্লাশি চালাচ্ছিল, তখন বাইরে মোতায়েন করা হয়েছিল সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনী। স্থানীয় মানুষ সেখানে আসেন। কিন্তু কেউই কিছু বুঝতে পারছিলেন না। পরে এত টাকা উদ্ধার হয়েছে জেনে তারা অবাক।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সংবাদমাধ্যমের ভিড়
বাড়ির সামনে ছিল সংবাদমাধ্যম বিশেষ করে টিভির সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকদের ভিড়। কেউ মুখ খুললেই তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন তারা। তাদের প্রশ্ন ছিল, কী করে এত টাকা পাওয়া গেল? ইডি কীভাবে জানল এই টাকার কথা? এর সঙ্গে কি কোনো রাজনৈতিক যোগ আছে? এই সব প্রশ্নের জবাব এখনো পাওয়া যায়নি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
9 ছবি1 | 9
মানিকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অন্য কারোর যৌথ অ্যাকাউন্টের হদিশ পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। সেই সব অ্যাকাউন্টের অন্য সদস্য এক বছর বা তার পরে মারা যান। কিন্তু অ্যাকাউন্ট থেকে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়।
আদালতে এক তদন্তকারী অফিসার জানিয়েছেন, ২০১৬ সালে মানিক ভট্টাচার্যের স্ত্রীর সঙ্গে জনৈত মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তীর অ্যাকাউন্ট ছিল। তারপর মাস কয়েক পরেই মৃত্যুঞ্জয় মারা যান। অথচ অ্যাকাউন্ট সচল ছিল এবং কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। মানিকের ছেলের একটি সংস্থার অ্যাকাউন্টে আড়াই কোটির বেশি টাকা পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ। সেখানে রাজ্যের বেসরকারি বিএড কলেজের অ্যাকাউন্ট থেকে ওই অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়ে বলে তদন্তকারী সংস্থার অফিসারদের দাবি।