ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাধারণ মানুষকে কোনো সুবিধা দেয় না৷ এটা যারা মিথ্যা বলে, যারা অপরাধী তাদেরই কাজে লাগে৷ তাই ন্যায়বিচারের জন্য এই আইনটি বাতিল ছাড়া আর কোনো পথ নেই বলে মনে করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া৷
বিজ্ঞাপন
আর সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক মনে করেন আইনটি রাখলেও মানহানি ও ভাবমূর্তি সংক্রান্ত ধারাগুলো পুরোপুরি বাতিল করে দিতে হবে৷ তার মতে, সরকারের সমালোচনা কোনোভাবেই রাষ্ট্রের সমালোচনা বা রাষ্ট্রদ্রোহ নয়৷
১০ মাস কারাগারে আটক থাকার পর লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলে মনে করেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া৷ তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এই আইনটি এমন যে এখানে ভাবমূর্তি বা মানহানির কোনো ব্যাখ্যা নাই৷ এর ব্যাখ্যা ঠিক করে পুলিশ৷ ফলে সরকার বা ক্ষমতাশালীরা যেভাবে মনে করে সেইভাবে এটাকে ব্যাখ্যা করা হয়৷
দেখতে একটি ‘নিরীহ’ কথা আছে এই আইনে৷ আর তা হলো, কেউ যদি জেনে শুনে মিথ্যা প্রকাশ করে ডিজিটাল মাধ্যমে তাহলে এই আইনে মামলা হয়৷ কিন্ত কেউ যে জেনে বা শুনে মিথ্যা বলছেন তা নির্ধারণ করবে কে? তা নির্ধারণের আগেই তো মামলা হয়ে যাচ্ছে৷ কারাগারে পাঠানো হচ্ছে৷ মারা যাচ্ছে৷
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এখন আইনটি বাতিল করা প্রয়োজন: জ্যোতির্ময় বড়ুয়া
আসলে এই আইনে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ ২০১৮ সালে এই আইনটি পাস হওয়ার পর সাধারণ মানুষ এর মাধ্যমে বিচার পেয়েছে তার একটিও উদাহরণ নেই৷ এই আইনে সাংবাদিক, লেখক এমনকি চিকিৎসকদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘‘ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতেই এখন আইনটি বাতিল করা প্রয়োজন৷ সংসদ সদস্যেরা এই আইন জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে করলেও এখানে জনমতের প্রতিফলন নাই৷ সাধারণ মানুষ কি তাদের বিনা বিচারে বেধে রাখার আইন চাইবেন?’’
সাইবার অরপাধ বলতে সাধারণভাবে যা বুঝায় তা প্রতিরোধে নিয়ে এই আইনের প্রয়োগ দেখা যায় না৷ বিশেষ করে অনলাইনে তথ্য চুরি, ব্যাংকের তথ্য চুরি, নারীদের হয়রানি- এসব ব্যাপারে এই আইনে বিধান থাকলেও তার প্রতিকার পাওয়া যায় না৷
ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘‘সাইবার অপরাধ প্রতিরোধের নামে কটাক্ষ করা, ব্যঙ্গ করা, সমালোচনা করে এগুলো কোনোভাবেই অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে না৷ সৌদি আরব, উত্তর কোরিয়া ছাড়া দুনিয়ার কোনো গণতান্ত্রিক দেশে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপরাধে শাস্তির এমন আইন নাই৷’’
সৌদি আরব, উত্তর কোরিয়া ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক দেশে ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের অপরাধে শাস্তির এমন আইন নাই: ড. শাহদীন মালিক
তিনি বলেন, কার্টুন আকার অপরাধে কিশোরকে জেলে যেতে হয়েছে৷ মুশতাক আহমেদকে লেখার কারণে কারাগারে গিয়ে মারা যেতে হয়েছে৷ এখন তো বাংলাদেশে কার্টুন আঁকা বন্ধ হয়ে গেছে৷ রম্য ম্যাগাজিনও নাই বললেই চলে৷ ডিজিটাল আইনের কারণে এটা হয়েছে৷ এই আইনটি রাখতে হলে ভাবমূর্তি সংক্রান্ত সব ধারা বাদ দিতে হবে৷ আর জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, সাইবার অপরাধের প্রতিকার আগের আইসিটি আইনেই আছে৷ আর জিজিটাল আইনে ৫৪ ধারার যত খারাপ দিক আছে তার সবই যুক্ত করা হয়েছে৷
সরকারের কোনো মন্ত্রী বা প্রভাশালী ব্যক্তির সমালোচনা করায় এখন রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হচ্ছে৷ ডিজিটাল আইনে মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে৷ কিশোর-মুশতাকদের বিরুদ্ধে মামলায়ও রাষ্ট্রদ্রোহ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে৷ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘‘সরকার বা সরকারের কোনো ব্যক্তির সমালোচনা কখনোই রাষ্ট্রদ্রোহ নয়৷ সরকারে সমালোচনা করা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ নয়৷’’
তিনি বলেন পেনাল কোডের ১২৪(ক) ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের বিষয়টি আছে৷ সেখানে যা বলা হয়েছে তা এই আইনের প্রয়োগকারীরা বুঝতে পারছেন না৷ এখন ভাবমূর্তি ধরে যদি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয় তাহলে কী বলার আছে?
পুরো বৃটিশ আমলেও ১০০টির বেশি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়নি বলে তিনি জানান৷ আর এখন কথায় কথায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ করা হচ্ছে৷
যেসব অভিযোগে ডিজিটাল আইনে মামলা
করোনা মহামারি শুরুর পর বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে৷ কী অভিযোগে এসব মামলা হচ্ছে, জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: facebook.com/michelkumirthakur
মুশতাক আহমেদ
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে ২০২০ এর ৫ মে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব-৩৷ তাদের একজন মুশতাক আহমেদ৷ এজাহারে বলা হয়েছে, ‘‘তিনি ‘আই এম বাংলাদেশি’ পেজের এডিটর৷ তিনিও গুজব ছড়িয়েছেন৷ এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে৷’’ ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে তার মৃত্যু হয়৷
ছবি: facebook.com/IamBangladeshi.71
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর
ব়্যাবের মামলার গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের একজন কিশোর৷ তার ফেসবুক পাতায় রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, করোনা, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে এজাহারে বলা হয়৷ এছাড়া তার ব্যবহৃত ফোনে তাসনিম খলিল, শায়ের জুলকারনাইন, শাহেদ আলম ও আসিফ মহিউদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানানো হয়৷ ৪ মার্চ তিনি জামিনে মুক্তি পান৷
ছবি: facebook.com/AKK30M
দিদারুল ভূঁইয়া
ব়্যাবের মামলায় গ্রেপ্তার আরেকজন দিদার ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য৷ ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯’ বলছে, দিদার করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়তে বাংলাদেশ সরকার যে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে, তা মনিটর করার জন্য গঠিত একটি কমিটির সদস্য৷ নিজের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেস দিদার অভিযোগ করেন, সবচেয়ে গরিব মানুষেরাই সরকারি ত্রাণের সবচেয়ে কম অংশ পেয়েছেন৷ সম্প্রতি তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান৷
ছবি: Facebook/didarul.bhuiyan
তাসনিম খলিল
ব়্যাবের মামলার ১১ আসামির একজন সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল৷ তার সম্পর্কে এজাহারে বলা হয়েছে, তার ফেসবুক আইডিতে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ও বাহিনী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার বা বিভ্রান্তি ছড়াতে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট পাওয়া গেছে৷
ছবি: Facebook/tasneem.khalil
শফিকুল ইসলাম কাজল
২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় ফটো সাংবাদিক কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন মাগুরা-১ আসনের সাংসদ সাইফুজ্জামান শেখর৷ যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ওয়েস্টিন হোটেলকেন্দ্রিক কারবারে ‘জড়িত’দের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কারণে এই মামলা করেছিলেন তিনি৷ এছাড়া কাজলের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ ও তেজগাঁও থানায়ও ডিজিটাল আইনে আরও দুটি মামলা হয়৷
ছবি: Facebook/Shafiqul Islam Kajol
বেরোবি শিক্ষক
ফেসবুকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের মৃত্যু নিয়ে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট দেয়ায় ডিজিটাল আইনের মামলায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের শিক্ষক সিরাজুম মনিরাকে ২০২০ সালের ১৩ জুন গ্রেফতার করা হয়৷ পোস্টটি দেয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি তা মুছে দিয়েছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
রাবি শিক্ষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রহমানকে গতবছর ১৮ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ পুলিশ কর্মকর্তা মো. গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমকে নিয়ে ফেসবুকে ‘আজেবাজে কথা লিখে কটূক্তির অভিযোগে’ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ বার্তা সংস্থা ডিপিএ বলছে, ২ জুন প্রকাশিত এক পোস্টে তিনি স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছিলেন৷ যদিও নাসিমের নাম উল্লেখ করেননি৷ পোস্টটি তিনি পরে মুছেও দেন৷
ছবি: DW/A. Khanom
নবম শ্রেণির ছাত্র ইমন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগে ময়মনসিংহের ভালুকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা এক মামলায় নবম শ্রেণির ছাত্র মো. ইমনকে ২০২০ সালের ২০ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর তাকে কিশোর শোধনাগারে পাঠানো হয়৷ ভালুকার ওসি জানিয়েছেন, ইমন পরে পোস্টটি মুছে ক্ষমা চেয়েছিল৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সুশান্ত দাশ গুপ্ত
‘আমার হবিগঞ্জ’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক৷ এই পত্রিকায় স্থানীয় সাংসদ আবু জাহিরের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ২০ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সায়েদুজ্জামান জাহির৷ এর পরদিন সুশান্তকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৪ জুন তিনি জামিন পান৷