জোটের দলগুলোর নিজ প্রতীকে নির্বাচনের ভালো-মন্দ
১৪ ডিসেম্বর ২০২৫
নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে গিয়েছিল কয়েকটি রাজনৈতিক দল৷ সেখান থেকে সিদ্ধান্ত পক্ষে আসেনি৷ অর্থাৎ নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হচ্ছে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে৷ এমন সিদ্ধান্তে বিএনপির সঙ্গে যুগপদ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোতে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে৷ তবে কেউ কেউ আশার কথাও শুনিয়েছেন৷
তবে বড় রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্য এমন আইনের ফলে বিষয়টিকে সুবিধাজনক মনে করছে৷ যেমন আরপিওর এমন সংশোধনীতে বিএনপি প্রকাশ্যে ক্ষোভের কথা জানালেও দলের ভেতর থেকে বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলটির একাধিক নেতা৷ দলটির এমন কয়েকজন নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ধারনা করা যাচ্ছে যে, এর ফলে ছোট দলগুলোর সঙ্গে তাদের দরকষাকষিতে সুবিধা হবে৷
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘মাঠের রাজনীতিতে অনেককেই সঙ্গে নিতে হয়৷ কিন্তু বাস্তবে ওই রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকেরই তেমন কোন ভোট নেই৷ কিন্তু নির্বাচনের সময় তারা ৫-১০টি আসন চেয়ে বসে৷ এনিয়ে অধিকাংশ সময়ই বিপাকে পড়তে হয়৷ এখন নিজের দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হওয়ায় অনেকেই আর বেশি আসন চাচ্ছেন না৷ দলগুলোর প্রধান নেতার পক্ষে জিতে আসাও কঠিন৷ ফলে আমরা নিশ্চিত না হয়ে কাউকে আসন ছাড় দেব না৷’’
অবশ্য বিএনপির কোনো কোনো নেতা এভাবে আরপিও সংশোধনীকে অগণতান্ত্রিক বলেও মনে করছেন৷ তাদের দাবি, রাজনৈতিক দলগুরোর সঙ্গে আলেচনা করে এই বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল৷
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘সত্যিকার অর্থেই আমরা এটা নিয়ে বিরক্ত৷ নির্বাচন কমিশন এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল৷ কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমাদেরকে জানিয়েছে৷ এই ধরনের সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক আচরণ-বিরুদ্ধ৷ কারণ আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, জোটে অনেকগুলো দল থাকে, কিন্তু প্রধান দলের মার্কা নিয়েই নির্বাচন করে অন্যরা৷''
তিনি বলেন, ‘‘সুদুর অতীতের উদাহরণ দেই, ১৯৫৪ সালে অনেকগুলো দল মিলে জোট করেছিল৷ তারা সবাই কিন্তু নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেছিল৷ তখন একটা শ্লোগান ছিল হক-ভাসানীর মার্কা নৌকা মার্কা৷ ভাসানীর দলের প্রতীক নৌকা হলেও হক সাহেবের দলের প্রতীক ছিল লাঙল৷ ফলে তারা সবাই কিন্তু নৌকা নিয়ে ভোট করে জিতেছিল৷ ৭২ বছর পর এসে এই ধরনের সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক নয়৷ আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে যে দলগুলো ছিল তাদের তো আসন দিতে হবে৷ এখন তাদের দলের প্রতীককে কেউ চেনে না৷ তারা তো আমাদের ধানের শীর্ষ নিয়েই নির্বাচন করবে৷ এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সমমনাদের নিয়ে আমরা নতুন করে ভাবছি৷’’
হাইকোর্টের রায়েও বহাল
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটবদ্ধ নির্বাচন করলেও স্ব স্ব দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিধানের বৈধতা প্রশ্নে জারি করা রুল খারিজ করে দিয়েছে হাইকোর্ট৷ এর ফলে জোট করলেও সব দলকে নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা৷
গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি ফাতেমা আনোয়ারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন৷ আদালতে রিটের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম৷ তার সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার সাহেদুল আজম৷ অন্যদিকে এনসিপির পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট নাজমুস সাকিব ও জহিরুল ইসলাম মুসা৷
এর আগে গত ২৬ নভেম্বর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটবদ্ধ নির্বাচন করলেও স্ব স্ব দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিধান চ্যালেঞ্জ করে রিটটি দায়ের করা হয়৷ রিটে নির্বাচনে নিবন্ধিত একাধিক দল জোটভুক্ত হলেও ভোট করতে হবে নিজ নিজ দলের প্রতীকে, এমন বিধান যুক্ত করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বাতিল চাওয়া হয়৷ হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এনডিএমের মহাসচিব মোমিনুল ইসলাম এ রিট দায়ের করেন৷ প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়৷
গত ৩ নভেম্বর নির্বাচনে নিবন্ধিত একাধিক দল জোটভুক্ত হলেও ভোট করতে হবে নিজ নিজ দলের প্রতীকে, এমন বিধান যুক্ত করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ জারি করে সরকার৷ আগে কোনও দল জোটভুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নিলে তারা জোটের শরিক যেকোনও দলের প্রতীক নেওয়ার সুযোগ পেতো৷ এর আগে গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়৷
জোট করলেও দলীয় প্রতীকেই নির্বাচন করার বিধান নিয়ে তখন আপত্তি জানিয়েছিল বিএনপি৷ দলটি নির্বাচন কমিশন ও আইন মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে তাদের আপত্তির কথা জানায়৷ জোটভুক্ত হতে আগ্রহী কিছু ছোট দলের মধ্যেও সরকারের এই সিদ্ধান্তে অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল৷ এরপর সরকার বিষয়টি বাদ দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এমন খবর জানতে পেরেছে উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামী এটি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়৷ শেষ পর্যন্ত ওই বিধান রেখেই অধ্যাদেশ জারি করা হয়৷
ইতিবাচকভাবে দেখছেন অনেক রাজনৈতিক নেতা
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে আমরা শুধু নেতিবাচক ভাবে দেখতে চাই না৷ এখানে অনেক ইতিবাচক বিষয় আছে৷ আমাদের দলের নিবন্ধন খুব অল্প দিন হয়েছে৷ ফলে আমাদের দলের যে প্রতীক - ট্রাক - সেটা অনেকেই জানে না৷ আমরা দলীয় প্রতীক চেনানোর সুযোগ পেয়েছি৷ তবে অবশ্য ঝুঁকি তো কিছু থাকেই৷ তারপরও বলব, আমরা যদি ভালো করতে পারি, ভোটের সংখ্যা বাড়াতে পারি তাহলে উচ্চকক্ষে কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে আসন বন্টন হবে৷ ফলে সেখানে আমরা ভালো সুযোগ পাবো৷''
জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক মনিরা শারমীন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ইতিবাচক৷ এখন আপনি বড় দলের শরীক হয়ে নিজের কোন ইশতেহার ছাড়াই এমপি হয়ে গেলেন৷ আপনি কী করবেন সেটা কাউকে বললেন না৷ এভাবে তো গণতন্ত্র বিকশিত হবে না৷ গত ১৫-২০ বছরে দেশের মানুষ নৌকা আর ধানের শীর্ষ ছাড়া অন্য কোন প্রতীক চিনতে পারেনি৷ আমরা তো বলছি, তাদের বাইরে এসে কিছু বিকল্প তৈরি করা যাবে মানুষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পায়৷ এবার নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলকেই নিজের শক্তি দিয়ে নির্বাচনের মাঠে নামতে হবে৷ আমাদের দলের প্রতীক শাপলা কলিও তো নতুন৷ এটাও তো আমাদের মানুষকে চেনাতে হবে৷''
সময় দেওয়ার কথা বলছেন অনেকে
বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে থাকা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদক সাইফুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘আমরা নিজস্ব মার্কা নিয়ে নির্বাচনের পক্ষে৷ আমাদের মার্কা হলো কোদাল৷ সেটা তো দেশের মানুষকে চেনাতে হবে৷ তবে এটা ঝুঁকিপূর্ণ৷ কারণ এদেশে এখন একটা সংস্কৃতি হলো বড় দলের মার্কা নিয়ে নির্বাচন করা৷ সেজন্য এবারের নির্বাচনে দু'টোই (জোট ও দলীয় প্রতীকে অংশ নেওয়ার সুযোগ) থাকা উচিত ছিল৷ তবে বড় দলের প্রতীকে নির্বাচন করলে তার পাওয়া ভোট সেই দলের পক্ষে যোগ হয়৷ এবার ঘোষণা দিয়ে হয়ত আগামী নির্বাচন থেকে এটার বাস্তবায়ন করলে ভালো হতো৷’’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা নিজের দলের প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করবো৷ আমাদের দলের প্রতীক ‘মাথাল'৷ তবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের যুগে এটা উন্মুক্ত থাকাই ভালো হতো৷ যদি কেউ মনে করেন জোটের প্রতীকে করবেন, তার সেই সুযোগ দিলে ভালো হতো৷ আর তা না হলে আগামী নির্বাচন থেকে এটা বাস্তবায়ন করা যেত৷ এই সিদ্ধান্তের ফলে ছোট ছোট অনেকগুলো দলে থেকে সংসদে যাওয়ার যে সুযোগ ছিল সেটা সংকুচিত হয়ে যেতে পারে৷’’
আপিল করবে ক্ষুদ্ধ এনডিএন
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংক্ষেপে এনডিএনের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ৷ দলীয় প্রতীক সিংহ হলেও তারা চান বিএনপির প্রতীকে অংশ নিতে৷
ববি হাজ্জাজ ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘নির্বাচন কমিশন দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করেছে৷ বিএনপির নেতৃত্বে বড় জোট হচ্ছে৷ এই জোটকে ঠেকানোর জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠা দলের প্রেসক্রিপশনে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন৷ এটা কোনভাবেই ঠিক হয়নি৷ হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমরা আপিল করবো৷ উচ্চ আদালতের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, ওইদিন কোর্টে জামায়াত ও এনসিপির কয়েকজন আইনজীবী মবের মতো সৃষ্টি করেন৷ এরপর আদালত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন৷ আমরা মনে করছি, আপিল বিভাগ থেকে আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত পাব৷''
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে থেকেও জাতীয় পার্টি তাদের লাঙ্গল প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করেছিলো৷ আবার ওই নির্বাচনসহ ২০২৪ পর্যন্ত পরের সব নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি ও হাসানুল হক ইনুর জাসদের প্রার্থীরা৷ আবার ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটে থেকে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থীরা বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলো৷ তবে জামায়াত ইসলামী সেই নির্বাচনে তাদের দলীয় দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়েই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলো৷
২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন৷
এতোদিন জোটবদ্ধ দলগুলো নিজেরা নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানাতো যে, তারা জোটের প্রতীকে নির্বাচন করতে চান৷ আবার জোট থেকেও প্রতীক নিয়ে একটি চিঠি কমিশনকে দেয়া হতো৷ ফলে জোটের প্রতীক নিয়ে যেমন নির্বাচনে অংশ নেওয়া যেতো, তেমনি জোটবদ্ধ হয়ে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিলো৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তে দেশের মানুষ খুশি হয়েছেন৷ কারণ হিসেবে আমি বলব, যাদের সংসদে যাওয়ার যোগ্যতা নেই, জোটের প্রতীকে তারাও সংসদে গেছেন৷ সেখানে গিয়ে ওই বড় রাজনৈতিক দলের গুনগান করাই তাদের কাজ হয়েছে৷ এমনকি আমি উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, জোটের ওই শরীকরাই সবচেয়ে বেশি উল্টোপাল্টা কথা বলেছেন৷ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া অডিওতে আমরা কী শুনলাম, বামগুলো নিজেরা ভোট করে কখনও এমপি হতে পারবে না, তারা নৌকা নিয়ে এমপি হয়ে কী আস্ফলন দেখালো৷ এমনকি শেখ হাসিনাকে তারাই উল্টোপাল্টা বুদ্ধি দিয়ে এই অবস্থায় নিয়ে গেছেন৷ ফলে সংসদে যেতে হলে নিজের যোগ্যতা দিয়ে যান, কারও ঘাঁড়ে পা দিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না৷’’