বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোটের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসাবে খাড়গের নাম প্রস্তাব করেন।
বিজ্ঞাপন
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মাঝেমধ্যেই রাজনৈতিক চমক দিতে পছন্দ করেন। মঙ্গলবার ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকেও তিনি এই চমক দিয়েছেন। তিনি বৈঠকে ২৮ দলের ইন্ডিয়া জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম প্রস্তাব করেন।
মমতার যুক্তি ছিল, খাড়গে একজন অভিজ্ঞ নেতা। তিনি অনগ্রসর শ্রেণি থেকে উঠে এসেছেন। তাই তাকেই জোটের মুখ করে লড়ুক ইন্ডিয়া।
মমতার এই প্রস্তাব সমর্থন করেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি বৈঠকে বলেন, খাড়গের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোট ভোটে লড়লে তার কোনো আপত্তি নেই।
কিন্তু অন্য দলের নেতারা বিরোধিতা না করলেও তেমন উৎসাহও দেখায়নি।
তবে এই প্রস্তাবে জল ঢেলে দেন খাড়গে নিজেই। তিনি বলেন, আগে জোট জিতুক, তারপর প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা ঠিক করা যাবে। তিনি এই পদের জন্য উৎসাহিত নন।
খাড়গে যা বলেছেন
খাড়গে বলেছেন, তিনি গরিব মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতিতে এসেছেন। আগেভাগে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে হইচই করার কোনো দরকার নেই। ।
পরে সাংবাদিক সম্মেলনে খাড়গে বলেছেন, ''আমরা বিজেপি-কে হারাতে বদ্ধপরিকর। আমরা আগে সংখ্য়াগরিষ্ঠতা পেতে চাই। যদি পাই, তাহলে সাংসদরাই ঠিক করবেন কে প্রধানমন্ত্রী হবেন। আগে জোট জিতুক। তারপর তা ঠিক করা যাবে। এমপি না থাকলে প্রধানমন্ত্রীর কথা বলা অর্থহীন। আমরা আগে একজোট হয়ে জিততে চাই।''
সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিরোধী জোটের আসন সমঝোতা
ভারতের প্রধান বিরোধী জোট ইন্ডিয়ার তৃতীয় বৈঠক চলছে মুম্বইতে। ২৮ দলের ৬৩ জন নেতা বৈঠকে উপস্থিত।
ছবি: Indian National Congress
পাটনা, বেঙ্গালুরুর পর মুম্বই
প্রথম বৈঠক হয়েছিল পাটনায়। তারপর বেঙ্গালুরুতে জোটের নাম ঠিক হয়, ইন্ডিয়া। ২৮টি দল একজোট হয়ে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে লড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এবার মুম্বইতে জোটের তৃতীয় বৈঠকে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। উপরের ছবিটি বেঙ্গালুরু বৈঠকের।
ছবি: Bihar state Chief Minister's Office/AP/picture alliance
আসন বন্টন নিয়ে সিদ্ধান্ত সেপ্টেম্বরেই
ঠিক হয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই জোট শরিকেরা নিজেদের মধ্যে আসন বন্টনের বিষয়টি চূড়ান্ত করে ফেলবেন। এনিয়ে প্রাথমিকভাবে কিছু কথা হয়েছে পাটনা ও বেঙ্গালুরুর বৈঠকে। বৃহস্পতিবার মুম্বইতে ঠিক হয়েছে, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তারা আসন বন্টন শেষ করে ফেলবেন।
ছবি: MOHAN KUMAR/AFP
রাহুল-অভিষেক কথা
মুম্বই যাওয়ার আগে দিল্লি এসেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার ভোরে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন অভিষেক। তাদের মধ্যে এক ঘণ্টা ধরে কথা হয়। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের বিষয়েই কথা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ও আসন বন্টনের বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়েছে।
ছবি: Congress Party/AP Photo/picture alliance
অধীর যা বলেছেন
লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা ও পশ্চিমবঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী আগে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ হলো পুকুর, আর দেশের রাজনীতি হলো নদী। কংগ্রেস এখন নদী নিয়ে বেশি ব্যস্ত। তবে অধীর এখনো রাজ্যে তৃণমূল ও মমতার কড়া সমালোচনা করছেন। দত্তপুকুর বিস্ফোরণ নিয়েও করেছেন।
ছবি: Syamantak Ghosh/DW
কংগ্রেস যেখানে প্রধান বিরোধী
মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, গুজরাট, কেরালা, হরিয়ানা, ত্রিপুরা, গোয়ার মতো কিছু রাজ্যে লড়াইটা সরাসরি বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে। কংগ্রেস এখানে মূল বিরোধী দল। সেখানে অন্য বিরোধী দলের শক্তি খুব বেশি নয়। ফলে সেখানে সামান্য কিছু আসন তাদের ছাড়তে হতে পারে কংগ্রেসকে। কিন্তু দিল্লি নিয়ে সমস্যা আছে। দিল্লিতে আপ ও কংগ্রেস জোট করে লড়বে কি না, তা নির্ভর করছে, কেজরিওয়াল ও রাহুল গান্ধীর উপর।
ছবি: Pradeep Gaur/SOPA/Zuma/picture alliance
কংগ্রেস যেখানে ক্ষমতায়
ছত্তিশগড়, রাজস্থান, কর্ণাটক, হিমাচলে কংগ্রেস এককভাবে ক্ষমতায় আছে। এর মধ্যে রাজস্থান, কর্ণাটকে আপ আসন চাইতে পারে। তবে দুই রাজ্যেই তাদের শক্তি খুবই কম। এনসিপি কিছু আসনের দাবিদার। ফলে এখানেও খুব বেশি আসন ছাড়তে হবে না কংগ্রেসকে। উপরের ছবিটি কর্ণাটকে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার।
ছবি: IANS
মহাজোটের রাজ্যে
মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খণ্ড, তামিলনাড়ুতে মহাজোট আছে। কংগ্রেস তার শরিক। এই রাজ্যগুলিতেও আসন বন্টন নিয়ে খুব বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। উপরের ছবিতে বিহারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব, দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ ও রাবড়ি দেবী। বিহারের মহাজোটে আছে কংগ্রেসও।
ছবি: Santosh Kumar/Hindustan Times/IMAGO
উত্তরপ্রদেশ নিয়ে
উত্তরপ্রদেশ নিয়ে সমস্যা আছে। সেখানে সমাজবাদী পার্টি প্রধান বিরোধী দল। তারা এখনো পর্যন্ত কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাতে চায় না। সেক্ষেত্রে আসন সমঝোতা হবে নাকি দুই দল কৌশলগত সমঝোতা করবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
ছবি: Samiratmaj Mishra/DW
বামেরা কী করবে?
সিপিএম জানিয়ে দিয়েছে, তারা পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালায় কোনো জোটে যাবে না। তারা জাতীয় স্তরে জোটে থাকবে। এই অবস্থান বদলের সম্ভাবনা কম। পশ্চিমবঙ্গে তারা আইএসএফের সঙ্গে সমঝোতায় আছে। কংগ্রেসের সঙ্গেও তাদের অঘোষিত সমঝোতা রয়েছে। কেরলে তারা ক্ষমতায়। সেখানে তারা বা কংগ্রেস কেউই জোটে যেতে রাজি নয়।
ছবি: Sandip Saha/Pacific Press/picture alliance
অন্য রাজ্যে
তেলেঙ্গানায় লড়াইটা হবে টিআরএসের সঙ্গে কংগ্রেসের। তবে অন্ধ্রে লড়াই হওয়ার কথা ওয়াইএসআর কংগ্রেসের সঙ্গে চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশমের। নাইডু বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলির পরিস্থিতি আলাদা। সেখানে কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দল। দু-একটা রাজ্যে তৃণমূল আছে। আছে কিছু আঞ্চলিক দলও। উপরের ছবিতে তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও।
ছবি: Ians
জোটের মুখ
জোটের মুখ হিসাবে আগে থেকে কাউকে তুলে ধরা হবে না। তাহলে লড়াইটা মোদী বনাম তার বিরুদ্ধে হবে। বিরোধী নেতারা চাইছেন, লড়াইটা এনডিএ বনাম ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে হোক। তবে জোটের আহ্বায়ক হিসাবে নীতীশ কুমার ও মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম শোনা যাচ্ছে।
ছবি: Bihar Chief Ministers Office/AP/picture
কংগ্রেস চাইছে
সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী এবার এই জোট নিয়ে চলতে চান। তাই খুব ভেবেচিন্তে প্রতিটি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে, বিরোধের জায়গাগুলিকে সরিয়ে রেখে যে সব বিষয়ে মতৈক্য হতে পারে, সেই জায়গাগুলি বেছে নিতে।
ছবি: Manjunath Kiran/AFP/Getty Images
12 ছবি1 | 12
মমতা কেন প্রস্তাব দিলেন?
এতদিন মমতা বলেছেন, জোট জিতলে তবেই প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা ঠিক করা হবে। আগে থেকে কাউকে সামনে রেখে লড়া হবে না। সেই মমতাই কেন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে খাড়গের নাম প্রস্তাব করলেন?
পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি-র মুখপাত্র প্রশ্ন করেছেন, তৃণমূলের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়কেই জোটের মুখ ও প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা উচিত। তারপর কি এমন হলো, যাতে তিনি খাড়গের নাম প্রস্তাব করলেন?
কংগ্রেস নেতা ও রাজ্যের সাবেক বিরোধী নেতা আব্দুল মান্নান ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''মমতার আসল উদ্দেশ্য কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে ঝগড়া লাগানো। তাই তিনি এরকম প্রস্তাব করেছেন।''
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''এর পিছনে দুইটি কারণ থাকতে পারে। খাড়গে দলিত নেতা। একজন দলিতকে প্রধানমন্ত্রী করার কথা বলে মমতা তাদের মন জয় করার চেষ্টা করচেন। বিশেষ করে মমতার লক্ষ্য থাকতে পারে মতুয়া ভোট। যে ভোটের একটা বড় অংশ বিজেপি-র দিকে ঝুঁকে আছে।''
শুভাশিসের মতে, দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, ''রাহুল গান্ধীর নাম যাতে না আসে সেটা নিশ্চিত করা। খাড়গের নাম এলে রাহুল বা গান্ধী পরিবারের কেউ তার বিরোধিতা করতে পারবে না।''
সাংবাদিক আশিস গুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''বিজেপি সবসময় রাহুলকে আক্রমণ করে। রাহুলই তাদের মাথাব্যথার কারণ। সেই রাহুলকে রুখতেই এভাবে খাড়গের নাম প্রস্তাব করা হতে পারে।''
জোটের সিদ্ধান্ত
বৈঠকে ঠিক হয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যেই আসন সমঝোতার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। রাজ্য নেতারা এই কাজটা করবেন।
কংগ্রেস জোটের আসন সমঝোতার বিষয়টি দেখার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে। সেই কমিটিতে দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলোত ও ভূপেশ বাঘেলকে রাখা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে মুকুল ওয়াসনিককে।
কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নেতাদেরও দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েছে। সেখানে তাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি নিয়ে কথা হবে। এর আগে মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের সঙ্গে রাহুল গান্ধীর বিষয়টি নিয়ে একদফা কথা হয়েছে। তবে প্রদীপ ভট্টাচার্য, আব্দুল মান্নানের মতো নেতারা শারীরিক কারণে সম্ভবত দিল্লি আসবেন না। এমনিতে রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের একটা বড় অংশ এই জোটের পক্ষে নন।
মমতা একদিন আগেই বলেছেন, রাজ্যে কংগ্রেস মাত্র দুইটি আসনে গত লোকসভা নির্বাচনে জিতেছিল। তিনি যে কংগ্রেসকে খুব বেশি আসন ছাড়বেন না, সেটাও স্পষ্ট।
এছাড়া ঠিক হয়েছে, আগামী ২২ ডিসেম্বর সংসদ থেকে ১৫১ জন সাংসদকে বহিষ্কার করার বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে ইন্ডিয়া জোট বিক্ষোভ দেখাবে।
কংগ্রেস আগামী ২৮ ডিসেম্বর নাগপুরে জনসভা করছে। কেন্দ্রীয় নেতারা সেখানে ভাষণ দেবেন। জানুয়ারিতে রাহুল আবার 'ভারত জোড়ো যাত্রা'-ও শুরু করবেন।