বাবা-মাকে হত্যার জন্য অভিযুক্ত ১৭ বছরের কিশোরীর যেমন দায় রয়েছে, তেমন তার আচরণগত সমস্যার পিছনে রয়েছে পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের দায়ও৷ ডয়চে ভেলেকে এ কথা বললেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম৷
বিজ্ঞাপন
পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান এবং তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমান তাঁদের নিজ সন্তান ***-র হাতে খুন হয়েছেন, অভিযোগ এমনটাই৷ আর এ নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমই শুধু নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিস্তর আলোচনা৷ বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন সমাজবিজ্ঞানী এবং মনস্তত্ত্ববিদরাও৷ এই হত্যকাণ্ড কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়৷ এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে সমাজ ও পরিবারের নানা দিক, নানা অসঙ্গতি৷
অভিযুক্ত ***-র বয়স ১৭৷ সে ভয়াবহ মাদক ইয়াবায় আসক্ত৷ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, মেয়েদের মাদক গ্রহণের পরিমাণ এখন উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে৷ দেশে ৮০ লাখ মাদকাসক্তের ৩০ ভাগই এখন মেয়ে৷ তাদের বয়স ১৪ থেকে ২১ বছরের মধ্যে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইয়াবার প্রচলনের কারণে মেয়েদের মধ্যে এই মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে৷ ইয়াবা বহন এবং সেবন দুটোই সহজ৷ এছাড়া হতাশা, কৌতূহল এবং বন্ধু-বান্ধবের কারণে তারা ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ছে৷
কেন খুন হয়েছেন সাগর, রুনি?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে৷ কিন্তু আজও নিহতের পরিবার, শুভানুধ্যায়ী আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারলো না, কেন এই হত্যাকাণ্ড? এই বিষয়ে ছবিঘর দেখুন এখানে:
ছবি: DW
সেই কালোরাত
২০১২ সালের এগারোই ফেব্রুয়ারি৷ সেদিন খুব ভোরবেলা জানা গিয়েছিল, ঢাকায় নিজের ভাড়া বাসায় খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি৷ একই ফ্ল্যাটে থাকলেও প্রাণে বেঁচে যান তাদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ৷
ছবি: dapd
সাগর সরওয়ার
দেশি-বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করার পর ২০১১ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন সাগর সরওয়ার (ডানে)৷ সর্বশেষ সেই টেলিভিশন চ্যানেলেই কাজ করেছেন তিনি৷ ২০১২ সালের দশই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কাজ থেকে বাসায় ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুন হন সাগর৷
ছবি: DW
মেহেরুন রুনি
একাধিক দৈনিকে কাজ করার পর কয়েক বছর আগে টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় কাজ শুরু করেন মেহেরুন রুনি (বামে)৷ মাঝে স্বামীর সঙ্গে বছর দেড়েক জার্মানিতে কাটিয়েছেন তিনি৷ এরপর ২০১১ সালে আবারো ফিরে যান নিজের কর্মস্থলে৷
ছবি: DW
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার!
১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন৷ বলাবাহুল্য, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি৷
ছবি: DW
সাংবাদিকদের আন্দোলন
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে মতের অমিল থাকলেও সাগর-রুনি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের ঘোষণা প্রদান করে সব সংগঠন৷ খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে গর্জে ওঠে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিরা৷ জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW
ব্লগারদের প্রতিরোধ
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের পাশাপাশি ব্লগাররা এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজপথে নামে৷ গত বছর এই ইস্যুতে ব্লগ ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে এখনো রয়েছে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যানার৷
ছবি: DW
রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে রাজপথে ব্লগারদের সক্রিয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকাসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে ব্লগ লিখে ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স অ্যাওয়ার্ড জয় করে আবু সুফিয়ানের বাংলা ব্লগ৷ ছবিতে আন্দোলনরত আবু সুফিয়ান৷
ছবি: DW
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণা
গত অক্টোবর মাসে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ আটজনকে চিহ্নিত করে সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান৷ বাকি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় গত সপ্তাহে৷ ব়্যাব গ্রেপ্তারকৃতদের বলছে ‘সন্দেহভাজন’৷ আর পরিবার মনে করছে, এদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কার্যত ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হচ্ছে৷
আন্তর্জাতিক তদন্ত চান পরিবার
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের এক বছর হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ ধরা পড়েনি মূল অপরাধীরা৷ তাই তাদের পরিবার এখন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন৷ রুনির ভাই নওশের রোমান জানিয়েছেন, তারা (ব়্যাব) তদন্তের চেয়ে হয়রানি করতে বেশি উৎসাহী৷ সাগর রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের নিরাপত্তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
জজ মিয়া নাটক চান না সাগরের মা
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও কাঁদেন৷ তাঁর দাবি হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে হবে৷ এক বছর পর দারোয়ান এনামুলকে গ্রেফতার তাঁর কাছে জজ মিয়া নাটক ছাড়া কিছুই নয়৷ তাঁর মতে, এক বছরে নানা টালবাহানা করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
11 ছবি1 | 11
ডা. তাজুল ইসলাম জানান, উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ বিত্ত পরিবারের সন্তানরাই ইয়াবায় বেশি আসক্ত হচ্ছে৷ এর প্রধান কারণ, ইয়াবার দাম বেশি৷ তাঁর মতে, ***-র ইয়াবা আসক্তির পর তার বাবা-মা তাকে আটকে রাখত৷ হয়ত একজন মাদকাসক্তকে চিকিত্সা না দিয়ে আটকে রাখার কারণে তার মধ্যে প্রতিহিংসার জন্ম নেয় এবং এই নির্মম ও করুণ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে৷ বলা বাহুল্য, মাদকাসক্তের চিকিত্সা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ তাকে যদি চিকিত্সা দেয়া হতো, তাহলে হয়ত এই ঘটনা নাও ঘটতে পারত৷ কারণ মাদকাসক্তকে চিকত্সা না দিয়ে আটকে রাখলে তার শরীরে এবং মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া এবং যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়৷ আর যারা তাকে আটকে রাখেন, তাদের চরম শত্রু মনে করে প্রতিশোধ নিতে চায় তারা৷
অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, পারিবারিক অবহেলাসহ নানা কারণে তরুণ-তরুণীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে৷ বাবা-মা ব্যস্ততার কারণে সন্তানকে সময় দেন না, যা তাদের মধ্যে বঞ্চনা ও ক্ষোভ তৈরি করে৷ বাবা-মা খোঁজ রাখেন না যে তাদের সন্তান কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে মেশে, তার বন্ধু কারা৷ এসব কারণেই বিপর্যয় নেমে আসে৷ ***-র ক্ষেত্রেও হয়ত সেটাই হয়েছে৷
তিনি বলেন, ‘গুড পেরেন্টিং' এবং সন্তানের সঙ্গে ‘কোয়ালিটি সময়' কাটানো খুব জরুরি৷ এছাড়া, সন্তানের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যেমন যাবে না৷ তেমনই তাদের অপমান অপদস্থ করা যাবে না, করা যাবে না অবহেলাও৷ তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হবে৷ তাদের ভালো কাজের প্রশংসা করতে হবে৷ তাদের কাছ থেকে বন্ধু হয়েই জানতে হবে তাদের মনের কথা৷ আর বন্ধু হয়েই করতে হবে সহযোগিতা৷ তাহলে তারা আর অন্ধকার জগতে পা বাড়াবে না৷
অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, *** তার বাবা-মাকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে৷ কিন্তু তাকে নিয়ে রগরগে কাহিনি প্রকাশ করা সংবাদমাধ্যমের কোনোভাবেই ঠিক হবে না৷ বিষয়টি দেখতে হবে অ্যাকাডেমিকভাবে৷ এ নিয়ে আলোচনা হতে হবে৷ হতে হবে প্রতিবেদন৷ তবে তা যেন হয় আমাদের সমাজের, পরিবারের এই সংকটকে দূর করার লক্ষ্য নিয়ে৷ আর *** যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তাই তার জন্য যে আইন আছে সেই আইনেই তার বিচার হতে হবে৷
শুধু তাই নয়, সংবাদমাধ্যমে তার ছবি প্রকাশেরও বিরোধিতা করেন তাজুল ইসলাম৷ বলেন, মনে রাখতে হবে মাদকাসক্তি একটি রোগ৷ তাই এই মাদকসক্তির বিরুদ্ধেই কাজ করতে হবে৷
*** জার্মানির গণমাধ্যম নীতিমালা অনুসরণ করে আলোচিত কিশোরীর নাম, ছবি প্রকাশ করা হয়নি৷