ফিজিবল না হলেও এক রকম জোর করে গোঁজামিল দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি৷ যেনতেনভাবে শেষ করে উদ্বোধন করতে চাওয়া এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নেই বললেই চলে৷
বিজ্ঞাপন
তারপরেও চলছে কাজ৷ তবে ছিল না সঠিক তদারকি আর নজরদারি৷ ফলে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা৷
বিআরটি হলো শহরের কোনো রাস্তার মাঝ দিয়ে ডেডিকেটেড একটা লেন তৈরি করে সেখান দিয়ে বিশেষায়িত বাস চালানো৷ ঐ রাস্তায় অন্য কোনো গাড়ি ঢুকতে পারে না৷ আর এই বাস শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ ছাড়া থামে না৷ ফলে যাত্রীরা দ্রুত এক স্থান থেকে অন্যত্র চলাচল করতে আর৷
বিআরটি ঘনবসতি আর বিশৃঙ্খল শহরে অনেক কার্যকর৷ আবার এর খরচও স্বল্প৷ তাই ২০০৮ সালে ঢাকায় বিআরটি করা যায় কিনা সে ব্যাপারে সমীক্ষা করা হয়৷ সমীক্ষা শেষে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রাস্তা বাছাই করা হয়৷ সকল বিবেচনায় সেটা ছিল ফিজিবল৷ কিন্তু পরবর্তীতে বাধ সাধে মগবাজার-মৌচাক উড়াল সেতু৷ এর ফলে বিআরটির রুট কমিয়ে আনা হয়৷ ফলে এই প্রকল্পের যৌক্তিকতা হারায়৷ এটি আর ফিজিবল থাকে না৷ কিছু বিশেষজ্ঞ সে সময় এই প্রকল্প বাতিলের কথা বলেন৷ তবে সরকার পরবর্তীতে বিআরটির রুট গাজীপু্র পর্যন্ত বৃদ্ধি করে এর যৌক্তিকতা দেখানো হয়৷
এর পর কাজ শুরু হলে তা চলে ধীরগতিতে৷ তবে শহর ও শহরের বাইরের গন্তব্য নিয়ে কখনও বিআরটি করা হয়৷ প্রশ্ন উঠে গাজীপুর থেকে মানুষ বিআরটির বাসে এসে বিমানবন্দরে বিপদে পড়বে৷ কেউ যদি মতিঝিল যেতে চায় তাহলে তাকে আবার যানবাহনের সেই ঝক্কির মধ্যেই পড়তে হবে৷ আস্তে আস্তে বিআরটি তার যৌক্তিকতা হারায়৷
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক যিনি অনেক প্রকল্পের মতো বিআরটি প্রকল্পেও বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়ে থাকেন তিনি বিআরটি নিয়ে হাতাশা ব্যক্ত করেন৷ আদৌ এটা বিআরটি হবে কিনা সেটাই তার কাছে বড় প্রশ্ন৷
‘‘এটা নামে বিআরটি৷ এর সাথে অনেক কিছু যোগ করে জোড়াতালি দিয়ে অন্য কিছু বানানো হচ্ছে৷ ফলে এ থেকে যে সুবিধা পাওয়া যাবার কথা তা যাবে না,'' বলছিলেন অধ্যাপক হক৷
গণপরিবহণে যাত্রীদের গণভোগান্তি
বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকিট কালোবাজারি নিয়ে মহিউদ্দিন রনি নামের এক ছাত্রের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এই খাতে অব্যবস্থাপনার চিত্র সামনে এসেছে৷ বাকি গণপরিবহণগুলোর অব্যবস্থাপনা ও ভোগান্তিতেও ক্ষুব্ধ যাত্রীরা৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
রেলের কোনো নিয়ম নেই
পারিবারিক কাজে ছোট ভাইসহ ঢাকা থেকে ঈশ্বরদী যাচ্ছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মোঃ মকবুল হোসেন৷ তিনি জানান, নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও তাদের ট্রেন স্টেশনেই আসেনি৷ টিকিটপ্রাপ্তি, সময়সীমা মেনে না চলা, যাত্রীসেবার মান খারাপ এসব অভিযোগ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ভাড় কম, তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই ট্রেনে যাতায়াত করতে হয়৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
চার ঘণ্টার পরিশ্রমে টিকিট
ঈদ ছাড়া স্বাভাবিক সময়েও রেলের টিকিট পেতে ভোগান্তি পোহান যাত্রীরা৷ ঢাকা থেকে যশোর যাওয়ার জন্য কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ২৩ জুলাই টিকিট কেটেছেন জাবেদ রহমান৷ তিনি জানান, সকাল ১০টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুর ২টায় টিকিট পেয়েছেন তিনি৷ অনলাইনে টিকিট না পাওয়ায় কাউন্টারে সময় নষ্ট করে টিকিট কাটতে হয়েছে তাকে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
তবু আগের চেয়ে উন্নতি
ঢাকার জুরাইনে একটি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন রোকেয়া আক্তার৷ তিনি পরিবারসহ রাজশাহী যাচ্ছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘গত বছর দুয়েক ধরে ট্রেনে নিয়মিত যাতায়াত করি৷ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ট্রেনে ভ্রমণ আরামদায়ক৷ ট্রেনের শিডিউল এবং টিকিট প্রাপ্তিতে আগের চেয়ে কিছুটা নিয়মশৃঙ্খলা ফিরেছে, বিশেষ উপলক্ষ্য ছাড়া মোটামুটি ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায় এখন৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
লঞ্চের প্রতিযোগিতা
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ঢাকা থেকে হাতিয়া যাচ্ছেন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী মোঃ সামিউল হাসান৷ নৌপথের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি জানান, নদীপথে প্রায়ই বড় লঞ্চগুলো ভয়ংকর প্রতিযোগিতা করে৷ তিন বছর আগে এমন এক প্রতিযোগিতায় বড় দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়ে অনেকদিন আর ভয়ে লঞ্চে যাতায়াত করেননি বলে জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদে সীমাহীন ভোগান্তি
ঢাকা থেকে প্রায় প্রতি রোজার ঈদেই গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে যান পেশায় ব্যাংকার আলী আহমদ মুন্সী৷ তিনি জানান, প্রতিবারই টিকিটের সংকটে পড়তে হয়৷ আর রাস্তায় কারণে-অকারণে ঈদের সময় যানজট তো লেগেই থাকে৷ স্বাভাবিক সময়ে যেখানে ১০ মিনিট লাগে, ঈদ বা লম্বা ছুটি থাকলে সেই রাস্তা পাড়ি দিতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নারীর প্রতি সহিংসতা
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘ঢাকায় গণপরিবহণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হন নারীরা। ২০২২ সালের এসেও আমরা নারীদের প্রতি সহিংস আচরণ করি৷ পুরুষশাসিত এই সমাজে আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদও করতে পারি না, মানুষ খারাপ বলে৷ যথাযথ আইনের শাসন এবং প্রয়োগের অভাবে এইসব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করি আমি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রতিবাদ করলে দুর্ব্যবহার
পেশায় কাপড় ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন জানান, সড়ক, রেল বা নৌ; যে পথেই আপনি চলাচল করেন না কেন, পরিবহণ সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের দৌরাত্ব্য অথবা দুর্ব্যবহার আপনাকে সহ্য করতেই হবে৷ তারা যত অন্যায়ই করুক, আপনি প্রতিবাদ করলেই বিপদ। তারা একজোট হয়ে আপনার বিরুদ্ধে তেড়ে আসবে৷’’ এক্ষেত্রে মালিক এবং সরকারপক্ষের তদারকির অভাব আছে বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
টিকিটের উপর বাড়তি ভাড়া
ঈদের ছুটি কাটিয়ে স্বামী-সন্তানসহ ঢাকায় ফিরেছেন গুলনাহার বেগম৷ গাবতলী বাস টার্মিনালে তিনি বলে বলেন, ‘‘ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময় টিকিটে লেখা ১৮০ টাকা, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে নিয়েছে ২৩০ টাকা৷ কারণ জানতে চাইলে বাসের স্টাফ বলেন, ‘কোনো কারণ নাই, গেলে যান, না গেলে নাইমা যান’৷’’ পরে তিনি অন্যান্য যাত্রীদের থেকে জানতে পারেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভয়ে এই বুদ্ধি করেছে পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পরিবারসহ যাত্রায় দুশ্চিন্তা
ঢাকার ওয়ারির বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, আমার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা৷ অধিকাংশ সময়ে পরিবারসহ ট্রেনেই যাতায়াত করি৷ কিন্তু ছুটি-ছাটা অথবা ঈদে ভোগান্তি এড়াতে পরিবারকে আগেই বাড়িতে পাঠিয়ে দেই৷’’ এতে কিছুটা সমস্যা হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই ত্যাগ তাকে স্বীকার করতে হয় বলে জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সবাই সবার কাছে জিম্মি
সায়েদাবাদের বাসিন্দা পেশায় সিএনজি চালক মোঃ জাকির হোসেন বলেন, ‘‘চাল-ডাল-তেল থেকে শুরু করে পরিবহণ খাতে সবকিছু এখন সিন্ডিকেট চালায়৷ আমি নিজেও পরিবহণের চালক, কিন্তু আমিও বিভিন্ন সময় ভোগান্তি থেকে রেহাই পাই না৷ বাংলাদেশের সবাই সবার কাছে জিম্মি, আমরা যে যার জায়গা থেকে অন্যায় করে যাচ্ছি বলেই আজকে সমাজের সর্বস্তরে এই অরাজকতা ও নৈরাজ্য চলছে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রতিবাদ
রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা, টিকিট কালোবাজারি এবং রেলখাতে দুর্নীতির প্রতিবাদে গত জুলাইয়ে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি৷ তিনি নিজে ভুক্তভোগী হবার পর থেকে এ প্রতিবাদ শুরু করেন এবং ছয়দফা দাবি উপস্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
11 ছবি1 | 11
তিনি বলেন, ‘‘শুরুতে যে কারণে এই প্রকল্পটি ফিজিবল হয়েছিল সেটা আর নাই৷ অরিজিনালি এই প্রকল্পের রুট ছিল বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল৷ তখন এটাকে দ্রুত যাত্রী বহনের জন্য উপযুক্ত মনে করেছিল সবাই৷ কিন্তু এই অরিজিনাল রুট আর নাই, এটাকে কেটে ছোট করা হয়েছে৷ নতুন রুট হয়েছে গাজীপুর-বিমানবন্দর৷''
তার মতে, পৃথিবীর ইতিহাসে বাইরে থেকে এসে ঢুকেছে এমন ফ্রাগমেন্টেট বিআরটির কোনো উদাহরণ নাই৷ বিআরটির জন্মটাই হচ্ছে পা কাটা, হাত কাটা, বাপ-মা নাই৷ অরিজিনাল রুট দেখিয়ে ফিজিবল করেছিলাম কিন্তু সে অরিজিনাল বিআরটি আর নাই৷ তাই এটা আর ফিজিবল প্রকল্প না৷ মানে অল্প বাসে দ্রুত যাত্রী পরিবহনের যে বিষয়, সেটা আর হচ্ছে৷
এদিকে ১৩০টি এসি বাস কেনার পরিকল্পনা হয়েছে বিআরটি রুটে চালানো জন্য৷ কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (বিআরটিসি) বাস চালানো সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই বাসে মানুষ কীভাবে উঠা-নামা করবে?
বিআরটির বাসে দরজা থাকে উল্টা দিকে৷ অর্থাৎ যাত্রীদের রাস্তার মাঝখান থেকে বাসে উঠতে হয়৷ কিন্তু বিআরটিসির বাস উঠতে হলে বাস বিআরটি লেন থেকে বের হয়ে ফুটপাতে আসতে হবে৷ ফলে এটা অন্য রাস্তার মতোই হয়ে যাবে৷
অধ্যাপক হকের মতে, আমাদের শহরের যে অবস্থা৷ যানজটের কারণে মানুষ বিআরটি লেনে ঢুকে পড়বে এবং কর্তৃপক্ষ তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে মনে হয়৷ এতে রাস্তায় আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে বলে মনে হয়৷
শুধু বিআরটি নয়, বরং বাংলাদেশে প্রায় সব প্রকল্পই সমীক্ষা ভালোমতো হয়৷ প্রকল্প শুরুর আগে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ বিবেচনা করে সেগুলোর সমাধান ঠিক করা৷ এছাড়াও জনগণের টাকা যৌক্তিকভাবে খরচ হচ্ছে কিনা সেটা ভালোভাবে যাচাই করতে হয়৷ এটা হয় না বলেই প্রকল্পের কাজ আরম্ভ হলে একটার পর একটা সমস্যা দেখা দেয়, সময় বাড়ে আর সাথে খরচও৷
২০০৮ সালে সমীক্ষা শুরু হলেই ২০১২ সালে ২,০৩৭ কোটি টাকার প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয়৷ ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বারবার সময় বাড়িয়ে এ বছরের মধ্যে শেষ করার কথা৷ তবে এখন প্রকল্পের ২২ শতাংশ কাজ বাকি থাকায় আগামী বছরের জুলাইয়ে শেষ হবে বলে জানা যায়৷ আর এর মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ বেড়ে যায়৷
‘‘এক্ষেত্রে সরকারের মূল্যায়নের একটা ব্যাপার আছে৷ সব প্রকল্প কী কারণে দেরি হয়, বাস্তবায়ন কেন ঠিকমতো হয় না, খরচ কেন বাড়ে বিষয়গুলো সরকারের উচিত,” মনে করেন অধ্যাপক শামসুল হক৷