এবোলার কারণে লাইবেরিয়ার অস্তিত্বই এখন প্রশ্নবিদ্ধ৷ এ কথাই বলেছেন সেদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ গিনির প্রেসিডেন্ট এবোলা বিরুদ্ধের সংগ্রামকে বলছেন ‘যুদ্ধ’৷ পশ্চিম আফ্রিকায় চলমান এ যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে অন্তত ২২৯৬ জনের প্রাণ৷
বিজ্ঞাপন
এবোলায় (বানানভেদে ইবোলা) আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে অনেক মানুষ৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)-র প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা ২২৯৬ হলেও প্রকৃত সংখ্যা যে অনেক বেশি হবে ডাব্লিউএইচও-র কোনো সন্দেহ নেই৷ গিনি, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়া এবং সেনেগাল – পশ্চিম আফ্রিকার এই পাঁচটি দেশেই মূলত এবোলার প্রকোপ দেখা দিয়েছে৷ শুরুটা গিনিতে হলেও এ রোগ মহামারির রূপ নিয়েছে লাইবেরিয়ায়৷ তবে সে দেশের সরকার সংক্রমিত রোগী বা নিহতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়মিত জানাচ্ছে না৷
তবে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে অসহায় বোধ করছে লাইবেরিয়া সরকার৷ সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রাউনি সামুকাই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক অধিবেশনে বলেছেন, এবোলার কারণে তাঁর দেশের অস্তিত্বই আজ হুমকির মুখে৷ সামুকাই বলেন, ‘‘রোগটি লেলিহান শিখার মতো ছড়িয়ে পড়ছে, আগুনের মতোই পথে যা পাচ্ছে সব শেষ করে দিচ্ছে৷'' এমন বিপর্যয় থেকে লাইবেরিয়াকে বাঁচাতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আরো উদ্যোগী হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি৷
মহামারি ইবোলা ভাইরাস
ইবোলা বা এবোলা ভাইরাসকে চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ভাইরাস হিসেবে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ এতে আক্রান্ত হলে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর অবধারিত৷ তাই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা জারি করেছে সংস্থাটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান মার্গারেট চান এবোলাকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি অন্যতম ঘাতক জ্বর হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন যে, আফ্রিকায় মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে রক্তপ্রদাহজনিত এই জ্বর৷ তাই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন তিনি৷
ছবি: picture alliance/dpa
পশ্চিম আফ্রিকায় মহামারি
মারাত্মক এবোলা ভাইরাসের আক্রমণে পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ১,০০০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৭১১৷ গিনিতে গত মার্চে প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে এবোলা ভাইরাসের প্রকোপ কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
লাইবেরিয়ায় জরুরি অবস্থা
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হিসেবে বিশ্বে এই ভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে অন্যতম দেশ লাইবেরিয়ায় বৃহস্পতিবার জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে৷ এতে সরকার বিভিন্ন কঠোর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে৷ প্রাণঘাতী এবোলা ভাইরাস এখন আফ্রিকা থেকে বিশ্বের অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
আক্রান্ত অন্যান্য দেশের নাগরিক
স্পেনের একজন প্রবীণ ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারক মারাত্মক অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে গেছেন৷ তিনি এবোলায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ সৌদি আরবে একজন রোগীর মৃত্যুর কারণও এবোলা বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা৷ নাইজেরিয়াতেও একজন নার্স এবোলার সংক্রমণে মারা গেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এবোলা সংক্রমণের লক্ষণ
এবোলায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মারাত্মক জ্বর এবং কারও কারও অবিরত রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে৷ সঙ্গে থাকে মাথা, পেশী এবং তলপেটে তীব্র ব্যথা৷ রোগীর একদিকে ক্ষুধা কমে যায়, অন্যদিকে শুরু হয় পাতলা পায়খানা৷ সাধারণত শরীর থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন তরল পদার্থের মাধ্যমে ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আক্রান্ত চিকিৎসক
বলা বাহুল্য, আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচর্যাকারীর মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি৷ লাইবেরিয়াতে যেমন এবোলা রোগীদের পরিচর্যাকারী দুই মার্কিন স্বাস্থ্যকর্মী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর, তাঁদের চিকিৎসার জন্য সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংক্রমণের আশঙ্কা
মূলত কোনো প্রাণী বা মানুষের রক্ত, বীর্য, যোনিরস বা দেহ নির্গত অন্য কোনো তরলের সংস্পর্শে এ রোগ ছড়ায়৷ বলা বাহুল্য, অনিয়ন্ত্রিত এবং অনিরাপদ যৌন মিলনেও এ রোগের সংক্রমণ হয়ে থাকে৷ অর্থাৎ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এইডস রোগের সঙ্গে এবোলার মিল রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
উড়ন্ত খ্যাঁকশিয়াল
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পশ্চিম আফ্রিকায় এবোলা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ উড়ন্ত খ্যাঁকশিয়াল৷ এই প্রাণীটি ভাইরাসটি বহন করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ এমনকি সংক্রমিত প্রাণীটি যখন ফলমূল ও অন্যান্য প্রাণী খাচ্ছে, তখন সেসব খাদ্যের অবশিষ্ট অংশ থেকেও ছড়িয়ে পড়ছে এবোলা৷
ছবি: imago
সংক্রমণের ঝুঁকি
তার মানে শুধু মানুষ থেকে মানুষে নয়, মানুষ যখন এবোলায় আক্রান্ত প্রাণীর রক্ত বা মাংসের সংস্পর্শে আসে, তখনও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷ বরং সেক্ষেত্রে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলে জানান চিকিৎসকরা৷ তাই খ্যাঁকশিয়াল থেকে অন্য প্রাণী বা ফলমূল হয়ে সহজেই মানুষের মধ্যে এবোলা ভাইরাস তার বংশবৃদ্ধি করে৷
ছবি: DW
৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যু
এবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর অবধারিত৷ সেজন্যই তো একে মহামারি বলে আখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: Reuters
বড় সমস্যা
বলা বাহুল্য, আফ্রিকায় বন্য প্রাণী খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে৷ সব বাজারেই এ সব মাংস পাওয়া যায়৷ গবেষকদের ধারণা, এ ধরনের বন্য প্রাণীর মাংস থেকে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এবোলা৷ তার সঙ্গে অনিরাপদ যৌন মিলন তো রয়েছেই!
ছবি: picture-alliance/dpa
পরীক্ষামূলক ওষুধ এখনই নয়
এবোলা সংক্রমণ নিরাময়ের উপায় এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি৷ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি একটি ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করার সময় এখনো আসেনি বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ কারণ মার্কিন দুই স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর ওষুধটি প্রয়োগে তাঁদের উন্নতির ধরণে তারতম্য দেখা গেছে৷
ছবি: LEON NEAL/AFP/Getty Images
12 ছবি1 | 12
এর আগে ডাব্লিউএইচও-র মহামারি বিষয়ক বিভাগের প্রধান সিলভি ব্রায়ান্ড পশ্চিম আফ্রিকায় কর্মরত সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রতি এবোলা-আক্রান্ত দেশগুলোতে সহায়তা বৃদ্ধির আহ্বান জানান৷ তিনি বলেন, সহায়তার মাত্রা বর্তমানের তুলনায় অন্তত তিন-চার গুণ না বাড়ালে এবোলার হাত থেকে দেশগুলোকে রক্ষা করা যাবেনা৷ যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে এবোলা-বিরোধী এ লড়াইয়ে ৮৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে৷
পশ্চিম আফ্রিকায় এবোলা ভাইরাস সংক্রমণের ফলে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে বলে বিশ্বব্যাপীই ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক৷ বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দর সতর্কাবস্থায় রয়েছে৷ ব্রিটেনের বিমান কর্তৃপক্ষ ‘ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ' এবং ফ্রান্সের ‘এয়ার ফ্রান্স' লাইবেরিয়া, গিনি, সিয়েরা লিওন এবং নাইজেরিয়ায় সব ফ্লাইট বাতিল করে দিয়েছে৷
আক্রান্ত রোগীরা দেশে ভালো চিকিৎসা পাচ্ছেন না৷ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে অনেকে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন৷ গিনিতে এ পর্যন্ত এবোলার কারণে মারা গেছেন ৫৫৫ জন৷ প্রতিবেশী দেশ গাম্বিয়া ইতিমধ্যে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে৷ ফলে গিনি, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়া এবং সেনেগাল থেকে কেউ সে দেশে যেতে পারছেন না৷ গাম্বিয়ার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এব্রিমা কুরুমা জানিয়েছেন, তাঁর দেশের নাগরিকদের এখন গিনি, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়া এবং সেনেগালে না যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে৷ সেনেগাল সীমান্তে কর্মরত এ কর্মকর্তা আরো জানিয়েছেন, তারপরও কেউ এবোলার প্রকোপ দেখা দিয়েছে এমন কোনো দেশে গেলে তাঁকে আর গাম্বিয়ায় ফিরতে দেয়া হবে না৷