জ্বালানি-নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে জার্মানি ও ইইউ
১৮ মে ২০২২
ইউক্রেন সংকটের জের ধরে তেল ও গ্যাসের বিকল্প উৎস সন্ধানের পাশাপাশি জার্মানি আরও পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন এবং জ্বালানি সাশ্রয়ের উদ্যোগ নিচ্ছে৷ ইইউ এক কর্মসূচি ঘোষণা করছে৷
বিজ্ঞাপন
ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার হামলার ফলে ইউরোপের জ্বালানি নির্ভরতার মাত্রা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ রাশিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে গিয়ে জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলিকে রাতারাতি পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসের বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে হচ্ছে৷ তবে মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে জ্বালানি আমদানিও দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে৷ তাই রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করার লক্ষ্যে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের উদ্যোগও চলছে৷ সেইসঙ্গে অপচয় বন্ধ করে জ্বালানি সাশ্রয়ের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে৷
এমন বিশাল পরিবর্তন তরান্বিত করতে ইউক্রেন সংকটকে শাপে বর হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা৷ জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর ও অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রী রোব্যার্ট হাবেক জ্বালানি সাশ্রয়ের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মসূচির খসড়া তৈরি করছেন৷ তাঁর মতে, জ্বালানির সাশ্রয়ের মাধ্যমে এক ঢিলে অনেক পাখি মারা সম্ভব৷ কারণ একমাত্র এভাবেই জলবায়ু সংরক্ষণ, দেশকে আরও শক্তিশালী করা এবং ব্যয় কমানো সম্ভব৷ জ্বালানির ক্ষেত্রে রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমাতে এর থেকে সস্তা ও দক্ষ পথ আর হয় না বলে তিনি মনে করছেন৷ সরকরি কর্মসূচি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে বিশাল প্রচার অভিযানেরও পরিকল্পনা করছেন হাবেক৷
হাবেক সেই লক্ষ্যে এক বহুমুখী পরিকল্পনা প্রস্তুত করছেন৷ এর আওতায় পুরানো বাড়িঘর গরম রাখার জন্য তেল ও গ্যাস ব্যবহার দ্রত কমিয়ে আনা হবে৷ জ্বালানি সাশ্রয় করে ঘর উষ্ণ রাখতে সেকেলে জানালা-দরজাও বদলে ফেলতে হবে৷ ভাড়া বাড়িতেও এমন সব পদক্ষেপ কার্যকর করতে শুধু ভাড়াটে নয়, মালিকদেরও হিটিংয়ের খরচের ভাগীদার করা হবে, যাতে তাঁরা ব্যয় কমাতে নিজস্ব উদ্যোগে প্রয়োজনীয় সংস্কার চালান৷ হিটিং-এর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির বিকল্প উৎস হিসেবে ‘হিটিং পাম্প’ লাগানোর জন্যও সরকার আর্থিক সহায়তা দেবে৷ তখন বাতাস, মাটি অথবা ভূগর্ভস্থ পানি থেকেই ঘর গরম রাখার উত্তাপ সংগ্রহ করা যাবে৷ আগামী বছর থেকে ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে হলে কড়া পরিবেশগত মানদণ্ড মেনে চলতে হবে৷
শিল্পজগতের বিশাল জ্বালানির প্রয়োজন মেটাতেও উদ্যোগ নিতে চায় জার্মানির সরকার৷ জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির বদলে আরও বেশি ‘গ্রিন হাইড্রোজেন' ব্যবহার বাড়াতে নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে৷ যে সব কলকারখানা বাড়তি ব্যয় করে এমন বিকল্প উৎস ব্যবহার করবে, সেগুলির বাড়তি ব্যয় আপাতত সরকার বহন করবে৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নও এমন এক সার্বিক জ্বালানী নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নিচ্ছে৷ বুধবারই সেই কর্মসূচি পেশ করা হচ্ছে৷ রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমানোই এর প্রাথমিক লক্ষ্য৷ সেটা সম্ভব করতে একদিকে বিকল্প জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানো হবে এবং অন্যদিকে জ্বালানি সাশ্রয় করা হবে৷
এসবি/কেএম (ডিপিএ, রয়টার্স)
বায়ুবিদ্যুতের ভবিষ্যৎ কী?
বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যম হিসাবে বায়ু ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে৷ উইন্ড টারবাইনগুলোও বড়, লম্বা এবং আরো কর্মক্ষম হয়ে উঠছে। বিশ্বের বিদ্যুতের প্রায় সাত শতাংশ এখন বায়ু শক্তি থেকে আসে।
ছবি: Jan Oelker
অতীত ও বর্তমান
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শক্তি হিসাবে বায়ুর ব্যবহার হয়ে আসছে৷ জল সেচ, শস্য মাড়াই, কাঠ কাটা এবং পালতোলা জাহাজ, এমন নানা কাজে বায়ুর ব্যবহার দীর্ঘদিনের৷ ইউরোপে ঊনবিংশ শতকেই কয়েক হাজার টারবাইন ছিল৷ ডাচরা প্রধানত এগুলো জলাভূমি নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহার করতো৷ তবে এখন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ক্লিন এনার্জি হিসাবে বায়ুর ব্যবহার দিন দিন আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে৷
ছবি: picture-alliance/ImageBroker/J. Tack
কয়লাকে হারিয়ে দিচ্ছে বায়ু
বায়ু টারবাইন থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ বেশ সস্তা৷ এখন কয়লা বা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে এর কয়েকগুণ বেশি খরচ পড়ে৷ উপযুক্ত পরিবেশে টারবাইন স্থাপন করলে ২০৩০ সালের মধ্যে এ খরচ আরো কমে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা কেবল তিন ইউরো সেন্ট বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩০ টাকায় নেমে আসতে পারে৷
ছবি: picture alliance / Zoonar
২০ গুণ বেশি বিদ্যুৎ
উত্তর জার্মানির ভিলহেল্মশাভেনের কাছে স্থাপিত একটি বড় বায়ু টারবাইন ছয় হাজার কিলোওয়াট শক্তি উৎপাদন করে এবং সেখানকার ১০ হাজার মানুষের গৃহস্থালীর বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করে৷ ২৫ বছর আগের পুরাতন মডেলগুলো কেবল ৫০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারতো৷ আধুনিক টারবাইনগুলি এখন আকাশে ১৮০ মিটার পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। টারবাইনের ডানা যত লম্বা হয়, তত বেশি বাতাস কাজে লাগানো সম্ভব হয়৷
ছবি: Ulrich Wirrwar/Siemens AG
সমুদ্রেও টারবাইন
সমুদ্রে বায়ুপ্রবাহ সবসময়ই বেশ শক্তিশালী৷ বিশ্বের বায়ুবিদ্যুতের প্রায় পাঁচ শতাংশ নেদারল্যান্ডসের সমুদ্রে স্থাপিত টারবাইন থেকে আসে৷ এমন টারবাইন ১০ হাজার কিলোওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে৷ ২০২৫ সাল থেকে এই উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ হাজার কিলোওয়াটে পৌঁছে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে৷ এই বিদ্যুৎ দিয়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব৷
ছবি: Siemens Gamesa
সবার আগে চীন
বিশ্বে যত বায়ু টারবাইন স্থাপন করা হয়েছে, তার অর্ধেকই চীনে অবস্থিত৷ কেবল ২০২০ সালেই দেশটি নতুন কিছু টারবাইন স্থাপন করেছে, যেগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫২ গিগাওয়াট৷ এটি প্রায় ৫০টি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে সমান৷ তবে দেশের মোট চাহিদার হিসাবে বায়ুবিদ্যুতের সম্প্রসারণে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ডেনমার্ক ও জার্মানি৷ ডেনমার্কের চাহিদার অর্ধেকের কাছাকাছি আসে বায়ুবিদ্যুৎ থেকে, জার্মানির আসে ২৫ শতাংশ৷
বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৩ লাখ মানুষ বায়ু শিল্পে কাজ করেন৷ এর মধ্য়ে চীনে সাড়ে পাঁচ লাখ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক লাখ ১০ হাজার, জার্মানিতে ৯০ হাজার, ভারতে ৪৫ হাজার এবং ব্রাজিলে ৪০ হাজার মানুষ কাজ করেন৷ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের চেয়ে বায়ু টারবাইন স্থাপন ও পরিচালনা ব্যয়বহুল৷ তবে এ খাতের সম্প্রসারণ আরো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে৷
ছবি: Paul Langrock/Siemens AG
স্থানীয়রাও লাভবান হতে চান
ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে, বায়ু টারবাইন স্থাপনের প্রকল্প প্রায়ই স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তবে নাগরিকদেরও স্থানীয় প্রকল্পে যুক্ত করা গেলে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে স্টারকেনবুর্গে অনেক বাসিন্দা বায়ুশক্তির সম্প্রসারণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তারা নতুন টারবাইনে বিনিয়োগ করছেন এবং বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে লাভও করছেন৷
ছবি: Energiegenossenschaft Starkenburg eG
আবার ফিরছে পালতোলা নৌযান
একসময় পালতোলা জাহাজেই বিশ্বজুড়ে মালামাল ও যাত্রী পরিবহণ করা হতো৷ ধীরে ধীরে সেই স্থান দখল করে ডিজেল ইঞ্জিন৷ কিন্তু এখন আবারও পালতোলা নৌযান ফেরত আসছে আধুনিক রূপে৷ বাতাসের শক্তিকে আরো বেশি কাজে লাগিয়ে শক্তির ব্যবহার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব হতে পারে৷ ভবিষ্যতে সবুজ হাইড্রোজেনও জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার হতে পারে৷
ছবি: Skysails
ভাসমান বায়ু টারবাইন
বায়ুশক্তি কাজে লাগানোর জন্য সমুদ্রে পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। কিন্তু অনেক জায়গায় টারবাইন স্থাপনের জন্য সমুদ্র বেশ গভীর। ভাসমান টারবাইন এক্ষেত্রে একটি বিকল্প হতে পারে৷ দীর্ঘ শেকল দিয়ে ভাসমান বয়াকে সমুদ্রতলে স্থির রাখা হয়৷ ভাসমান বায়ু টারবাইন এরইমধ্য়ে ইউরোপ এবং জাপানে স্থাপন করা হয়েছে৷ এগুলো ঝড়ের সময়ও বেশ স্থিতিশীল থাকে।
ছবি: vestas.com
বাড়ির জন্য বায়ুশক্তি
লন্ডনের ১৪৭ মিটার উঁচু আকাশচুম্বী ভবন স্ট্রাটা এসই-ওয়ান এমন বায়ু টারবাইনের একটি নজরকাড়া উদাহরণ৷ কিন্তু ছাদে এমন স্থাপনা সাধারণত লাভজনক হয় না, কারণ শহরগুলোতে বাতাসের প্রবাহ সাধারণত খুব দুর্বল হয়। তবে ছাদে ফটোভোলটাইক সিস্টেম এক্ষেত্রে দারুণ বিকল্প হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/Global Warming Images/A. Cooper
সবচেয়ে পরিবেশ বান্ধব
বায়ু টারবাইন তৈরি করতে যে শক্তি ব্যয় হয়, তিন থেকে ১১ মাসের মধ্যে সেই শক্তি টারবাইনগুলো উৎপন্ন করতে পারে। এই বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোন কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপাদন হয় না৷ অন্যান্য অনেক শক্তির তুলনায়, বায়ুশক্তি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বেশি ভূমিকা রাখে। জার্মানির ফেডারেল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির মতে, বায়ুবিদ্যুতের পরিবেশগত ব্য়য় কয়লা-চালিত বিদ্যুতের তুলনায় ৭০ গুণ কম।
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Tack
বায়ুশক্তি কোথায় সম্ভব?
বায়ু এবং সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলে বিশ্বের শক্তির চাহিদা মেটাতে পারে। বিদ্যুৎ টারবাইনগুলোর বিদ্যুৎ উপাদনের জন্য ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার বা বেশি গতির বায়ুপ্রবাহ প্রয়োজন হয়৷ যেসব অঞ্চলে প্রচুর সূর্যের আলো রয়েছে সেখানে ফটোভোলটাইক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে সস্তা উৎস হতে পারে। বিষুবরেখার উত্তর ও দক্ষিণে কাছাকাছি অঞ্চলে বায়ু এবং সৌরশক্তির মিশ্র ব্যবহার সম্ভব। বায়ুশক্তির ক্ষেত্রে শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ প্রয়োজন৷