একা যা করা যায় না, সবাই মিলে সেই কাজ প্রায়ই সহজ হয়ে ওঠে৷ প্রকৃতির মধ্যে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই৷ কিন্তু বিশেষ এক প্রজাতির সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তা বিজ্ঞানীদের অবাক করছে৷ তাদের আচরণ বিশ্লেষণ করে অনেক তথ্য জানা যাচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
ইয়ান কুজিন বড় একটা পুল তৈরি করিয়েছেন৷ তার মধ্যে স্টিকলব্যাক মাছের চারাপোনা কিলবিল করছে৷ পুলের কিছু অংশে আলো, কিছু অংশে ছায়া রয়েছে৷ মাছেরা রোদের তাপ এড়িয়ে যতটা সম্ভব ছায়ার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে৷ এই প্রজাতির মাছের জন্য এমন আচরণ অত্যাবশ্যক৷ কারণ রোদের আলোয় তাদের ত্বক জ্বলজ্বল করে৷ শত্রুরা তাদের সহজেই শনাক্ত করতে পারে৷
ইয়ান কুজিন যখন একটিমাত্র মাছকে পানিতে ছেড়ে দেন, তখন কিন্তু সেটি ছায়া খুঁজে পায় না৷ সম্ভবত শুধু ঝাঁকের মধ্যেই তাদের এই ক্ষমতা প্রকাশ পায়৷ তিনি বলেন, ‘‘ঝাঁক হিসেবে তারা যে সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তা দেখায়, তা সত্যি বিস্ময়কর৷ এককভাবে কোনো সমস্যা সমাধান করতে না পারলেও গোষ্ঠীবদ্ধ হিসেবে প্রায়ই তা সম্ভব হয়৷''
কিন্তু এই সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তা কীভাবে সম্ভব? ঝাঁকের মধ্যে মাছেরা কীভাবে এমন ক্ষমতা আয়ত্ত করে, এককভাবে যা সম্ভব নয়?
মাছেরও আছে অনুভূতি
গোল্ড ফিশ মেমোরি বলে একটা কথা আছে৷ কারো ক্ষণস্থায়ী স্মৃতির তুলনা দিতে ব্যবহার হয় এই মাছের স্মৃতিকে৷ কিন্তু মাছের যে নানা রকমের অনুভূতিও আছে, সেটা কি জানেন? না জানলে জেনে নিন৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
অনুভব করতে পারে মাছ
একসময় মাছকে মনে করা হতো অনুভূতিহীন প্রাণী৷ কিন্তু ধীরে ধীরে বিজ্ঞানীরা জানতে পারছেন যে, মাছেরও আছে নিজেদের সামাজিক জীবন৷ তারা শোক প্রকাশ করে, একসাথে শিকারে যায় এমনকি বিভিন্ন অদ্ভুত রকমের যৌন সম্পর্কেও জড়ায়৷ মাছের এই অজানা জীবন দেখতে হলে যেতে হবে সাগরের গভীরে৷
ছবি: Fotografie Dos Winkel, www.dos-bertie-winkel.com & www.seafirst.nl
মাছেরও আছে দেহরক্ষী!
মাছেরাও একে অপরকে রক্ষা করে৷ব়্যাবিট ফিশ বা খরগোশ মাছরা দুপুরে একসাথে খেতেও যায়৷ একজন যখন গভীর জলে প্রবালপ্রাচীরে জন্মানো শেওলা খেতে ব্যস্ত, অন্যজনের চোখ তখন শিকারিদের সন্ধানে৷ এভাবে ভাগাভাগি করেই খাবার খায় খরগোশ মাছ৷ এতদিন শুধু উচ্চবুদ্ধির প্রাণীদের মধ্যেই এমন সামাজিকতা দেখা যেতো৷
ছবি: gemeinfrei
ভয়ে জড়োসড়ো
অনেকদিন ধরে মনে করা হতো মাছেরা ভয় পায় না৷ কারণ, ভয় পাওয়ার জন্য মস্তিষ্কের যে অংশ দায়ী, তা মাছের নেই৷ কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মাছেরাও ভয় পায়৷ শুধু তাই না, ব্যথা এবং চাপ অনুভব করার ক্ষমতাও আছে মাছের৷ এ নিয়ে অবশ্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ বিতর্কও চলছে৷ মৎসকল্যাণ কর্মীরা মাছ শিকার বিষয়ে নতুন করে ভাবার কথাও বলছেন৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/H. Goethel
বাসা ভাগাভাগি
আড্ডা তো আমাদের খুবই পছন্দ৷ ছুটির দিনে বন্ধুদের বাসায় নিয়ে এসে গল্প করতে কার না ভালো লাগে৷ ক্লাউন ফিশ বা সং মাছ অবশ্য আড্ডা দেয় কিনা জানা যায়নি৷ তবে তাদের বাসায় কিন্তু বন্ধুবান্ধবের অভাব হয় না৷ বিষাক্ত এক ধরনের জলজ ফুলগাছে বাসা বানায় এই মাছ, যা শিকারিদের দূরে রাখে৷ প্রায়ই এক মাছের বাসায় কয়েকদিন বেড়াতে আসে অন্য কোনো এক মাছ৷
ছবি: Fotografie Dos Winkel, www.dos-bertie-winkel.com & www.seafirst.nl
শিকারি বন্ধু
গ্রাউপার মাছ দেখতেই কেমন বদখত৷ তার মধ্যে আবার মোরে ঈলের সাথে জুটি বেঁধে শিকারে গেলে অন্যদের তো ভয়েই পালানোর কথা৷ গবেষকরা বলছেন, গ্রাউপার মাছ শিকারে যাওয়ার সময় মাথা ঝাঁকায়৷ ঈল সে ইশারা বুঝতে পেরে অন্য মাছের বাসায় ঢুকে পড়ে৷ দুর্ভাগা মাছ হয় বাসার ভেতরেই ঈলের খাবারে পরিণত হয়, নাহলে পালাতে গিয়ে ঢুকে পরে বাইরে হাঁ করে থাকা গ্রাউপারের মুখে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/H. Schmidbauer
5 ছবি1 | 5
গবেষকরা বহুকাল ধরে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন এবং মাছেদের পর্যবেক্ষণ করছেন৷ তাঁরা প্রাচীন এক রুশ বইয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত খুঁজে পেয়েছেন৷ দিমিত্রি রাডাকভ বুঝতে পেরেছেন, যে গোষ্ঠীর নিজস্ব চরিত্র গড়ে ওঠে৷ ইয়ান কুজিন ও তাঁর সহকর্মীরা আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সেই আইডিয়াকে আরও সূক্ষ্ম করে তুলেছেন৷ গবেষকরা প্রতিটি মাছের পিঠে বারকোড লাগিয়েছেন৷ ফলে প্রত্যেকটি মাছকে আলাদাভাবে চেনা ও সব সময়ে শনাক্ত করা সম্ভব৷ তারপর তিনি বড় পুকুরে মাছের ঝাঁক ছেড়ে দিয়েছেন৷ প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছগুলি ছায়ার মধ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে৷
একটি ক্যামেরা সর্বক্ষণ তাদের ছবি তুলে যাচ্ছে৷ পরে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রত্যেকটি মাছের গতিপথ দেখা যায়৷ পর্যবেক্ষণের সময় বিজ্ঞানীদের আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ একটি বিষয় চোখে পড়লো৷ দেখা গেল, ছায়ার মধ্যে এলে মাছেদের সাঁতারের গতি কমে যায়৷
গতির এই পার্থক্য ঝাঁকের মধ্যে কী পরিবর্তন আনছে, ড. কুজিন সে দিকেও লক্ষ্য রাখছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করার পর আমরা প্রতিটি মাছের গতিবৃদ্ধির প্রবণতা, তাদের মধ্যে সামাজিক প্রভাবের দিকে নজর দিতে পারি৷ তাদের মধ্যে যোগাযোগ বেশ স্পষ্টভাবে কল্পনা করা যায়৷ ঠিক যেন স্প্রিং বা ইলাস্টিক দিয়ে যুক্ত৷ বোঝা যায়, যোগাযোগের এই নেটওয়ার্ক কীভাবে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে তাদের সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে৷ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ অদৃশ্য এক স্প্রিং-এর মতো৷ দুটি মাছ একসঙ্গে এগোলে প্রথমটি ছায়া পেয়ে গতি কমিয়ে দিলে অন্যটি দ্রুত এগোতে থাকে৷ তারপর যেন স্প্রিং-এর টানে সে ছায়ার দিকে চলে আসে৷ এমনকি দ্বিতীয় মাছটি সেটা জানতেই পারে না৷''
এই মাছের ঝাঁকের মধ্যে একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়৷ তারা পাশের মাছেদের সঙ্গে সমান দূরত্ব বজায় রাখে৷ কিন্তু গতি কমার কারণে কোনো মাছ পিছিয়ে গেলে প্রথমে দূরত্ব বেড়ে যায়৷ স্পিং-এ টান পড়লে ঠিক যেমনটা ঘটে৷ তারপর মাছটি আবার ঝাঁকের কাছে চলে আসে৷
মাছের জগতের আশ্চর্য
পৃথিবীতে মাছের প্রজাতি প্রায় তিন হাজার৷ তাদের মধ্যে কিছু কিছু মাছ সত্যিই চমকে দেবার মতো, যেমন ইলেকট্রিক ইল বা বৈদ্যুতিক পাঁকাল মাছ৷
ছবি: imago/Olaf Wagner
ইলেকট্রিক ইল
ইলেকট্রিক ইল কিন্তু পাঁকাল মাছ নয়, বাংলায় সে পড়বে ছুরি মাছদের পর্যায়ে৷ ৬০০ ভোল্ট অবধি ইলেকট্রিক শক মারতে পারে! সেভাবেই শিকার ধরে - বা মারে - এই বৈদ্যুতিক পাঁকাল৷ গবেষণা করে দেখা গেছে যে, বাদুড়রা যেমন শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে পোকামাকড়ের অবস্থান জানতে পারে, তেমন ইলেকট্রিক ইল’ও কারেন্ট মারার সময় সেই পন্থায় শিকারের অবস্থিতিও জানতে পারে৷
ছবি: imago/Olaf Wagner
ডোরাকাটা তীরন্দাজ মাছ
এই মাছগুলো জলের নীচে থেকেই পুকুরের ধারের ঘাস-গুল্ম থেকে পোকামাকড় শিকার করতে পারে৷ কিভাবে? মুখ থেকে জলের পিচকিরি ছুঁড়ে পোকাগুলোকে পানিতে ফেলে দেয় এই তীরন্দাজ মাছ৷ বড় মাছগুলো তিন মিটার দূরত্বে বসা শিকারকে ঘায়েল করতে পারে!
এই মাছটি বালির মধ্যে শরীর ডুবিয়ে বসে থাকে শিকার ধরার আশায়৷ শিকার এলে লাফ দিয়ে উঠে শিকার ধরে৷ স্টারগেজার মাছের চোখ মাথার উপর বসানো, থ্যাবড়া মুখটাও ওপরদিকে বাঁকানো৷ মনে রাখতে হবে, মাছটি কিন্তু বিষাক্ত৷
ছবি: picture-alliance / OKAPIA KG
স্টোনফিশ বা পাথর মাছ
এ’মাছটিও বিষাক্ত এবং ক্যামোফ্লেজ, মানে ছদ্মবেশ ধারণে ওস্তাদ৷ দেখলে মনে হবে যেন শ্যাওলায় ঢাকা এক টুকরো পাথর৷ কিন্তু পায়ের নীচে পড়লেই বিষাক্ত কাঁটাগুলো ফুটে যাবে! বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত মাছগুলোর মধ্যে পড়ে এই পাথর মাছ৷ সে বিষে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে৷
ছবি: gemeinfrei
পটকা মাছ
পটকা মাছেদের পেটটা রাবারের মতো বাড়ে বা কমে৷ পটকা মাছেরা পেটে পানি ঢুকিয়ে বলের মতো গোলাকৃতি হয়ে যেতে পারে৷ এদের শরীরেও টেট্রোডোটক্সিন নামের একটি মারাত্মক বিষ আছে৷ জাপানে এই মাছ সুখাদ্য বলে পরিগণিত৷ তবে অতি সাবধানে কাটতে হয়, বিষের অংশটা বাদ দিয়ে৷ কেননা সে’ বিষে মানুষ মরতে পারে৷
ছবি: picture alliance/Arco Images
অ্যাঙ্গলার ফিশ বা মাছ ধরা মাছ
এই মাছের মাথায় ইলিসিয়াম নামধারী একটি আঙুলের মতো দেখতে আঁচিল আছে৷ সেই আঁচিলের ওপর দিকটা বাতির মতো জ্বল জ্বল করে, যা’তে হবু শিকাররা আকৃষ্ট হয়৷ তারপরেই সেই শিকার অ্যাঙ্গলার মাছের সুবিশাল মুখগহ্বরে ঢুকে যায়৷ এই মাছের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, বিশ্বের সর্বত্র এদের পাওয়া যায়, এমনকি গভীর সমুদ্রেও৷
ছবি: Flickr/Stephen Childs
ভাইপার ফিশ বা সর্প মাছ
আজগুবি মাছ দেখতে হলে যেতে হয় সাগরের অতলে৷ সেখানে জলের চাপ বেশি, আলো প্রায় নেই বললে চলে, খাবারও কম৷ এই পরিবেশে শিকার ফসকালে চলবে না৷ তাই ভাইপার ফিশদের দাঁত, মুখ, সবই ভয়ংকর, ভয়াবহ...
ছবি: picture-alliance/dpa
প্লেইস বা রূপচাঁদা মাছ
চাঁদা মাছরা চ্যাপটা৷ তাদের ক্যামোফ্লেজ বা নিজেকে লুকনোর ক্ষমতা অসাধারণ, বিশেষ করে কাদার মধ্যে৷ মজার কথা: বড় হওয়ার সময় তাদের একটা চোখ মাথার এপাশ থেকে ওপাশে চলে গিয়ে অন্য চোখটির সঙ্গে যুক্ত হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa/H.Bäsemann
সিহর্স ঘোড়া নয়
যদিও এই ছোট্ট মাছগুলোকে ঘোড়ার মতো দেখতে এবং এদের প্রকৃতিও অত্যন্ত নিরীহ৷ দ্বিতীয়ত, ‘সাগরের ঘোড়া’ নামধারী এই মাছগুলি চিৎ হয়ে নয়, খাড়া হয়ে সাঁতার কাটে - ফলে এরা খুব ভালো সাঁতারু হয় না৷ তৃতীয়ত, পুরুষ সিহর্সরা নিষিক্ত ডিমগুলোকে পেটের ভাঁজে বয়ে নিয়ে বেড়ায় এবং পরে বাচ্চাদের জন্মও দেয়৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
মাডস্কিপার বা লাফানো কাদা মাছ
মাডস্কিপাররা মাছ হলেও, তাদের জল বেশি পছন্দ, না ডাঙা বেশি পছন্দ, তা তারা কখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি৷ নিঃসন্দেহে মাছ হলেও, তারা পাখনা ব্যবহার করে কাদার ওপর দিয়ে হাঁটতে পারে৷ এছাড়া তারা অন্যান্য উভয়চরের মতো ত্বক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/MAXPPP
হাতুড়ি-মাথা হাঙর
বিজ্ঞানীদের মতে হ্যামারহেড শার্কের মাথাটা হাতুড়ির মতো দেখতে হওয়ার কারণ হল, এর ফলে তার চোখ দু’টো আরো দূরে দূরে হয়৷ ফলে হাতুড়ি-মাথা হাঙর আরো বেশি দেখতে পায়... যেমন শিকার...