মাসেল বা কালো ঝিনুক ইউরোপে সুখাদ্য বলে পরিচিত৷ কাজেই ঝিনুকের খামারে লাখ লাখ টন মাসেল ‘উৎপাদন' করা হয়ে থাকে৷ কিন্তু সেই উৎপাদনের পদ্ধতিতে ঝিনুক, পানি ও জ্বালানিরও অপচয় হয়৷ সেটা কমানোর পন্থা খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা৷
বিজ্ঞাপন
ইংরেজিতে বলে শেলফিশ, অর্থাৎ শক্ত খোলসওয়ালা কম্বোজ বা কবচী প্রাণী – সহজ কথায় ঝিনুক বা কাঁকড়া, চিংড়ি ইত্যাদি৷ মাসেল হল এক ধরনের কালো ঝিনুক, যার খোলার ভিতরের অংশটি ইউরোপে সুখাদ্য বলে পরিচিত – কাজেই অন্যান্য মাছের মতোই, মাসেল-এরও চাষ হয়ে থাকে৷ উৎপাদন বছরে প্রায় পাঁচ লাখ টন৷ঝিনুকের চাষকে আরো দক্ষ ও পরিবেশ সম্মত করার জন্য বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে৷ ঝিনুক খামারের মালিক আন্ডার্স গ্রানহেড বলেন, ‘‘আমরা আজ যে চার থেকে পাঁচ টন ঝিনুক তুলেছি, তার প্রায় ৩০ শতাংশ ফেলা যাবে, বলে আমার ধারণা৷ এই প্রকল্প থেকে আমাদের অভিজ্ঞতার ফলে আমরা পাঁচ থেকে দশ শতাংশ অপচয় কমাতে পেরেছি৷''
ঝিনুক খামারে অপচয় বন্ধের উদ্যোগ
04:27
ঝিনুক চাষিদের সঙ্গে থেকে ও ঝিনুক উৎপাদনের গোটা প্রক্রিয়াটা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানী গবেষকরা দেখেছেন যে, ঝিনুক তোলা থেকে শুরু করে মাছের বাজারে ঝিনুক বিক্রি পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে ঝিনুক ভেঙে যাওয়া বা অন্য ধরনের অপচয় কমানো সম্ভব৷ জীববিজ্ঞানী গ্রেটে আডফ বলেন, ‘‘একটি মূল সমস্যা হল এই বিপুল পরিমাণ অপচয় – ঝিনুক উৎপাদনের প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে অপচয় হয়৷ লক্ষ্য হল, এই অপচয় অন্তত ৩৫ ভাগ কমানো৷ আমরা হয়তো তা করতে পারব না, কিন্তু উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে নিঃসন্দেহে উন্নতি হয়েছে৷''
প্রকল্পের মূলমন্ত্র হল পানি রিসার্কুলেট করা, অর্থাৎ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা, যাতে ঝিনুকগুলোকে দীর্ঘকাল ঐ একই পানিতে রাখা যায়৷ প্রথাগত ঝিনুক শিল্পে ট্রলার থেকে টেনে ঝিনুক তোলা হয়; কাজেই উৎপাদনের নতুন পদ্ধতিটিতে জ্বালানি ও পানি, উভয়ই বাঁচে৷ আরেক জীববিজ্ঞানী মড্স ডোরেনফেল্ড ইয়েনসেন বলেন, ‘‘আমরা মাছের চাষে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করি, এটা বস্তুত তা-ই৷ পানি রিসার্কুলেট করা হলে খুব কম নতুন পানি লাগে৷ ধরুন এই প্রণালীটিতে আমরা প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১২,০০০ লিটার পানি রিসার্কুলেট করি – কিন্তু ঘণ্টায় মাত্র ১৫ লিটার নতুন পানি যোগ করি৷''
সাগরের ছোট মাছ রক্ষায় অভিনব পদ্ধতি
ফরাসি কোম্পানি ‘ইকোশান’ মনে করছে, সাগরে মাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে৷ সমস্যার সমাধানে অভিনব এক পদ্ধতি বের করেছে তারা৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Horvat
সাগরের ‘জনসংখ্যা’ বাড়ানো
ফ্রান্সের ভূমধ্যসাগরীয় লা সিওটা বন্দরের কাছে দুজন ডাইভার সাদা জাল তুলে একটি খাঁচা উন্মুক্ত করছেন৷ ঐ খাঁচায় ছোট মাছ ছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Horvat
খাঁচা
ছবিতে যে খাঁচা দেখছেন তার নাম ‘বায়োহাট’৷ এর মাধ্যমে ছোট মাছকে সম্ভাব্য শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Horvat
সাধারণ, কিন্তু কার্যকরী
ফরাসি কোম্পানি ‘ইকোশান’ বায়োহাটের উদ্ভাবক৷ বায়োহাটের এক অংশে ঝিনুকের খোসা ভর্তি করা থাকে৷ ছোট মাছেদের প্রিয় সব খাবার জন্ম নেয় সেখানে৷ এসব খাবারের লোভে ছোট মাছগুলো ঐ খাঁচায় যায়৷ এভাবে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পায় তারা৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Horvat
নার্সারি
ছবিতে গ্রাউপার, ড্র্যাগন হেডস, সি বাস, রেড মার্শ ও গ্রেলোস প্রজাতির ছোট আকারের মাছ উন্মুক্ত করতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Horvat
অনেক দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে
সাধারণত বন্দর এলাকায় বায়োহাট ব্যবহার করা হয়৷ ফ্রান্সের কয়েকটি বন্দর ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও জর্ডানে বায়োহাট ব্যবহার হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Horvat
ভবিষ্যৎ
ইকোশানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী গিল লেকাইলো বলেন, ‘‘শুধু প্রকৃতি সুরক্ষা এখন আর পর্যাপ্ত নয়৷ এখন দরকার ইকোসিস্টেম ‘সংস্কার’ করা, আর প্রয়োজন সাগরের জনসংখ্যা বাড়াতে চেষ্টা করা৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/B. Horvat
6 ছবি1 | 6
এ ধরনের একটি ফ্লো-থ্রু সিস্টেমে ঝিনুকের কিলো প্রতি ঘণ্টায় ২০ লিটার পানি লাগে৷ কাজেই পানি ঠান্ডা করার খরচও কমে৷ এছাড়া একটি ‘প্রোটিন স্কিমার' পানির গুণাগুণ নিশ্চিত করতে সহায়তা করে৷ ইয়েনসেন বলেন, ‘‘ঝিনুকগুলো থেকে যে গুঁড়ো জৈব পদার্থ নির্গত হয়, এই পন্থায় তা অপসারণ করা সম্ভব হয়৷ এই সিলিন্ডারটার নীচে যে পাম্প আছে, তা লক্ষ লক্ষ ছোট ছোট বুদবুদ সৃষ্টি করে৷ কাজেই পানিতে ঝিনুকের চর্বি বা মাংসের যে টুকরো আছে, তা এই বুদ বুদগুলোয় আটকে ফেনা হিসেবে ওপরে ভেসে ওঠে৷ পরে সেই ফেনা ধুয়ে ফেললেই পানিটা আবার পরিষ্কার হয়ে যায়৷''
বিক্রির জন্য ঝিনুকগুলোকে তাদের মান অনুযায়ী আলাদা করার জন্য বেল্টে করে নানা জায়গায় পাঠানো হয়, ফলে ঝিনুকগুলোয় নানা ধরনের ধাক্কা লাগে৷ জীববিজ্ঞানী গিডা ক্রিস্টোফারসেন বলেন, ‘‘আমরা এই কৃত্রিম ঝিনুকটা তৈরি করে, তার মধ্যে একটি ইম্প্যাক্ট সেন্সর রেখে, সেটাকে অন্য ঝিনুকগুলোর সঙ্গে উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ফেলে দিই৷ তার ফলে কৃত্রিম ঝিনুকটা ইনস্পেকশান বেল্ট পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় কোথায় কোথায় ধাক্কা লাগছে, তা রেকর্ড করতে পারে৷''
ইমপ্যাক্ট সেন্সরের তথ্য থেকে যন্ত্রের বিভিন্ন অংশের ঘোরার গতি ও পানির মান ঠিক করে নেওয়া যায়, ফলে ঝিনুকগুলো যাতে বেশি ঝাঁকা না খায়ও শেষমেষ তাদের স্বাদ আরো ভালো হয়, তার ব্যবস্থা হয়৷
এই পরিবেশবান্ধব অ্যাকোয়াকালচারের ফলে মেরিন ইকোসিস্টেমগুলির উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে, বলে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস৷
মাছের জন্য লিফট, সিঁড়ি, ট্রেন!
কখনও ভেবে দেখেছেন নদীর যে অংশে বাঁধ দেয়া আছে সেই অংশটি মাছ পার হয় কীভাবে? ছবিঘরে থাকছে সেই উত্তর৷
লিফট
ছবিতে বাঁধের ডানপাশে যে স্থাপনাটি দেখতে পাচ্ছেন সেখানে মাছের জন্য লিফটের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এর মাধ্যমে মাছ উপর থেকে নীচে কিংবা নীচ থেকে উপরে যেতে পারে৷ জার্মানি এক কোম্পানি এই লিফট তৈরি করে ‘জার্মান ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছে৷
ছবি: Baumann Hydrotec
যেভাবে কাজ করে
বাঁধের নীচে স্থাপিত একটি চেম্বারের মধ্যে থাকা কন্টেনারের মধ্যে মাছ প্রবেশ করার পর ঢাকনা বন্ধ হয়ে যায়৷ এরপর চেম্বারের মধ্যে পানি প্রবেশ করতে থাকলে কন্টেনারটি উপরের দিকে উঠতে থাকে৷ এভাবে সম্পূর্ণ উপরে উঠে যাওয়ার পর ঢাকনাটি খুলে গেলে মাছ বের হয়ে যায়৷
ছবি: Baumann Hydrotec
লিফট কেন দরকার
কারণ অনেক মাছই আছে যেগুলো ডিম পাড়তে কিংবা খাবারের সন্ধানে অনেক পথ পাড়ি দেয়৷ যেমন স্যামন মাছ ডিম পাড়ার উপযুক্ত জায়গার সন্ধানে শত শত কিলোমিটার দূরে যায়৷ এই চলার পথে মনুষ্যসৃষ্ট কোনো বাধা পেরোতে মাছের লিফট প্রয়োজন হয়৷
ছবি: picture alliance/Arco Images GmbH
কিন্তু ব্যবস্থা না থাকলে?
ছবিতে যে বাঁধটি দেখতে পাচ্ছেন সেখানকার নীচের অংশে কোনো মাছ পৌঁছানোর পর যদি লিফট না পেয়ে সামনে যেতে না পারে তাহলে কী হতে পারে? উপর থেকে পানি যে বেগে পড়ছে তার প্রভাবে কি মাছ মরে যেতে পারে না?
ছবি: Getty Images/Jeff T. Green
মাছের জন্য ট্রেন!
১৯৪৪ সালে যখন দক্ষিণ কোরিয়ার হওয়াচন বাঁধ তৈরি হয় তখন তার কারণে মাছেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ চলার পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল৷ এর সমাধান করা হয় মাছের জন্য মনোরেল তৈরি করে৷ এর মাধ্যমে মাছকে বাঁধের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে পৌঁছে দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Yonhap News
ইউরোপের সবচেয়ে বড়
জার্মানির হামবুর্গে এলবে নদীতে মাছেদের জন্য প্রায় সাড়ে ৫০০ মিটার দীর্ঘ এই স্থাপনাটি তৈরি করা হয়েছে৷ সেখানে মোট ৪৫টি পুল রয়েছে, যেগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত৷ চলার পথে মাছেদের এই পুলগুলো ব্যবহার করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়৷ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫ হাজার মাছ এই পথ পাড়ি দেয়৷
ছবি: dapd
ঘুরানো সিঁড়ি
লিফট বা মনোরেল ছাড়াও অনেক জায়গায় মাছেদের জন্য এমন ঘুরানো সিঁড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এর সুবিধা হলো, এতে মাছেদের আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Lübke
জার্মানির কিল শহরে
উত্তর জার্মানির কিল শহরের একটি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে মাছেদের জন্য এই ঘুরানো সিঁড়ি স্থাপনা করা হয়েছে৷ এটি ২০০ মিটার দীর্ঘ৷ আর এতে ৩৬টি পুল আছে৷