ঝুমন দাসের অপরাধ কী?
১ সেপ্টেম্বর ২০২২পুলিশ দাবি করেছে, তার পোস্টের কারণে এলাকায় উত্তেজনা হয় এবং পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু বাস্তবে উত্তেজনাকর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো বলে স্থানীয়রা নিশ্চিত করেননি। ঝুমন দাসের স্ত্রী সুইট রানী দাস অভিযোগ করেন,"পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে। ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে স্থানীয় একটি চক্রের হয়ে পুলিশ কাজ করছে।”
গত ২৮ আগস্ট ঝুমন দাস ফেসবুকে একটি আপত্তিকর পোস্ট দেয় বলে পুলিশ দাবি করে। ৩০ আগস্ট পুলিশ তাকে তার সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নওগাঁওয়ের বাড়ি থেকে আটক করে নিয়ে যায়। পরদিন তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠালে আদালত তাকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠান। আদালতের পুলিশ পরিদর্শক বোরহান উদ্দিন জানান,"ঝুমন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।” তবে জবানবন্দিতে তিনি কী বলেছেন তা প্রকাশ করেননি আদালতের ইন্সপেক্টর।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাল্লা থানার সাব-ইন্সপেক্টর আবুল কাসেম জানান,"সিরাজগঞ্জে একটি মন্দিরের সামনে মসজিদের দান বাক্স স্থাপনের ঘটনার ছবি নিয়ে তিনি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এটাকে আমরা ধর্মীয় উসকানিমূলক বিবেচনা করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছি। তিনি এর আগেও একই ধরনের উসকানিমূলক কাজ করেছেন।”
তিনি দাবি করেন,"ঝুমন দাস পোস্ট দেয়ার পর এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এখনও পুলিশ লাইন থেকে আনা পুলিশ সদস্যরা ওই এলাকায় অবস্থান করছেন।”
উসকানিমূলক পোস্ট সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত কী না, এর জবাবে তিনি বলেন,"তদন্ত হচ্ছে”। ঝুমনের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন শাল্লা থানার সাব-ইন্সপেক্টর আবদুল করিম।
স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন জানান,"আমরা ওই পোস্ট নিয়ে উত্তেজনার কোনো খবর পায়নি। এলাকায় গিয়েও কোনো উত্তেজনার প্রমাণ পাইনি। স্থানীয় লোকজন এবং সাংবাদিকেরা ঝুমন দাসকে গ্রেপ্তারের পরই বিষয়টি জানতে পারেন।”
ঝুমন দাসের স্ত্রী সুইটি রানী দাস বলেন,"এর আগের মামলায় জামিন পাওয়ার পর থেকে ঝুমন বাইরে তেমন বের হত না। বড়িতেই থাকত। তার ফেসবুক আমি নিজেও চেক করতাম। সে ধর্মীয় উসকানিমূলক কোনো পোস্ট দিয়েছে বলে আমার চোখে পড়েনি। আর যে পোস্টের কথা বলা হচ্ছে সেটা সে দিয়েছে কী না আমি জানি না।”
তিনি বলেন,"৩০ আগস্ট দুপুর ১২টার পর তাকে পুলিশ নিয়ে যায় জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে। এরপর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত আমিও থানায় ছিলাম তাকে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু পুলিশ তাকে ছেড়ে না দিয়ে উল্টো আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। পরে তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠায়।”
এলাকায় কোনো উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিলো কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন,"আমরা কোনো উত্তেজনা দেখিনি। কেউ আমাদের কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। তবে এখন পুলিশ আছে।”
এর আগে গত বছরের ১৬ মার্চ ঝুমন দাসকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করেছিলো পুলিশ। তিনি তার একদিন আগে পাশের উপজেলায় এক ধর্মীয় সমাবেশে হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের একটি বক্তব্যের সমালোচনা করে পোস্ট দিলে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পুলিশই মামলা করে। ওই ঘটনায় তখন শাল্লা উপজেলার নওগাঁওয়ের হিন্দু পল্লীতে ব্যাপক হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ঝুমন দাস আটক হওয়ার ছয় মাস পর গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান। তাকে এক বছরের জন্য জামিন দেয়া হয়।
ঝুমনের স্ত্রী জানান,"জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তিনি তিনটি মাছের প্রজেক্টের কাজ শুরু করেছিলেন। জামিনের মেয়াদ ছিলো ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।” ঝুমন দাসের বিরুদ্ধে গত বছরের মামলাটি বিচারের জন্য এখন সিলেট জিজিটাল নিরাপত্তা আইন ট্রাইব্যুনালে আছে বলে জানান তার আইনজীবী।
সুইটি রানী দাস বলেন,"তার বিরুদ্ধে একটি গ্রুপ সব সময়ই লেগে আছে। গত বছর তারাই আমাদের এলাকায় হামলা চালিয়ে লুটপাট করেছিলো। আমি সেই হামলায় নিজেও আহত হয়েছি। এখনো আমরা হামলা কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে পারিনি। এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো গ্রুপ সক্রিয় বলে ধারণা করি। সে আগেও ধর্মীয় উসকানিমূলক কিছু করেনি। এবারও করেনি।”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন,"আমার মনে হচ্ছে পুলিশ এখানে বাড়াবাড়ি করেছে। তাদের অনাকাঙ্খিত তৎপরতাই রবং ধর্মীয় উসকানি ছড়াচ্ছে। যা জেনেছি তাতে ঝুমন মন্দিরের সামনে মজজিদের দান বাক্সের সমালোচনা করেছে। একটা বিষয়ের সমালোচনা করা যাবে না? সমালোচনা করলেই ধর্মীয় উসকানি হবে। এর আগে গত বছরও ঝুমন দাসকে অন্যায়ভাবে আটক করা হয়েছিলো। ঝুমন দাসকে ওই ঘটনায় এখন বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে কিন্তু যারা তখন হিন্দুপল্লীতে হামলা ও লুটপাট করেছে তাদের বিচার আমরা দেখতে পাচ্ছি না।”
উল্লাপড়ায় কী ঘটেছে?
সিরাগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সালঙ্গা এলাকার নবরত্ন মন্দিরের সামনের গেটে পাশের একটি মসজিদের দানবাক্স লাগানো হয়। তার একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ করা হয়েছে ওই ছবিটি ঝুমন দাসও তার ফেসবুকে পোস্ট করেন। উল্লাপড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উজ্জ্বল হোসেন জানান,"এটি একটি প্রাচীন মন্দির। এর তত্ত্বাবধান করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। মন্দিরটিতে এখন আর পূজা অর্চনা হয় না। স্থানীয় কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলে পাশের মসজিদের লোকজন ওই দান বাক্সটি লাগিয়েছিলো। এতে স্থানীয় হিন্দুরা আপত্তি করেননি। মন্দিরের পর একটি খোলা জায়গা আছে তারপর লোহার শিকের দেয়াল। সেখানে বাক্সটি লাগানো হয়েছে।”
তিনি বলেন,"তবে ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পর অধিদপ্তরের লোকজনই বাক্সটি সরিয়ে ফেলেছে। আমি ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
তার কথা," যারা ছবিটি ছড়িয়ে ধর্মীয় উসকানি দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আবার জেলা প্রশাসনকে না জনিয়ে একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে মন্দিরের গেটে মসজিদের দান বাক্স লাগানো ঠিক হয়নি। এব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।”