1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঝুমুরিয়াদের স্মরণে ‘ব্রাত্যজনের গান’

দেবারতি গুহ২৯ জানুয়ারি ২০১৩

পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিবড়দা গ্রাম৷ সেখানে কুমার পাড়া আর লায়েক পাড়ার মাঝখানে যে আটচালা ঘর, তারই এক কোণে হাতে ‘ক্যাঁদরা’ নিয়ে একের পর এক ঝুমুর গেয়ে চলেছেন এক নাচনি৷ যাঁর কন্ঠ থেকে ঝরছে হৃদয় উৎসারিত আবেগ৷

ছবি: Sudipto Chatterjee

অন্ধকার কখনও বাড়ছে কখনও বা কমছে, নিভু নিভু হয়ে আসছে টিমটিমে লন্ঠন৷ তখন, কোথা থেকে যেন জোছনা এসে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে গান শুনতে আসা মানুষদের মুখ৷ তারপরও তাঁদের যেন চেনা যাচ্ছে না৷ বোঝা যাচ্ছে না তাঁদের জাত-পাত, ধর্ম; বোঝা যাচ্ছে না সমাজের কোন শ্রেণির মানুষ তাঁরা৷ গ্রামসন্ধ্যার আকাশ-বাতাস শীতে, গরমে, রোদে, ছায়ায়, আকালে, খরায় পুড়তে পুড়তেও বয়ে নিয়ে চলেছে কথা ও সুর৷ নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে সচ্চিদানন্দ বিদ্যাপিঠের অদূরে আটচালা ঘরের শ্রোতাদের৷

জাত-পাত ছোঁয়া-ছুঁয়ির গ্রামসমাজে উচ্চবর্ণের কাছে আজও অস্পৃশ্য নাচনিরা...ছবি: Harun Ur Rashid Swapan

এই খণ্ডচিত্রটি পঞ্চাশ বছর আগের নয়, এই সেদিনের৷ সেদিন ঝুমুরগানের ঐ আসরে মতিলাল লায়েক অথবা বঙ্কিমচন্দ্র লায়েক থুড়ি বাঁকু লয়েকের মতো জাতশিল্পী না থাকলেও, ছিলেন সরস্বতী, বিমলা দেবীর মতো নাচনিরা, জাত-পাত ছোঁয়া-ছুঁয়ির গ্রামসমাজে উচ্চবর্ণের কাছে যাঁরা আজও অস্পৃশ্য, ‘ব্রাত্যজন'৷

পশ্চিম রাঢ় বাংলায় বৈঠকী ঝুমুরগান লোকায়ত সংস্কৃতির অন্যান্য ধারার মতোই উজ্জ্বল ছিল, ছিল ভাদু বা তুষু গানের মতোই লোকপ্রিয়৷ এ অঞ্চলেই ভোলা খ্যাপা, শ্রীপতি দিগার বা জ্যোতি সামন্তের মতো ঝুমুরিয়া ও পদকর্তাদের জন্ম, যাঁদের স্বর ও সুর কবেই মিলিয়ে গেছে৷ এরপরও নানা রকমের অসম্মান, বঞ্চনা, তাচ্ছিল্য ও ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে, অনবরত ঘাম ঝরিয়ে, শিল্পীর মমতা ও সুষমায় যাঁরা ক্রমবিলীয়মান লোকায়ত সংস্কৃতির এই ধারাটিকে এখনও বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরাই হলেন এই ‘নাচনি'৷ তাই তাঁদের নিয়ে গ্রামজীবনের সাংস্কৃতিক শেকড়কে আরো একবার ছুঁয়ে দেখার তীব্র ইচ্ছে থেকেই সেদিন বিবড়দায় অনুষ্ঠিত হলো ‘তর্পণ'৷

সাক্ষাৎকার: ঝুমুর গান

This browser does not support the audio element.

অনুষ্ঠানটির আহবায়ক আমারই ছেলেবেলার মাস্টারমশাই দুর্গা দত্ত৷ তাঁকে জিজ্ঞেস করি, একজন শহুরে শিক্ষক হয়েও ঝুমুরগানের প্রতি এতটা আগ্রহী হলেন কেন? কিভাবে? কী এর উদ্দেশ্য? তিনি বললেন, ‘‘লোকায়ত সংস্কৃতি, এটা নিয়ে আমার কৌতূহল, উৎসাহ, আগ্রহ সেই ছোটবেলা থেকে৷ ১৯৭৬/৭৭ সাল থেকেই আমি এটা নিয়ে খোঁজখবর করা, পড়াশোনা করা শুরু করি৷ তখনই আমি নাচনিদের প্রথম দেখি, তাঁদের গান শুনি, যেটা আমাদের গ্রামীণ কাঠামোতে ঠিক ‘ভদ্র সংস্কৃতি' নয়৷ এঁদের নাচ দেখে সাধারণত নিম্নবর্গীয় মানুষ, প্রান্তিক মানুষ৷ সে জায়গা থেকে আমার মনে হয়েছে যে, যাঁরা ওঁদের গান সম্পর্কে জানে না, তাঁদের যদি এ গান শোনানো যায়, তাহলে ওঁরা বুকিং পাবে, হয়ত কিছুটা সামাজিক সম্মানও পাবে৷ তা ছাড়া যে গানের ওঁরা ধারক, সেই গানও তো ক্রমশ কমে আসছে নগরায়নের ফলে৷ তাই আমার মনে হয়, এহেন একটা অনুষ্ঠান করে তা সংরক্ষণ করলে এঁদের গানের যে ভাষা, তার আবেগ, মূল্যবোধ – সেটা কিছুটা ধরা যাবে৷''

একটা সময় মানভূম-বরাভূম-শিখরভূম-ধলভূম-সিংভূম অঞ্চলে আঞ্চলিক রাজদরবারে বা সামন্তদের বৈঠকখানায় নাচনিদের কদর ছিল, ছিল সম্মানও৷ সিন্ধুবালা দেবীর মতো ঝুমুরশিল্পীরা এই সেদিনও আসর মাতিয়েছেন, সরকারি সম্মানে (লালন পুরস্কার) ভূষিত হয়েছেন৷ কিন্তু সামাজিক-অর্থনেতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ফলে, জীবন ও জীবিকার তাগিদে ‘নাচনি'দেরও নামতে হয়েছে হাটে-মাঠে-বাটে; লোক-সাধারণের মনোরঞ্জনের জন্যে লোকরুচি অনুযায়ী বদলাতে হয়েছে নিজেদের৷ এই কথাগুলোই বলছিলেন নাচনি সরস্বতী দেবী, ‘‘সমাজ এখনও আমাদের নেয়নি৷ গ্রামের মানুষগুলো এখনও আমাদের আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে, ঐ যে ও নাচনি বটে! আর সরকার বলছে যে আমাদের সব আধিপত্য দিয়ে দিয়েছে৷ কিন্তু আদতে আমাদের কিছুই দেয়নি৷ পেনশন, বিধবা ভাতা কিছুই পাইনি৷ আমরা নামের শিল্পী, কামের শিল্পী না৷ আমরা লোকের ঘরে কাজ করেও খাই জানেন? পেটটাই তো হলো কাল৷ কী করবো বলুন?''

পশ্চিম রাঢ় বাংলায় এক সময় বৈঠকী ঝুমুরগান লোকায়ত সংস্কৃতির অন্যান্য ধারার মতোই উজ্জ্বল ছিল...ছবি: Sudipto Chatterjee

যে শ্রোতা-দর্শকদের এই নাচনিরা মুগ্ধ করেন, মাতিয়ে দেন নাচে-গানে-সুরে, তাঁদের কাছেও দিনের আলোয় শুধু তাচ্ছিল্যই পান, কপালে জোটে শুধু অবজ্ঞা আর অসম্মান, তা সেই নাচনির বয়স যা-ই হোক না কেন৷ নাচনি বিমলা দেবীর কথায়, ‘‘পেটের জ্বালায় বেরিয়ে পড়েছি৷ খুব গরীব ঘরের মেয়ে আমি৷ আর এখন বয়স ৬০ বছর হলো, নাচ-গান আর করতে পারি না৷ কখনও কোনো ‘প্রোগ্রাম' থাকলে যাই, কী আর করবো? আজ ২৮ বছর হলো আমার মালিক, আমার রসিক মারা গেছেন৷ তারপর থেকেই এই অবস্থা৷''

রসিক-নির্ভর হয়ে, রসিকের উপপত্নী হিসেবে, তাঁদেরই আশ্রয়ে নানা বিরূপতার মধ্যে কোনোরকমে বাঁচতে হয় এই নাচনিদের৷ রসিক মারা গেলে নেমে আসে আরো বড় বিপর্যয়৷ গ্রামসমাজে ন্যূনতম সম্মানও তখন পান না৷ ২০০৬ সাল পর্যন্ত তাঁদের মরদেহ দাহও করা হতো না, ছোঁয়াছয়ির ভয়ে৷ অথচ কী মমতায় ও নিষ্ঠায় এই নাচনিরা দরবারি ঝুমুরের সুরকে লালন করেন, নিজেদের জীবনাভিজ্ঞতার বিষ আর অমৃত নিংড়ে নিয়ে পরিবেশন করেন ‘রং ঝুমুর'৷ তবুও সমাজে তাঁরা ব্রাত্য! এরপরও সংগঠিত হবার চেষ্টা করছেন তাঁরা৷ সেই চেষ্টা দুর্গা দত্তেরও৷

Women Long - MP3-Mono

This browser does not support the audio element.

গত দু'দশকের অতি আধুনিক বাংলা গানে নানা সুরের চলাচলের মাঝে আবারো ফিরে ফিরে আসছে মাটির সুরের টান৷ ব্যান্ড-এর গানেও মধ্যে উঠে আসছে বাউলাঙ্গ বা কীর্তনাঙ্গের গড়ন; কখনও বা ঝুমুর, ভাটিয়ালি বা ভাওয়াইয়ার সুরের আদল৷ অনেক নামি ব্যান্ড তো মাটির সুরকে নিয়েই মাতিয়ে দিয়েছে নাগরিক শ্রোতাদের৷ তাই বিবড়দার ‘তর্পণ', এই ব্রাত্যজনের গান আমাদের সেই অতি চেনা সুরেরই উদযাপন, যা এসেছে নিছকই সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা থেকে৷ এ দায় আমাদের মাটির প্রতি , নিজেদের শেকড়ের প্রতি৷

সরকারিভাবে নাচনিরা ঘোষিত শিল্পী, কিন্তু শিল্পীর সম্মান তাঁদের জন্য আজও অধরা৷ অথচ ছোটবেলায় মাস্টারমশাই বলেছিলেন, যাঁরা সুখে, দুঃখে, শীতে, গ্রীষ্মে, বসন্তে, বর্ষায়, দারিদ্রে, অনটনে – নানা বিপর্যয়ের মধ্যে জিইয়ে রাখেন তাঁদের সৃজনের সুর ; গলায় রক্ত ঝরিয়ে ‘ফিনিক্স' পাখির মতো যাঁরা আগুনের ভেতর থেকে পুড়তে পুড়তে জন্ম নেন বারবার, হাওয়ায় ভাসিয়ে দেন জীবনরসের নানা রং, তাঁরাই শিল্পী৷ তাহলে?

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ