1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

টক-ঝাল-মিষ্টি শো

২৩ অক্টোবর ২০১৮

বাংলাদেশে টক শো মানেই যেন উত্তেজনা, হাতাহাতি৷ যেভাবে পারা যায় অন্যকে অপদস্থ করা, সেটা যুক্তির চেয়ে ধমক আর উঁচু গলার কেরদানি দেখিয়ে৷ কিন্তু সেটা তো লাইভ৷ ক্যামেরার পেছনেও কি তাই?

ছবি: Banglavision

বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে রিপোর্টার থেকে বার্তা সম্পাদনা এবং সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি কিছুদিন একটি টক শো উপস্থাপনার সুযোগও হয়েছিল৷

তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে যেহেতু আরো অনেকে জড়িত, তাই কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে এবং বিপদে না ফেলে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে পুরো লেখাতেই অতিথিদের নামের পরিবর্তে উপাধিই ব্যবহার করছি বেশি৷

ব্যালেন্স, ব্যালেন্স, আর ব্যালেন্স৷ সংবাদই হোক, আর টক শো, গণমাধ্যমের প্রধান শর্ত হচ্ছে এটিই৷ একটি বিষয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্য পরিবেশন করতে চাইলে সব পক্ষকেই দিতে হবে মত প্রকাশের সমান সুযোগ৷ 

ফলে বিষয় রামপালই হোক বা নির্বাচন বা যানজট, একপক্ষ অভিযোগ করবেন, তা কেউ যদি খণ্ডনই না করলেন, তাহলে আর মজা কোথায়৷ কোনো মতের বিপক্ষে কাউকে না পাওয়া গেলে উপস্থাপকের দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়, তাঁকেই তখন নিতে হয় প্রশ্নবাণে জর্জরিত করার মূল ভূমিকা৷

কিন্তু রাজনীতি ছাড়া যেন বাংলাদেশের টক শো জমে না৷ ভাবখানা এমন, যদি সেটে একটু উত্তেজনাই না ছড়ালো তাহলে সেই টক শো-এর সাফল্য কোথায়?

ফলে বেশিরভাগ চ্যানেলেই সপ্তাহের ৭টি টক শো'র ৫টিই হয়ে যায় রাজনীতি নিয়ে৷ জোরালো আবেদন সৃষ্টি না করতে পারলে হয়তো সেটা ৭ দিনে ৭টিতেই দাঁড়ায়৷

কিন্তু সেখানেও আছে সমস্যা৷ বিরোধী দল ও সরকারে পরস্পরবিরোধী দ্বৈত অবস্থানের ফলে জাতীয় পার্টি যেমন দেশের রাজনীতিতে গত পাঁচ বছর কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি, টক শোগুলোতেও হাজির করতে পারেনি কোনো আকর্ষণীয় বক্তা৷

এদিকে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকলে যা হয়, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চাপের মুখে, বয়সের কারণে, অথবা অন্য নানাবিধ কারণে চ্যানেলগুলোতে আর নিয়মিত হাজিরা দেন না৷ ফলে একই অতিথিকে, এমনকি এক ঘণ্টার ব্যবধানেই দেখা যায় ভিন্ন চ্যানেলের আয়োজনে অংশ নিতে৷

অন্যদিকে, টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগের তো নেতার অভাব নেই, ফলে অভাব নেই অতিথিরও৷

কিন্তু টক শো-কে টক বানাতে বিপক্ষ তো লাগবেই৷ ফলে রাজনীতিবিদদের বিকল্প হিসেবে খোঁজ পড়ে বুদ্ধিজীবীদের৷ এই তালিকায় মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, ডাক্তার, অর্থনীতিবিদ সবাই-ই আছেন৷ এঁদের সবার আগেই অবশ্য অদৃশ্য ব্র্যাকেটে যুক্ত এই পন্থি বা ওই পন্থি৷

কেউ কেউ প্রশ্নের আসল উত্তর দেয়ার আগে ‘ইতিহাস' বলতে গিয়ে কথা শুরু করেন সেই ১৯৫২ সাল থেকে৷ ২০১৮ সাল পর্যন্ত আসার আগে তাঁর জন্য বরাদ্দ সময় তো বটেই, শেষ হয়ে যায় অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ও৷ বিশেষ করে বামপন্থি বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের ব্যাপারে এই হাস্যরসাত্মক কথাটি বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত৷

কেউ কেউ আবার অতি নিরপেক্ষ৷ এমন এক আকালের দিনে আমি স্বাগত জানালাম এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে৷ বিষয়– বিএনপির আন্দোলন৷

সেটে ওঠার আগে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘সহ-অতিথি কে?'' নাম শুনে বললেন, ‘‘উনি তো আওয়ামীপন্থি৷'' আমি মাথা নাড়লাম৷ তিনি বললেন, ‘‘চলেন, একটু বিএনপির পক্ষ নিয়ে কথা বলতে হবে আর কি, নাহলে তো জমবে না৷''

বেশ জমলো আলোচনা৷ দুজনই সুবক্তা, যুক্তি দিয়ে একে অপরকে ঘায়েল করে এক ঘণ্টা ভালোই কাটলো৷ অতিথিদের বিদায় দিয়ে মেকআপ তুলে এমনিই অন্য চ্যানেল দেখছি৷ হঠাৎ করেই দেখি, আরেক চ্যানেলে একই বিষয়ে টক শো-তে হাজির সেই সম্মানিত সাংবাদিক৷

আগ্রহ নিয়ে টিভি সেটের সাউন্ড বাড়ালাম৷ কী আশ্চর্য! আমার শো-তে যা যা বলে গেছেন, ঠিক তার উলটো কথাটা বলছেন সেই টক শো-তে৷ খেয়াল করে দেখলাম, এবার অন্য অতিথি বিএনপিপন্থি৷ ব্যক্তির অবস্থান যা-ই হোক, টক শো তো জমাতে হবে৷ এবার তাই তিনি আওয়ামীপন্থি৷

একদিকে যেমন দর্শকরাও মজা পান ঝগড়া দেখতে, বেশি ঝগড়া লাগাতে পারলে উপস্থাপকও আনন্দিত হন টিআরপি বাড়ছে ভেবে, বিজ্ঞাপনি সংস্থাও টিআরপি দেখেই সেই টক শো-তে বিজ্ঞাপনের মূল্য বাড়ায়৷ এই দুষ্ট চক্রে হয়তো বাংলাদেশের মতো দেশে টক শো-র আসল প্রয়োজনীয়তাই হারিয়ে যাচ্ছে৷

অতিথিরাও কম যান না৷ এমন অনেক টক শো দেখেছি, যেখানে অপ্রয়োজনেই ব্যাপক উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন কিছু অতিথি৷ এক পর্যায়ে মনে হয়, সামনে টেবিল না তাকলে হয়তো অন্যজনকে মেরেই বসতেন তিনি৷ কিন্তু যেই না সঞ্চালক গেলেন বিরতিতে, অমনি আবার চা খেতে খেতে গল্প শুরু৷ তাঁরাও বুঝে গেছেন, টিভি চ্যানেলগুলোতে বেশি বেশি ডাক পেতে তাঁদেরও এভাবে হাঁকডাক করেই বাড়াতে হবে নিজের টিআরপি৷ 

অনুপম দেব কানুনজ্ঞ, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Böll

কিন্তু এইসবের আড়ালে ক্ষতিটা হচ্ছে কার? একসময় সংসদ ছিল কার্যকর, বড় বড় পার্লামেন্টারিয়ানদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় মুখর হতো অধিবেশন৷ সরকারবিরোধী দলের তথ্য ও যুক্তির লড়াইয়ে পূরণ হতো জনগণের আশা-আকাঙ্খা৷ এখন সংসদের বিরোধী দলকে অনেকে বিরোধী দল বলে স্বীকারই করতে চান না, এমনকি বিরোধী দলকেও মাঝেমাঝে জোর দিয়ে দাবি করতে হয়, ‘‘বিশ্বাস করেন, আসলেই আমরা বিরোধী দল'' বলে৷

ফলে টক শো সে অবস্থান সহজেই পূরণ করতে পারতো৷ নানাদিক থেকে বিপুল চাপ সামলেও কিছু টক শো চেষ্টা চালাচ্ছে বটে৷ কিন্তু পপুলিজম যেমন গ্রাস করে নিচ্ছে বিশ্বের রাজনীতি, তেমনি বাংলাদেশের টক শো-তেও পড়েছে এর প্রভাব৷

পাশাপাশি কেউ কেউ নিরপেক্ষতার বুলি আওড়ে প্রকাশ্যে বা কৌশলে যাচ্ছেন একদিকে হেলে৷ ফলে যুক্তি, তর্ক, প্রাসঙ্গিক আলোচনা ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তা হয়ে উঠছে অধিকাংশ টক শো-র মূল আগ্রহের বিষয়৷

রাষ্ট্রের ফোর্থ এস্টেট বা চতুর্থ স্তম্ভ যদি সাংবাদিকতাকে বলা হয়, যথাযথ টক শো-কে তবে নিশ্চয়ই নির্দ্বিধায় দ্বিতীয় সংসদ বলাই যেতে পারে৷ কিন্তু সস্তা ও দ্রুত জনপ্রিয়তার লোভ সামলে সে মর্যাদা কি পাবে টক শো? রাষ্ট্রই কি নিজের পায়ে কুড়াল মেরে সে সুযোগ করে দিতে চাইবে? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তা সুদূর পরাহত৷

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ