1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

টাকার বিনিময়ে কিডনি: বৈশ্বিক অঙ্গ পাচার চক্রের ভেতরের গল্প

১৬ এপ্রিল ২০২৫

একটি আন্তর্জাতিক অঙ্গ পাচার চক্র কেনিয়ার অনেক দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের কিডনি বের করে তা জার্মানি ও অন্যান্য দেশে বিক্রি করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে৷

আমন কিপরুতো মেলির ছবি
আমন বলেন, ‘‘যদি পেছনে ফেরত যেতে পারতাম, আমি কখনোই কিডনি দিতে রাজি হতাম না৷ নিজেকে ঘৃণা করি৷''ছবি: Mariel Mueller/DW

কিডনি বিক্রি করলেই হয়তো জীবনটা বদলে যাবে - এমনটাই ভেবেছিলেন ২২ বছর বয়সি আমন কিপরুতো মেলি৷ কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে কেনিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের একটি গ্রামে তার জন্য কাজ ও অর্থ আয় কঠিন হয়ে পড়েছিল৷ তাই বন্ধুর কাছ থেকে যখন শুনেন ছয় হাজার ডলার উপার্জনের সহজ সুযোগের কথা, রাজি হয়ে যান৷ কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তাকে এক অন্ধকার জগতে নিয়ে যায়৷

কিডনি চক্রের এই প্রতিবেদনটি জার্মানির সংবাদমাধ্যম ডেয়ার স্পিগেল, জেডডিএফ ও ডয়চে ভেলের কয়েক মাসব্যাপী যৌথ অনুসন্ধানের ফল৷ প্রতিবেদকরা কিডনি বিক্রেতা ও ক্রেতাকে অনুসরণ করেন, দলিলপত্র বিশ্লেষণ করেন, হুইসেলব্লোয়ার ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং এভাবে একটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক চক্রের মুখ উন্মোচন করেন৷

দারিদ্র্য ও দুর্বলতার ফায়দা নেয়া চক্র

এক মধ্যস্বত্ত্বভোগীর মাধ্যমে আমনকে কেনিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের এলডোরেট শহরের মেডিহিল হাসপাতালে নেয়া হয়৷ সেখানে ভারতীয় চিকিৎসক তাকে ইংরেজি লেখা কিছু কাগজপত্র দেন, যেগুলোর অর্থ তিনি বুঝতে পারেননি৷ তার কাছে কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি ব্যাখ্যা করা হয়নি৷

‘‘তারা কিছুই ব্যাখ্যা করেনি,'' বলেন আমন৷ শুধু আশপাশের কিছু লোক দেখিয়ে বলেছিল ‘দেখো, ওরাও দিয়েছে, এখন আবার কাজ করছে'৷

অপারেশনের পর আমন ছয় হাজার ডলারের বদলে পান চার হাজার ডলার৷ সেই অর্থে তিনি একটি মোবাইল ও একটি গাড়ি কেনেন৷ তবে তা-ও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়৷ তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে, মাথা ঘোরা ও দুর্বলতা দেখা দেয়৷ একসময় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন৷ তার মা লিয়া মেট্টো তখন জানতে পারেন, তার ছেলে কিডনি বিক্রি করেছে৷

‘‘ওদের আয় হচ্ছে আমনের মতো তরুণদের শোষণের মাধ্যমে,'' বলেন তিনি৷

উইলিস ওকুমু রাজধানী নাইরোবিতে সংগঠিত অপরাধ নিয়ে গবেষণা করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ এলডোরেট থেকে প্রায় ১৮০ কিমি দূরের ওয়ুগিস শহরের বহু তরুণ একইভাবে কিডনি বিক্রি করেছে৷'' তার মতে, এই শহরেই শতাধিক তরুণ কিডনি দিয়েছেন৷ অনেকেই এখন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন৷

‘‘আমি মনে করি না তারা ৬০ বছর পর্যন্ত বাঁচবে,'' বলেন তিনি৷

কিডনি ডোনার থেকে দালাল: এক শোষণের শৃঙ্খল

ডয়চে ভেলে চারজন তরুণের সঙ্গে কথা বলেছে৷ তারা মাত্র দুই হাজার ডলারে কিডনি বিক্রি করেছেন৷ অপারেশনের পর, ব্রোকাররা তাদেরকে চারশ' ডলার কমিশনের বিনিময়ে নতুন দাতা খুঁজে আনতে বলে৷

ওকুমু জানান, কেনিয়ার আইন অনুযায়ী আত্মীয় বা নিঃস্বার্থ উদ্দেশ্যে কিডনি দান বৈধ৷ কিন্তু বিক্রির জন্য কোনো সরাসরি নিষেধাজ্ঞা নেই৷ এই আইনের ফাঁকফোকর কাজে লাগানো হচ্ছে৷

মেডিহিল হাসপাতালের এক সাবেক কর্মী জানান, প্রাথমিকভাবে সোমালিয়ানদের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হতো৷ কিডনি দিতেন কেনিয়ান ডোনার বা দাতারা৷ ২০২২ সাল থেকে ইসরায়েলি এবং ২০২৪ থেকে জার্মান রোগীরাও আসা শুরু করেন৷ কিডনি ডোনাররা এরপর আসা শুরু করেন আজারবাইজান, কাজাখস্তান ও পাকিস্তান থেকে৷ অনেকেই ইংরেজি না জানায়, কী স্বাক্ষর করছেন, তা না বুঝেই স্বাক্ষর করতেন৷

আরো লাভজনক বাজারে বিস্তার: লক্ষ্য ইসরায়েল ও জার্মানি

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জার্মানি ও ইসরায়েলের বাজারে কিডনি ব্যবসা বিস্তৃতি লাভের পর ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে৷ কেউ কেউ কিডনির জন্য দুই লাখ ডলার পর্যন্ত পরিশোধ করছেন৷ ‘মেডলিড' নামের একটি এজেন্সি এই দালালির কাজটি করছে৷

মেডলিড-এর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, আইন মেনেই ৩০ দিনের মধ্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হবে এবং সব দান ‘১০০% নিঃস্বার্থ'৷

৫৭ বছর বয়সী জার্মান নারী সাবিনে ফিশার-কুগলার প্রায় ৪০ বছর ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন৷ তিনি প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপনের পর তা কাজ করা বন্ধ করে দেয়৷ তাই তিনি আরেকটি কিডনির জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছিলেন৷ তিনি জানান, তিনি মেডলিডকে একে থেকে দুই লাখ ডলার পরিশোধ করেছেন৷ কিডনিদাতা ছিলেন ২৪ বছর বয়সী এক আজারবাইজানীয়৷

‘‘আমাকে স্বার্থপরের মতো শোনাতে পারে যে, আমি এই কিডনিটা চাইছিলাম৷ তবে চুক্তিটা ঠিকঠাক মনে হয়েছে৷ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা এতটা স্বচ্ছ নয়,'' বলেন তিনি৷

‘বলছেন দান, অথচ টাকা দিচ্ছেন'

মেডলিডের প্রতিষ্ঠাতা ইসরায়েলি নাগরিক রবার্ট শ্পোলানস্কি৷ তার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে ইসরায়েলে শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, ফিলিপিন্স ও থাইল্যান্ডে অবৈধ কিডনি প্রতিস্থাপনের অভিযোগ আনা হয়েছিল৷ তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং বলেন, মেডলিড সম্পূর্ণ আইন মেনে কাজ করে৷

প্রতিনিধিরা এলডোরেটের এক হোটেলে গিয়ে বিদেশি রোগীদের সঙ্গে কথা বলেন৷ এক রুশ নারী বলেন, ‘‘কেউই বিনামূল্যে কিডনি দেয় না৷'' ৭২ বছর বয়সি এক ইসরায়েলি বলেন, ‘‘আপনি বলছেন এটা আমার আত্মীয়, কিন্তু ও তো কাকতালীয়ভাবে এখানে এসেছে৷''

সুরক্ষিত ব্যবসা

কেনিয়া রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ডা. জোনাথন ওয়ালা জানান, তিনি এমন রোগীদের চিকিৎসা করেছেন যাদের কিডনি প্রতিস্থাপনের পর মারাত্মক সংক্রমণ বা কিডনি অকার্যকর হয়ে গেছে৷ চিকিৎসকদের সতর্কতা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়নি৷

২০২৩ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি তদন্তে জানতে পারে, অনেক দাতা-গ্রহীতা আত্মীয় নয় এবং অনেক ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে৷ অধিকাংশ লেনদেন নগদে হয়েছে৷ প্রতিবেদনে ‘অঙ্গ পাচার তদন্তের' সুপারিশ করা হয়, কিন্তু তা কখনো প্রকাশ পায়নি৷

সূত্র জানায়, আরও দুই হাসপাতাল এ ব্যবসায় জড়িত৷ এতে অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তি জড়িত, এমনকি দেশটির সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত৷

মেডিহিলের প্রতিষ্ঠাতা স্বরূপ মিশ্র, একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং সাবেক এমপি৷ ২০২৪ সালে কেনিয়া বায়োভ্যাক্স ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন তিনি৷ তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিদেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কেনিয়ার প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন৷ বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি৷

পশ্চিম কেনিয়ায়, আমন এবং তার মতো অনেকেই এখন এক কিডনির ভারে টিকে থাকার লড়াই করছেন৷

আমন বলেন, ‘‘যদি পেছনে ফেরত যেতে পারতাম, আমি কখনোই কিডনি দিতে রাজি হতাম না৷ নিজেকে ঘৃণা করি৷''

মারিয়েল ম্যুলার/জেডএ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ