পশ্চিমবঙ্গের এক বিশিষ্ট আইনজীবী আড্ডায় ক্রিমিনাল প্র্যাকটিসের গপ্পো শোনাচ্ছিলেন৷ এক ধনী ব্যবসায়ী আর্থিক কেলেঙ্কারি করে তার কাছে এসেছিলেন আইনি সাহায্য নিতে৷ অনেক চেষ্টা করেও আইনজীবী ওই ব্যবসায়ীর জেলযাত্রা আটকাতে পারেননি৷ পরে ওই ব্যবসায়ীর কাছেই শুনেছিলেন প্রথম দিনের জেলের অভিজ্ঞতা৷
ভারতের জেলে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের কারাগারের ভিতর বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়৷ নতুন বন্দি এলে ওই সাজাপ্রাপ্ত আসামিদেরই দায়িত্ব পড়ে নতুন ব্যক্তিকে জেলের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার, সব কিছু চিনিয়ে দেওয়ার৷ তেমনই এক সাজাপ্রাপ্ত আসামির সঙ্গে জেলে ঢোকার পরেই নতুন অতিথিকে জানিয়ে দেওয়া হয়, নগদ ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে৷ যদি না দেওয়া হয়-- বুম... কথায় নয়, হাতেকলম উদাহরণ দেওয়া হয়েছিল নাকের ডগায় সপাটে ঘুঁসি মেরে৷ নাক থেকে যখন গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে, নতুন অতিথিকে বলা হয়, টাকা দিয়ে দিলে রাজার হালে থাকা যাবে৷ ভালো খাবার, ধোলাইহীন রাত, সিগারেটের ব্যবস্থা, এমনকি, মাসে একরাত বাড়িতে কাটানো৷ রাতে জেল থেকে গাড়ি নিয়ে যাবে, সকালে গুনতি শুরু হওয়ার আগে ফের সেই গাড়ি জেলে পৌঁছে দেবে৷ কেউ কিছু বলবে না৷ বলাই বাহুল্য, ওই ব্যবসায়ী টাকা দিয়েছিলেন৷ সাজাপ্রাপ্ত বন্দি ঠিকানা দিয়েছিলেন৷ ব্যবসায়ীর ছেলেরা সেখানে গিয়ে টাকার ব্যাগ রেখে এসেছিলেন৷
কারাগারের দশ চিত্র
কারাগার মানেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর আর তার ভিতরে বন্দিজীবন। সে জীবনের গল্প খুব কমই প্রকাশ পায় বাইরে। তবুও কারাগারের ভিতরের অমানবিকতা, অনিয়মসহ বিভিন্ন ঘটনা নানা সময়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশে।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Abed
জেল হত্যা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারীরা জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচ কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করে রাখে৷ ৩ রা নভেম্বর সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয় তাদের। বাংলাদেশে কারাগারের ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ও বিশ্বে বিরল এ ঘটনা।
ছবি: bdnews24.com/Dipu Malakar
হত্যা, না আত্মহত্যা?
২০১৯ সালে পঞ্চগড় জেলা কারাগারে পলাশ কুমার নামের এক আইনজীবীকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। হাসপাতালে মৃত্যুর আগে তিনি বলেছেন, ‘‘কারাগারের ভিতরে দু‘জন লোক তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়৷’’ যদিও পঞ্চগড়ের জেলার সেসময় দাবি করেন, বাথরুমে লাইটার দিয়ে পলাশ নিজেই শরীরে আগুন দিয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে কক্সবাজার জেলা কারাগারে এক হাজতির গলায় ফাঁস লাগানো লাশ পাওয়া যায়। সেটিও হত্যা, না আত্মহত্যা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
ছবি: picture-alliance/ZB/P. Endig
খালাসের পর ১৩ বছরের জেল
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে জজ মিয়াকে সাজানো মামলায় কারাবন্দি করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার৷ এর আগে ২০০১ সালে মেয়েকে বিষ দিয়ে হত্যার অভিযোগে জাবেদ আলী নামের এক ব্যক্তির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়৷ দুই বছর পর উচ্চ আদালত থেকে তিনি বেকসুর খালাস পেলেও রায়ের কপি জেলখানায় না পৌঁছানোয় ১৩ বছর অকারণে জেল খাটেন তিনি।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Abed
কারাগারে বিয়ে
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ধর্ষণ মামলার আসামিদের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীদের বিয়ের খবর প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে। ২০২০ সালের নভেম্বরে কুমিল্লার আদালতে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়েছে৷ ১৯ নভেম্বর ফেনী কারাগারেও একই ধরনের বিয়ে হয়৷ একইদিনে নাটোরেও এমন একটি ঘটনা ঘটে৷ ২২ অক্টোবর উচ্চ আদালতের নির্দেশে রাজশাহীতে যাবজ্জীবন আসামি ও ভুক্তভোগীর কারাফটকে বিয়ে হয়৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ
বাংলাদেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার আছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, কারাগারগুলোর বন্দি ধারণ ক্ষমতা ৪০ হাজার ৯৪৪ আর বন্দির সংখ্যা ৮৮ হাজার ৮৪ জন। পরিস্থিতি এমন যে অতিরিক্ত গরমে হাজতিরা অসুস্থ হওয়া, এমনকি হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তবে নতুন কারাগার নির্মাণ এবং পুরাতন কারাগার সম্প্রসারণ করে ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
ছবি: Reuters
টাকা থাকলে আয়েশে
তবে কারাগারে সবার সময় যে খারাপ কাটে তা নয়। টাকা থাকায় বেশ আয়েশেই দিন কাটে অনেকের। কয়েক দিন আগে প্রচারে এসেছে এমন এক ঘটনা৷ গাজীপুরে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আছেন অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত হল-মার্কের জিএম তুষার আহমদ। কারা কর্মকর্তাদের কক্ষে তিনি এক নারীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। জেলার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এর বিনিময়ে তিনি ঘুস দিয়েছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হাসপাতালে জেল খাটা
কোনো অপরাধে বা অভিযোগে বন্দি হলে জেলখানার ১৪ শিক এড়ানোর একটি উপায় অসুস্থ হয়ে যাওয়া। অস্বাভাবিক আচরণ করে ফাঁসি স্থগিত ও পরে রাজনৈতিক প্রভাবে ছাড়া পেয়েছেন এমন ঘটনাও আছে। গত বছরের ২৫ জানুয়ারি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘সম্রাটসহ ৭ বন্দি হাসপাতালে শুয়েবসে জেল খাটছেন’। তাদের মধ্যে আছেন স্বর্ণ চোরাচালান মামলার আসামি, ব্যবসায়ী, সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতা। ।
ছবি: DW
কারাগারে বিচারালয়
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালে কারাগারে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। গত বছর নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি বেশিরভাগ সময়ই বন্দি ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচারও চলে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এই বিচারকাজের জন্য পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনকে আদালত হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।
ছবি: Getty Images/AFP/S. Jahan
জেলখানা যখন জাদুঘর
পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারটি বাংলাদেশের দুই শতকের ইতিহাসের সাক্ষী। ১৮৬০-এর দশকে অনেক সিপাহীকে সেখানে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। পাকিস্তান শাসনামলে বঙ্গবন্ধুসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতারা বারবার বন্দিত্ব বরণ করেছিলেন এই কারাগারে। এখানেই ঘটে জেল হত্যার ঘটনা। ২০১৬ সালে কারাগারটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করে সরকার। সেখানে টিকিট কেটে ইতিহাসে বিচরণ করতে পারেন দর্শনার্থীরা।
ছবি: bdnews24.com/Dipu Malakar
কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র?
দুটি কিশোর ও একটি কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র আছে গাজীপুর ও যশোরে। উদ্দেশ্য যেসব শিশু-কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তাদের সংশোধন, শিক্ষা, বৃত্তিমূলক দক্ষতা ও মানসিকতার উন্নয়ন ঘটানো। বিভিন্ন সময়ের সংবাদে দেখা যায়, সেগুলো শিশুদের জন্য নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে যশোরে কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তিন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। ১৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয় এই ঘটনায়। (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Mustafiz Mamun
10 ছবি1 | 10
ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই মোটের উপর এটাই জেলের সার্বিক ছবি৷ খরচ করলে অঢেল সুযোগ, না করলে লবডঙ্কা৷ গরিব মানুষের হাজতবাস নরকেরও অধম৷ কেমন?
দীর্ঘদিন ভারতের জেল ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছেন স্মিতা চক্রবর্তী৷ ওপেন প্রিজন নিয়ে তার বক্তব্য, আদালতে বিচারপতি উদ্ধৃত করেছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ‘‘ভারতের জেলে সাধারণত একজন বন্দির ৩৬ বর্গফুট জায়গা পাওয়ার কথা৷ নয় বাই চার ফুট বরাদ্দ৷ অর্থাৎ, একটি সাধারণ সিঙ্গল চৌকির চেয়ে দৈর্ঘ্যে সামান্য বেশি৷ কিন্তু বাস্তবে গরিব বন্দিরা সেটুকু জায়গাও পান না৷’’ কতটুকু পান? স্মিতার মতে, একেক জেলে একেক রকম পরিস্থিতি৷ তবে গড়ে বলতে গেলে, ওইটুকু জায়গায় আড়াইজনকে থাকতে হয়৷
সাধারণত দিনের পনেরো ঘণ্টা সেলে বন্দি থাকতে হয় বন্দিদের৷ ৩৬ বর্গফুট জায়গায় আড়াই জন মানুষ যদি দিনের পনেরো ঘণ্টা কাটান, তাহলে তাদের মানসিক এবং শারীরিক অবস্থা ঠিক কেমন হতে পারে, তা আলাদা করে বোঝানোর প্রয়োজন হয় না৷ এর সঙ্গে অকথ্য খাবার, ভয়াবহ বাথরুমের অবস্থা উপরি পাওনা৷
এই খাবারের গল্পই বলেছিলেন সত্তরের দশকের এক জেলা বিচারক৷ জেলার কারাগার দেখতে যাওয়ার ডিউটি থাকতো তাদের৷ কাউকে না জানিয়ে আচমকা জেল পরিদর্শনের কথা থাকলেও খবর বেরিয়ে যেতো৷ বিচারক জেলে পৌঁছে দেখতেন সবই ঠিক আছে৷ অথচ বন্দিদের ভূরি ভূরি অভিযোগ৷
পরিসংখ্যান আসলে সেই অভিযোগকেই মান্যতা দেয়৷ জেল নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠনগুলির তথ্য বলছে, কোনো কোনো রাজ্যে ৪০০ শতাংশ ওভারক্রাউডেড জেল৷ রাজস্থানের ফালৌদি জেলে যেখানে একটি উইংয়ে ১৭ জনের থাকার কথা, সেখানে রয়েছেন ৭৪ জন বন্দি৷ সামগ্রিকভাবে এটাই ভারতের জেলের ছবি৷ সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলায় জানিয়েছিল ভারতের জেলগুলিতে গড়ে ১৫০ শতাংশ অতিরিক্ত বন্দি রয়েছে৷ আর এই অতিরিক্ত বন্দি থাকার কারণেই জেল ঘিরে গড়ে উঠেছে নানান চক্র৷ সামান্য সুবিধা পাওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা ঘুস দিতে হয়৷ সেই টাকা ঘুরে বেড়ায় জেলের বাইরে ছড়িয়ে থাকা অন্ধকার জগতে৷ বাইরে থেকেই যারা জেলের অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে৷
আর এর ঠিক বিপরীত দিকে রয়েছে বিত্তবান বন্দিদের দল৷ সম্প্রতি তথ্য জানার অধিকার আইনে জানা গেছে, রাজনৈতিক নেতা, বড় ব্যবসায়ী, ফিল্মস্টাররা জেলে গেলে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্য পান৷ দক্ষিণের রাজনীতিবিদ শশীকলা জেলের ভিতর বাড়ি থেকে পাঠানো শাড়ি পরতেন৷ তার জন্য আলাদা রান্নাঘরের ব্যবস্থা ছিল৷ টেলিভিশন সেট পর্যন্ত ছিল তাঁর সেলে৷ সঞ্জয় দত্ত, কানিমোঝি থেকে শুরু করে টু-জি স্পেকট্রাম স্ক্যামে অভিযুক্ত এ রাজা সকলেই এই সুবিধা পেয়েছেন৷ স্মিতার অবশ্য বক্তব্য, রাজনৈতিক বন্দি এবং বড় বড় ব্যবসায়ীদের জন্য কখনো কখনো এমন ব্যবস্থা করতেই হয়৷ নিরাপত্তার স্বার্থে৷ কিন্তু তা কতদূর পর্যন্ত করা হচ্ছে, সেটাই দেখার৷ অনেক সময়েই দেখা যায়, রাজনৈতিক চাপে এবং টাকার খেলায় অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে যান তারা৷ কেউ কেউ আবার জেলে না গিয়ে সরকারি হাসপাতালে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেন৷ পশ্চিমবঙ্গের একাধিক রাজনীতিবিদ সাম্প্রতিক সময়ে সে সুবিধা নিয়েছেন৷
পৃথিবীটাই চলে শ্রেণিভেদে৷ উচ্চশ্রেণি বরাবরই সুবিধাভোগী৷ ভারতের জেলও তার ব্যতিক্রম নয়৷ যার যত ক্ষমতা, জেলেও তার সুযোগ তত বেশি৷ ট্যাঁক ফুটো হলে বিপুল যন্ত্রণা৷ আর স্বাভাবিকভাবেই সেই টাকার খেলায় জুড়ে আছে বিশাল অন্ধকার জগৎ৷ রাজনীতি, প্রশাসন কেউই তার বাইরে নয়৷