টাকা দিচ্ছে ক্লাব, পশ্চিমবঙ্গে ক্রিকেটকে পেশা করছেন নারীরা
৩ জুন ২০২৫
অলরাউন্ডার তনুশ্রী সরকার ৫০ বলে ৭৬ এবং উইকেটকিপার প্রিয়াঙ্কা বালার অপ্রতিরোধ্য ৪৫ রানের সুবাদে এই বছর মোহনবাগানকে ৪৭ রানে হারিয়ে সিএবির নারী ক্লাব ক্রিকেট লিগের একদিনের টুর্নামেন্টে জয়ী হয়েছে কলকাতার এরিয়ান ক্লাব। গত বছরের প্রাথমিক সাফল্যের পর এই বছরেও শতাধিক নারী ক্রিকেটার অংশ নিয়েছিলেন এই ক্লাব ক্রিকেট প্রতিযোগিতায়। কেবলমাত্র একদিনের ক্রিকেট নয়, টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতাও হয়েছে পুরো দমে। তার ফাইনালে এরিয়ানকে পরাজিত করে জিতেছে মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব।
ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডান স্পোর্টিং-সহ কলকাতার বড় ফুটবল ক্লাবগুলি অনেকদিন ধরেই ক্রিকেট টেনিসসহ অন্যান্য খেলার দিকে মন দিয়েছে। গত বছর থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে সামনের সারিতে উঠে এসেছে নারী ক্রিকেট। এখানেই শেষ নয়। উইমেনস প্রিমিয়ার লিগের ধাঁচে গত বছর থেকে শুরু হয়েছে নারীদের বেঙ্গল প্রিমিয়ার টি-টোয়েন্টি লিগ। এই বছর ১২ জুন থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে শুরু হবে। ফ্র্যাঞ্চাইসি ভিত্তিতে বিভিন্ন জেলার দলগুলি এই টুর্নামেন্টে অংশ নেন। প্রসঙ্গত, ১১ জুন থেকে ইডেনে হবে পুরুষদের এই একই টুর্নামেন্ট।
কীভাবে সাহায্য পাচ্ছেন নারী ক্রিকেটাররা
প্রাথমিক ভাবে বেড়েছে খেলার সংখ্যা। সিনিয়র বেঙ্গল নারী ক্রিকেট দলের কোচ এবং মোহনবাগান ক্লাবের মেন্টর অর্পিতা ঘোষ বলেন, "এখন অনূর্ধ ১৬ নারী ক্রিকেটারদের নিয়ে সিএবি একটি স্কুল টুর্নামেন্ট করে। গত বছর থেকে এই ক্লাব ক্রিকেটের জন্য অনেক নারী ক্রিকেটার খেলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার কথা ভাবতে পারছেন।" অর্পিতা বেঙ্গল প্রিমিয়ার টি২০ লিগে কলকাতা টাইগার্সের কোচ।
লাগাতার ম্যাচ খেলে বাড়ছে স্কিল। সাবেক বাংলা ক্রিকেটার এবং বর্তমানে বিসিসিআই-এর ম্যাচও রেফারি কথাকলি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "কলকাতার সেরা ক্লাবগুলি উৎসাহ দেখাচ্ছে, এটা নারী ক্রিকেটের জন্য বড় ব্যাপার। এখানেই শেষ নয়। ক্রিকেটাররা নিয়মিত তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করছেন। অন্যান্য সিলেক্টরদের চোখে পড়ছেন। ভবিষ্যতের বাংলা দল তৈরিতে এটার একটা গুরুত্ব থাকবে। একই সঙ্গে অর্থ উপার্জনও করতে পারছেন খেলোয়াড়রা। প্রতিযোগিতা বাড়লে খেলারত মান বাড়বে। এই ধারা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।"
ম্যাচ এবং টিমের সংখ্যা বাড়ার জন্য বেড়েছে খেলোয়াড়দের সংখ্যাও। প্রিয়াঙ্কা ক্রিকেট খেলছেন প্রায় ১২ বছর। তিনি বলেন, "আমরা যখন খেলা শুরু করেছিলাম তখন অল্প ম্যাচ হতো। অত প্র্যাকটিসের সুযোগ থাকত না। এখনকার বাচ্চারা অনেক বেশি ম্যাচ খেলে। তাদের ট্যালেন্ট দেখানোর অনেক বেশি সুযোগ পায়।" প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে একমত তনুশ্রীও। তার কথায়, "এখন কেবলমাত্র একদিনের ক্রিকেটই হচ্ছে না, টি-টোয়েন্টিও হচ্ছে। একদম শুরুর স্তরে এই একাধিক ফরম্যাটে ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেলে যেকোনো খেলোয়াড়ই উৎসাহিত হবেন।
কত অর্থ পান নারী ক্রিকেটাররা?
পুরুষ ক্রিকেটারদের সঙ্গে নারীদের পারিশ্রমিকের তফাত এখনো অনেকটাই। তবে সূত্র জানাচ্ছে, একজন সিনিয়র নারী ক্রিকেটার এখন দুই মাসের টুর্নামেন্টের জন্য প্রায় এক লক্ষ টাকার কাছাকাছি পারিশ্রমিক পান। ময়দানের সাবেক ক্রিকেটারদের মতে কয়েক বছর আগে এটা প্রায় অভাবনীয় ছিল। অর্পিতা বলেন, "বেশিরভাগ নারীরা খেলতে আসেন দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। আগে একজন নারী ক্রিকেটারকে অন্য কোথাও চাকরি করে খেলা চালাতে হতো। এখন খানিকটা হলেও সুরাহা হয়েছে। যা উপার্জন হয় তা দিয়ে সংসার না চললেও নিজেদের যাতায়াত, থাকা খাওয়া এবং সরঞ্জাম কেনার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে।"
তনুশ্রী বলেন, "এই ম্যাচগুলো হওয়ায় শুধু যে ক্রিকেটার হিসেবেই অর্থ উপার্জনের রাস্তা খুলেছে এমনটা নয়। একজন নারী যিনি খেলার দুনিয়া থেকে উঠে এসেছেন তার সামনে এখন স্কোরার, আম্পায়ার, অবসার্ভার হওয়ার সুযোগও বেড়েছে। ফলে কোনো নারী ক্রিকেটার চাইলে খেলা নিয়েই থাকতে পারেন।"
'নারী ক্রিকেটের প্রতি মনোযোগী সিএবি'
সাবেক ক্রিকেটার, জাতীয় নারী দলের সিলেক্টর এবং বর্তমানে সিএবির নারী কমিটির চেয়ার লোপামুদ্রা ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে জানান, "গত বছর ১০টি ক্লাব অংশগ্রহণ করেছিল। এই বছর আরো ১০টি ক্লাব যোগ দেয়। নতুন ১০টি ক্লাবের মধ্যে একটি কোয়ালিফাইং প্রতিযোগিতা হয়। সেখান থেকে দুটি ক্লাব মূল প্রতিযোগিতায় খেলে।"
এবছর মোট ১২টি দলের মধ্যে এই টুর্নামেন্টটি সংগঠিত হয়। ছয়টি ক্লাব নিয়ে দুইটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। তার পর শুরু হয় মূল পর্বের খেলা। গতবছর টিম তৈরি থেকে কোচ আনা -- প্রায় সব কিছুতেই প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেয় সিএবি। লোপামুদ্রা জানান, "এ বছর ক্লাবগুলো নিজেরাই টিম তৈরি করেছে, কোচ এনেছে। কলকাতার তুলনায় জেলা থেকে অনেক বেশি সংখ্যক নারী ক্রিকেট খেলতে আসেন। তারা ঠিক মতো টাকা পাচ্ছে কি না বা তাদের থাকা খাওয়া ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা সেই বিষয় নজর রাখে সিএবি।"
২০০৬-এ উইমেনস ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনকে নিজেদের ছত্রছায়ায় আনে বিসিসিআই। ২০০৭ থেকে সিএবির নিয়ন্ত্রণে থাকে বাংলার নারীদের ক্রিকেট। বেশ কয়েক বছর ধরেই নারী ক্রিকেটকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বাংলার ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ। লোপামুদ্রা বলেন, "অভিষেক ডালমিয়া সিএবির সভাপতিও থাকার সময়েও বেশ কিছু কাজ হয়েছে। বর্তমান সভাপতি স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় অনেকগুলি উদ্যোগ নিয়েছেন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের অ্যাডভাইসার। তিনি পুরুষদের ক্রিকেটের সঙ্গে প্রায় তাল মিলিয়ে নারী ক্রিকেটকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।"
তবে নারী ক্রিকেটের আরেকটু বেশি প্রচার প্রাপ্য বলে মনে করেন অনেকেই। প্রিয়াঙ্কা বালা বলেন, "মাঠে দর্শক টানতে আরেকটু বেশি প্রচার দরকার। কখনো কখনো কিছু ম্যাচ টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়াতে লাইভ সম্প্রচার হওয়াও দরকার।"