এভারেস্টে তুষার ধসে ১৬ শেরপার মৃত্যুর পর শোক গ্রাস করেছে পুরা হিমালয়কে৷ পাহাড়ের সন্তান শেরপারা জানেন না – আগামী দিনগুলো তাঁদের কীভাবে কাটবে, আবার তাঁরা অভিযানে ফিরবেন কিনা৷
বিজ্ঞাপন
পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের পথে পর্বতারোহীদের ‘গাইড' হিসাবে কাজ করেন নরবু শেরপা৷ ‘ওয়াইল্ড ইয়াক' নামে একটি এজেন্সিও তিনি চালান, যারা হিমালয়ে বিভিন্ন অভিযানের ব্যবস্থা করে দেয়৷
এ পেশার ঝুঁকি এবং শেরপাদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ডয়চে ভেলের সঙ্গে৷
ডয়চে ভেলে: কতদিন ধরে আপনি পর্বতারোহীদের গাইড হিসাবে কাজ করছেন?
২০০৪ সালে আমি কাজ শুরু করি এক বাবুর্চির সহকারী হিসাবে৷ প্রথমবারের মতো এভারেস্টে উঠেছিলাম ২০০৬ সালে৷ তারপর থেকে ছয়বার সেখানে গেছি৷
গত ১৮ এপ্রিল এভারেস্টের ঢালে তুষার ধসে যে শেরপারা নিহত হলেন, তাঁদের চিনতেন?
ওঁদের মধ্যে একজন তো আমার গাঁয়েরই ছেলে৷ আমরা ছিলাম ঘনিষ্ট বন্ধু৷ ওঁ নিয়মিত এভারেস্টে যেত৷ নেপালে শেরপাদের জাতীয় যে সংগঠন, তার সদস্য ছিল সে৷ ওই দলের আর যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গেও আমার বন্ধুত্ব ছিল৷ অন্তত পাঁচজনকে চিনতাম আমি৷
এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে গিয়ে বহু পর্বতারোহীকে প্রাণ দিতে হয়েছে৷ শেরপা হিসাবে সেখানে যেতে আপনার কখনো ভয় করেছে?
দেখুন, আমরাও তো আর দশটা মানুষের মতো, আমাদেরও ভয় করে৷ টাকার জন্য আমাদের এ কাজ করতে হয়৷ রাত যখন দুটো, তখন আমাদের কাজ শুরু হয়৷ শেরপার কাজ পৃথিবীর সবচে কঠিন কাজগুলোর একটা৷ আমি একবার এভারেস্টে গেলে আমার পরিবারের এক বছরের খোরাকি জুটে যায়৷ নেপালে শেরপাদের জন্য এটাই একমাত্র কাজ – যাতে ভালো পয়সা পাওয়া যায়৷ আসলে এর বাইরে তেমন কোনো কাজের সুযোগও এখানে নেই৷
নেপাল সরকার নিহত শেরপাদের পরিবারকে যে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে তা যথেষ্ট বলে মনে করেন?
আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, আমাদের বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে মৃতের সৎকারের কাজে মোটা টাকা খরচ হয়ে যায়৷ শুরুতে নিহত প্রত্যেক শেরপার পরিবারকে ৪০০ মার্কিন ডলার (২৯০ ইউরো) দেয়ার কথা বলা হচ্ছিল, যা রীতিমতো হাস্যকর৷ তবে এখন ১০ হাজার ডলার দেয়ার কথা বলছে৷ এটা হলে ভালো৷ এর বাইরে সরকার নিহত শেরপাদের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ যোগানোর কথা ভাবছে৷
এভারেস্ট জয়ের ষাট বছর
১৯৫৩ সালে এডমান্ড হিলারি এবং শেরপা তেনজিং নোরগে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন৷ মানব জাতির ইতিহাসে তাঁরাই প্রথম পা রাখেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে৷ আর ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন মুসা ইব্রাহীম৷
ছবি: DIAMIR Erlebnisreisen GmbH
প্রথম জয়, প্রথম মৃত্যু
২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের সর্বোচ্চ শেখরে পা রাখেন মুসা ইব্রাহীম (বামে)৷ সেই জয়ের খবরে আনন্দের বন্যা নামে বাংলাদেশে৷ আর ২০১৩ সালে এভারেস্ট জয় করে ফেরার পথে মারা যান সজল খালেদ৷ এই ছবিঘরে মানবজাতির এভারেস্ট জয়ের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে৷ একেবারে সেই ১৯৫৩ সাল থেকে৷
ছবি: Musa Ibrahim
কোড ম্যাসেজ
‘‘স্নো কন্ডিশনস ব্যাড স্টপ অ্যাডভান্সড বেস এবানডন্ড মে টোয়েন্টিনাইন স্টপ অ্যাওয়েটিং ইমপ্রুভমেন্ট স্টপ অল ওয়েল’’ এই ম্যাসেজের অর্থ হচ্ছে: ‘‘হিলারি এবং তেনজিং ২৯ মে এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়া জয় করেছে৷’’ ১৯৫৩ সালের পহেলা জুন এই তথ্য লন্ডনে পৌঁছায়৷ এভারেস্টের সর্বোচ্চ শিখরে মানুষের পদচিহ্নের খবর শুনে উৎসবে মেতে ওঠে সবাই৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
কে আগে চূড়ায় উঠেছিল?
নিউজিল্যান্ডের এডমান্ড হিলারি আর শেরপা তেনজিং নোরগে (ছবিতে বামে) এভারেস্ট জয়ের পর এক নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়৷ এই দু’জনের মধ্যে কে আগে চূড়ায় পা রেখেছিলেন তা নিয়ে শুরু হয় তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক৷ নেপাল এবং ভারত এই জয় তাদের দাবি করে৷ তবে এভারেস্ট জয়ের কয়েক বছর পর হিলারি জানান, চূড়ায় ওঠার সময় তিনি তেনজিং এর থেকে কয়েক পা সামনে ছিলেন৷
ছবি: DW/S. Nestler
অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্ট জয়
হিলারি ও তেনজিং-এর সেই ঐতিহাসিক অভিযানের পরের তিন দশকে বহু পর্বতারোহী বিভিন্ন পথ ধরে এভারেস্টে উঠেছেন৷ ১৯৭৮ সালে সাউথ টাইরোলিয়ান রাইনহোল্ড মেসনার (ডানে) এবং অস্ট্রেলিয়ান পিটার হেবেলার (বামে) অক্সিজেনের বাড়তি জোগান ছাড়াই এভারেস্ট জয় করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দলে দলে এভারেস্ট জয়
১৯৯০ দশকের দিকে দল বেধে পর্বতারোহীরা এভারেস্ট জয় শুরু করেন৷ সেই সময় থেকে প্রতিবছর শত শত পর্বতারোহী এভারেস্টের চূড়ায় উঠছেন৷ রেকর্ড বলছে, এখন অবধি কমপক্ষে ৬,০০০ বার সফলভাবে এভারেস্টের চূড়া জয় করেছে মানুষ৷ আবহাওয়া ভালো থাকলে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে এভাবেই এভারেস্টের চূড়ার দিকে যাত্রা করেন পর্বতারোহীরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চূড়ায় পর্বতারোহীদের ভিড়
সফলভাবে এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে চূড়ান্ত পর্যায়ে অ্যাডভান্সড বেস ক্যাম্প থেকে কমপক্ষে চারদিন সময় লাগে আর এই সময়টা আবহাওয়া অবশ্যই ভালো থাকতে হবে৷ সাধারণত একইসময়ে অনেক অভিযাত্রী চূড়ার দিকে যাত্রা করেন, কেননা সবাই আবহাওয়ার পূর্বাভাষের উপর নির্ভরশীল৷ ফলে একদিনে অনেক পর্বতারোহীকে চূড়ায় এভাবে ভিড় করতে দেখাটা স্বাভাবিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেরপারা পথ দেখান
শেরপাদের সহায়তা ছাড়া কারো পক্ষে এভারেস্টের চূড়া জয় করা কার্যত অসম্ভব৷ তাঁরা এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার পথের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সদা তৎপর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
৮০ বছরে এভারেস্ট জয়
এভারেস্ট প্রতি বছরই চলে রেকর্ড গড়ার এবং ভাঙার খেলা৷ এই বসন্তে আশি বছর বয়সি জাপানি বৃদ্ধ ইউচিরো মিউরা এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় পা রেখেছেন৷ এর আগে ২০১০ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে এভারেস্ট জয় করেন জর্ডান রেমেরো৷ দুটোই রেকর্ড৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উদ্ধার তৎপরতা
২০০৩ সালে এভারেস্ট বেসক্যাম্পে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান দুই ব্যক্তি৷ দশ বছর পর মানে এখন এভারেস্ট বেসক্যাম্প পর্যন্ত হেলিকপ্টারে যাতায়াত স্বাভাবিক ব্যাপার৷ এখন অবধি সর্বোচ্চ ৭,৮০০ মিটার উচ্চতায় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা সম্ভব হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
এভারেস্টে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এভারেস্টেরও ক্ষতি হচ্ছে৷ গত পঞ্চাশ বছরে সেখানকার বরফের পরিমাণ কমেছে ১৩ শতাংশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গর্বের এভারেস্ট
এভারেস্টের অধিকাংশ অংশই নেপালের আওতায় রয়েছে৷ ফলে এভারেস্টকেন্দ্রিক পর্যটন খাত থেকে বিপুল অর্থ আয় করে দেশটির সরকার৷ প্রতি বছরের ২৯ মে ‘আন্তর্জাতিক মাউন্ট এভারেস্ট দিবস’ উদযাপন করে নেপাল৷ ১৯৫৩ সালের এই দিনে এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিল মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পর্যটক কমাতে অনাগ্রহী নেপাল
এভারেস্টের চূড়ায় আরোহনের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন বিধিনিষেধ আরোপ করার পক্ষে নয় নেপাল৷ বরং প্রয়োজনীয় টাকা থাকলে যেকেউ চেষ্টা করতে পারে এভারেস্ট জয়ের৷
ছবি: DW/S. Nestler
বাংলাদেশের এভারেস্ট জয়
২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন মুসা ইব্রাহীম৷ এরপর আরো চারজন বাংলাদেশি এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন৷ এদের মধ্যে দু’জন মেয়ে৷ আর ২০১৩ সালে চূড়া জয় করে নামার পথে ‘ডেথ জোনে’ মারা যান সজল খালেদ৷
ছবি: DIAMIR Erlebnisreisen GmbH
13 ছবি1 | 13
গত বছর এভারেস্টে চারজন এবং অন্য চূড়ায় আরো দু'জন শেরপার মৃত্যু হয়েছে৷ তখন এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি, এমনকি সরকারও না৷ এবার একসঙ্গে মারা গেল ১৬ জন৷ এখন আমাদের উচিত সরকারকে চাপ দেয়া, যাতে শেরপাদের দিকটাও দেখা হয়৷ যাঁরা চিরতরে হারিয়ে গেলেন – টাকা দিয়ে তো আর তাঁদের ফেরানো যাবে না৷
এবারের মৌসুমে এভারেস্টে সব অভিযান স্থগিত করা হয়েছে, অভিযাত্রীরা ফিরেও আসছে৷ এতে শেরপাদের আর্থিকভাবে সমস্যায় পড়তে হবে না?
বেইজ ক্যাম্প থেকে শেরপারা যখন সবাই কাঠমাণ্ডুতে ফিরবে, তখনই এটা পরিষ্কার করে নিতে হবে যে ট্যুর অপারেটররা পরিস্থিতির উন্নতির জন কী কী করবে৷ তাছাড়া সরকারও বলেছে, অভিযান থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার একজন শেরপার রয়েছে৷
অবশ্য শেরপাদের মধ্যে সবার অবস্থা একরকম নয়৷ অনেকের পরিবারের সব খরচ, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া – সব কিছু এই একটিমাত্র কাজের ওপর নির্ভরশীল৷ ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় – তাঁদের আবারো এভারেস্টে যেতে হবে৷