পেশাগত কারণে একসময় প্রায় নিয়মিত প্রেসক্লাব, তোপখানা, পল্টন, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, মতিঝিল এলাকায় যেতে হত৷ আসলে বাংলাদেশের অধিকাংশ সংবাদ উৎস এসব এলাকায়৷
ছবি: DW
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অফিস বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আর নয়াপল্টনে৷ অধিকাংশ বাম দলের অফিস তোপখানা এলাকায়৷ খেলার অধিকাংশ খবর মেলে স্টেডিয়ামে৷ আর ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতির খবরের জন্য যেতে হয় মতিঝিলে৷ প্রেসক্লাবের সামনে বছরজুড়ে চলে দাবি-দাওয়ার সমাবেশ৷ এখন তো মাঠে রাজনীতি নেই৷ যখন ছিল, তখন পল্টন ময়দান, মুক্তাঙ্গন, জিরো পয়েন্ট, পল্টন, তোপখানা এলাকা সবসময় মুখরিত থাকত৷ লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া সব মিলে জমজমাট এলাকা৷ তখন নিয়মিত যেতে হতো৷ কিন্তু তখন প্রেসক্লাব থাকলেও রিপোর্টার্স ইউনিটি ছিল না৷ ১৯৯৬ সালে রিপোর্টার্স ইউনিটি শুরু হলেও আজকের মত জমজমাট হয়নি৷ তাই মাঠে কাজ করতে গিয়ে আমাদের নানা ঝামেলায় পরতে হতো৷ রাস্তার পাশের সস্তা হোটেলে খেতে হতো৷ তবে সবচেয়ে বেশি বিপদে পরতাম ঝড়-বৃষ্টিতে আর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে৷ তখন আমরা ‘অসভ্য’ ছিলাম, তাই প্রেসক্লাবে ঢুকতে পারতাম না, এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার মত জরুরি কাজেও না৷ রাস্তার উল্টোপাশে আরেক পেশাজীবী সংগঠনের কার্যালয় বিএমএ ভবনে তবু যাওয়া যেতো, প্রেসক্লাবে নয়৷ শুধু প্রেসক্লাবে ঢোকা নয়, সভ্য হওয়ার পথটিও রুদ্ধ ছিল ‘ব্ল্যাক বল’ নামের এক কালো আইনে৷ সেই দিন আর এখন নেই৷ প্রেসক্লাবের সভ্য হয়েছি, তাও অনেক বছর আগে৷ কিন্তু এখন আর প্রেসক্লাব বা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে যাওয়ার সময় পাই না৷
সাংবাদিকদের ব্যাংক হিসাব তলবের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের শীর্ষ চার সংগঠনের ১১ নেতার ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিএফআইইউ৷ এই ঘটনা ‘উদ্দেশ্যমূলক’ বলছেন সাংবাদিক নেতারা৷
ছবি: bdnews24.com
১১ সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব তলব
সাংবাদিকদের শীর্ষ চার সংগঠনের ১১ নেতার ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিএফআইইউ৷ ১২ সেপ্টেম্বর বিএফআইইউ থেকে এ বিষয়ে একটি চিঠি সকল ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে৷ একটি ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজকে জানান, চিঠিতে ওই ১১ সাংবাদিকের নাম, সাংগঠনিক পদবি, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে ব্যাংক লেনদেনের তথ্য চাওয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters/A. Rahman
যাদের হিসাব চাওয়া হয়েছে
প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বিএনপি অংশের সভাপতি আব্দুল কাদের গণি চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ অংশের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের বিএনপি অংশের এম আব্দুল্লাহ, নুরুল আমিন রোকন, আওয়ামী লীগ অংশের মোল্লা জালাল, আব্দুল মজিদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মুরসালীন নোমানী ও মসিউর রহমান খান৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
জাতীয় প্রেসক্লাবের বিবৃতি
১৫ সেপ্টেম্বর প্রেসক্লাবের এক বিজ্ঞপ্তিতে ব্যাংক হিসাব তলবের নিন্দা জানিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়৷ এই ঘটনাকে ‘উদ্দেশ্যমূলক’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়৷ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘‘... প্রচলিত আইনে কোনো ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত হতেই পারে৷ কিন্তু শুধুমাত্র একটি পেশার সকল সংগঠনের নির্বাচিত শীর্ষ নেতাদের নামে ঢালাও এই সিদ্ধান্ত বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷’’
ছবি: DW
সংবাদ সম্মেলন
১৮ সেপ্টেম্বর বিএফইউজে, ডিইউজে, জাতীয় প্রেস ক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ব্যানারে একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়৷ এতে বলা হয়, ‘‘সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোর নির্বাচিত নেতাদের ব্যাংক হিসাব এভাবে তলব করা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা৷ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের তদন্ত হতেই পারে৷ কিন্তু সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতাদের নামে ঢালাওভাবে এ ধরনের পদক্ষেপ উদ্দেশ্যমূলক৷’’
ছবি: bdnews24.com
তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য
২০ সেপ্টেম্বর তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘‘সরকার যে কারও ব্যাংক হিসাব তলব করতে পারে৷ এমপি, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তাদেরও ব্যাংক হিসাব তলব হয়৷ তবে কেউ স্বচ্ছ থাকলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই৷ কারণ, এই ব্যাংক হিসাব থেকে যখন তাদের স্বচ্ছতা বেরিয়ে আসবে, তখন মানুষের সামনে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে৷’’
ছবি: bdnews24.com
‘অপ্রত্যাশিত’ বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
২০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের ব্যাংক হিসাব তলবের চিঠিকে ‘অপ্রত্যাশিত’ বলেন৷ এ ব্যাপারে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে কথা বলেছেন বলেও জানান৷
ছবি: bdnews24.com
বিএনপির প্রতিক্রিয়া
২০ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের দমন-নিপীড়ন থেকে সাংবাদিকেরাও রেহাই পাচ্ছেন না৷ সত্য প্রকাশে সাংবাদিকদের টুঁটি চেপে ধরার পর এখন সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব সাংবাদিকদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টির একটি নতুন কৌশল৷ এ ঘটনাকে উদ্দেশ্যমূলক বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নজিরবিহীন এ ঘটনা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে চরম হুমকি৷
ছবি: DW/S. Hossain
বৃহস্পতিবারের সমাবেশ স্থগিত
তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের অনুরোধে সাংবাদিকদের ডাকা বৃহস্পতিবারের সমাবেশ স্থগিত করা হয়৷ সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে হাছান মাহমুদ জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেছেন৷ সরকার দ্রুত এ সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট৷ তাই এ বিষয়ে সহযোগিতার পরিবেশ রক্ষায় কর্মসূচি স্থগিত রাখার জন্য তিনি সাংবাদিক নেতাদের অনুরোধ করেন৷ সে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে৷
ছবি: DW
8 ছবি1 | 8
শুরুর দিকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি সংগঠন করারও খুব আগ্রহ ছিল৷ নব্বই দশকের শুরুর দিকে বাংলাবাজার পত্রিকার ইউনিটে খুব সক্রিয় ছিলাম৷ বিএফইউজে, ডিইউজের সব কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতাম৷ প্রেসক্লাবের সদস্যপদ উন্মুক্ত করার দাবির আন্দোলনেও অংশ নিয়েছি৷ একবার রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচনে অংশ নিয়ে সদস্যও হয়েছিলাম৷ কিন্তু পেশাগত ব্যস্ততায় সেই রাজনীতি আর করা হয়নি৷ তবে আমি সারাবছর যেতে পরি আর না পারি, নির্বাচনের সময় অবশ্যই ভোট দিতে যাই৷ প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি, বিএফইউজে, ডিইউজে মিলে ভোট দিতে যেতে হয় ৪/৫ বার, তাতে অনেকের সাথে দেখা হয়ে যায়৷ তবে দেখা হওয়ার জন্য নয়, আমি আসলে যাই সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা যাতে নির্বাচিত হতে পারে৷ সবসময় যে আমার পছন্দের প্রার্থীই জয় পান, তা নয়; তবে আমি আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকি যে আমি একজন সৎ মানুষকে ভোট দিয়েছি৷ নিশ্চিত হারবেন জেনেও আমি সৎ ও যোগ্য মানুষকে ভোট দেই৷ তবে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন নিয়ে যেসব কাণ্ডকারখানা হয়, তাতে আমার অনেক প্রশ্নের জবাব পাই না৷ সাংবাদিকদের নেতৃত্ব দৃশ্যত কোনো লাভজনক পদ নয়৷ কিন্তু বড় বড় পদে নির্বাচনের ব্যয় সম্পর্কে যা শুনি, তা আমার কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে যায়৷ কারো কারো একবারের নির্বাচনের যত ব্যয় শুনি, তা থাকলে আমার সারাজীবনের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যেত৷ এত পরিশ্রম করে, এত ব্যয় করে তারা কেন নেতা নির্বাচিত হতে চান? এই প্রশ্নের জবাব আমি জানি না৷
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচন হয় প্রতিবছর ৩০ নভেম্বর৷ ২০১৭ সালের নির্বাচিত কমিটিকে স্বাগত জানিয়ে আমি একটি লেখা লিখেছিলাম৷ ‘নেতা চাই, চাঁদা আদায়কারী নয়’ শিরোনামের লেখাটি থেকে একটু উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ‘রিপোর্টার্স ইউনিটিতে নিয়মিত যাওয়া আসা করেন, এমন একজন জানালেন, রিপোর্টার্স ইউনিটির বছরে খরচ প্লাস মাইনাস তিন কোটি টাকা৷ ক্যান্টিনে সাবসিডি রেটে খাওয়া, পিকনিক ইত্যাদিতে বড় খরচ হয়৷ হল ভাড়া থেকে আয় হয় এক কোটি টাকা৷ বাকি টাকাটা আসে কোত্থেকে?
তিনি জানালেন, বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুদান থেকে৷ তিনি অনুদান বললেন বটে, তবে আমি শুনলাম চাঁদা৷ আসলে চাঁদাই তো৷ নইলে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কেন বছরের পর বছর রিপোর্টার্স ইউনিটিকে অনুদান দেবে৷ মানুষ মসজিদে বা মাদ্রাসায় টাকা দেয় সওয়াবের আশায়৷ রিপোর্টার্স ইউনিটিকে টাকা দিয়ে তো অশেষ নেকি হাসিল হবে না৷ সহজ কথা হলো, এসব প্রতিষ্ঠান রিপোর্টারদের হাতে রাখতে চায় বলেই তাদের টাকা দেয়৷ অনুদান কত হবে, সেটা নির্ভর করে রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারির দক্ষতার ওপর৷ যিনি যত বেশি অনুদান বা চাঁদা আনতে পারবেন, তিনি তত সফল৷ আমরা আসলে ভোট দিয়ে চাঁদাবাজ নির্বাচিত করি৷ তবে তিনি দাবি করলেন, এখন অনুদান নেওয়া হয় স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, চেকের মাধ্যমে৷ ধরে নিচ্ছি, আমরা যাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করছি, তারা ব্যক্তিগতভাবে সৎ৷ কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডিআরইউর সততা কিন্তু আমরাই প্রতিদিন প্রশ্নের মুখে ফেলছি৷ নেতাদের সততা নিয়ে সন্দেহ নেই৷ তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়, এত টাকা খরচ করে তারা নেতা হতে চান কেন?’
কার্যকর গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কি?
গণমাধ্যমের কার্যকারিতা নিয়ে ১৬টি ডিজিটাল মিডিয়া স্টার্টআপের একটি দল কাজ করছে। মানসম্পন্ন সংবাদ প্রকাশ এবং টিকে থাকার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সংস্থাগুলোকে কি ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় জানালেন বিভিন্ন দেশের এই সাংবাদিকেরা।
ছবি: DW Akademie
ডিজিটাল মিডিয়ার অগ্রদূত যারা
১৬টি ডিজিটাল মিডিয়া স্টার্টআপের একটি দল গণমাধ্যমের কার্যকারিতা নিয়ে কাজ করছে। তারা জবাব দিচ্ছে: তাদের দেশে গণমাধ্যমের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে কি কি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়?
ছবি: DW Akademie
লিকা আনতাদজে, জর্জিয়া, চায় খানা
‘’নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ সংবাদ পরিবেশন, একই সাথে দীর্ঘ সময় টিকে থাকা এবং ভালো পাঠক ও দর্শক তৈরি করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।‘’
ছবি: DW Akademie
তানিয়া এল মন্তালভো, মেক্সিকো, অ্যানিমেল পলিটিকো
‘’মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনা, মানসম্পন্ন সংবাদ পরিবেশন, মাথায় রাখা পাঠকরা কোন বিষয়গুলো জানতে চায়-এগুলোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।‘’
ছবি: DW Akademie
টিডিয়ানে হামাদৌ, সেনেগাল, ওয়েস্তাফ নিউজ
‘’গণমাধ্যমের উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর কোন বাধ্যবাধকতা জনগণের নেই। তবে নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যম তাদের জন্য কিছু একটা করতে পারে এবং এটার একটা মূল্য আছে, এই বিষয়টা তারা ভালো বোঝে।‘’
ছবি: DW Akademie
পিং জিন থুম, সিঙ্গাপুর, নিউ ন্যারাটিফ
‘’দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে আইন করেছে সরকার। সরকারের সহযোগীদের হাতে বেশিরভাগ গণমাধ্যমের মালিকানা। নিরপেক্ষ গণমাধ্যমকে হয়রানি করা হয়, মামলা দেয়া হয় বা কিনে নেয়া হয়। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স বা বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচিতে এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থান বেশ নিচে।‘’
ছবি: DW Akademie
লুসিয়া মেনেনডেজ, গুয়াতেমালা, নোমাডা
‘’যে দেশের পাঠকেরা মানসম্পন্ন সাংবাদিকতায় অভ্যস্ত না, তাদের নিরপেক্ষ সংবাদে অন্তর্ভুক্ত করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।‘’
ছবি: DW Akademie
কিরিলো লুকেরেংকো, ইউক্রেন, রোমাদস্কে রেডিও
‘’আইনের অবৈধ ব্যবহার ইউক্রেনের গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।‘’
ছবি: DW Akademie
লুসিয়া মার্টিনেজ, আর্জেন্টিনা, চেকুয়াদো
‘’সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যা দীর্ঘ সময় ধরে মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা ধরে রাখবে।‘’
ছবি: DW Akademie
ডেভিড হিলাডগো ভেগা, পেরু, ওজো পাবলিকো
‘’লাতিন অ্যামেরিকায় গণমাধ্যমের কার্যকারিকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল, জনগণের চাহিদার কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন ধরণের খবর পরিবেশন।‘’
ছবি: DW Akademie
রোমান ফিলিপভ, মলদোভা, রাইজ মলদোভা
‘’যে দেশে শাসকগোষ্ঠীর হাতে বেশিরভাগ গণমাধ্যম, সেখানে একটা নিরপেক্ষ গণমাধ্যম হিসেবে গুণগত ও মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ।‘’
ছবি: DW Akademie
তামারা কারাইন, জার্ডান, এআরআইজে
‘’আয়, নেতৃত্ব এবং প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ।‘’
ছবি: DW Akademie
11 ছবি1 | 11
জাতীয় প্রেসক্লাবের ক্যান্টিনেও ভর্তুকি মূল্যে খাবার পাওয়া যায়, বড় আয়োজনের পিকনিক হয়; তারমানে প্রেসক্লাবকেও অনুদানের নামে চাঁদার টাকায় ঘাটতি পোষাতে হয়৷ আমি সত্যিই জানি না, এত অর্থ ব্যয় করে ঘাটতিতে থাকা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে কেন আসতে চান সবাই৷ নেতৃত্বের আকাঙ্খা, সামাজিক মর্যাদা নাকি অন্য কিছু?
আগে সমাজে সাংবাদিকদের উচ্চ মর্যাদা ছিল৷ সাংবাদিকদের সবাই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা মেশানো সমীহ করতো৷ গত কয়েক বছরে সামাজিক পারসেপশনটা পাল্টে গেছে৷ এখনও সাধারন মানুষ সাংবাদিকদের সমীহ করে বটে, তবে তাতে ভালোবাসা-শ্রদ্ধার চেয়ে ভয় মেশানো থাকে বেশি৷ মনে করা হয়, সাংবাদিকদের মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা আছে৷ এ কারণে অনেক বাড়িওয়ালা সাংবাদিকদের বাড়ি ভাড়া দিতে চান না৷ সাধারণভাবে সাংবাদিকদের নৈতিকতা এবং সততা প্রশ্নবিদ্ধ৷ সাধারণ মানুষ মনে করে, সাংবাদিকেরা বেতনকড়ি পায় না৷ তারা ধান্ধাবাজি বা চাঁদাবাজি করেন৷ তাদের ধারণা, সাংবাদিকরা সরকারের দালালি করে এবং বিনিময়ে সরকার তাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়৷ প্রথম কথা হলো, বাংলাদেশের সব খাতই এখন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত৷ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে৷ সাংবাদিকরাও এই সমাজেই বাস করে৷ তাই সাংবাদিকদের কারো কারো আয়ের সাথে ব্যয় নাও মিলতে পারে৷ বাড়ি, গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, শান শওকত দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না; শুধু সাংবাদিকতায় সম্ভব নয় এতকিছু৷ তবে সাংবাদিকদের সম্পর্কে সামাজিক পারসেপশনে একটা বড় রকমের গলদ আছে৷ মানুষের সাথে কথা বললেই মনে হয়, সৎ সাংবাদিক মানেই তিনি বস্তিতে থাকবেন, রিকশায় চড়বেন৷ কদিন আগে আমি অফিসে যাওয়ার সময় মেসেঞ্জারে একজন কল দিলেন৷ ধরে বললাম, আমি গাড়ি চালাচ্ছি, পরে ফোন দেবো৷ আমি গাড়ি চালাচ্ছি শুনে ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পরলেন৷ তার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হলো, গাড়িটি আমি সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কোনো শোরুম থেকে এইমাত্র ডাকাতি করে এনেছি৷ অথচ গত ২০ বছর ধরেই আমি অফিস থেকে চালকসহ সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা পেয়ে আসছি৷ শুধু আমি নই, ঢাকায় এমন শখানেক সাংবাদিক আছেন, যারা অফিসের দেয়া গাড়ি ব্যবহার করেন৷ লাখ টাকার ওপর বেতন পান, এমন সাংবাদিকের সংখ্যাও অনেক যাবে৷ কোনো সাংবাদিকের গাড়ি-বাড়ি আছে শুনলেই, তাকে অসৎ মনে করার কোনো কারণ নেই৷ ২৫/৩০ বছর ভালো প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা করলে, একটু হিসাব করে চললে; ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একটা ফ্ল্যাট বা গাড়ি কেনা সম্ভব৷ সাংবাদিকদের সম্পর্কে এই ভুল পারসেপশনে সুকৌশলে ঘি ঢেলেছে সরকার৷ সম্প্রতি সরকারের একটি সংস্থার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বাংলাদেশের ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়ে ১১ সাংবাদিক নেতার বিস্তারিত হিসাব চেয়েছে৷ চিঠিতে বিস্তারিত হিসাব মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে৷ বিএফআইইউ প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং দুইভাগে বিভক্ত বিএফইউজে এবং ডিইউজের শীর্ষ নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে৷ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এ সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবি জানাচ্ছেন৷ তবে যাদের হিসাব চাওয়া হয়েছে, তাদের অধিকাংশই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন৷ যদিও এখন তারা সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেন৷ সবাই এখন এর বিরোধিতাই করছেন৷
সেরা ১১ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
পুলিৎজার পুরস্কারকে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার বলে ধারণা করা হয়৷ গত ১১ বছরে কারা পেয়েছেন এ পুরস্কার জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: Heidi Levine
২০০৬ সাল
যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা ‘ওয়াশিংটন পোস্টে’-র সাংবাদিক সুজান স্মিড, জেমস ভি গ্রিমাল্ডি এবং আর. জেফরি স্মিথ সে বছর পেয়েছিলেন এই পুরস্কার৷ সংস্কারের নামে মার্কিন কংগ্রেসে ওয়াশিংটন লবিস্ট জ্যাক আব্রামোফের দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিবেদন করেছিলেন তারা৷
ছবি: AP
২০০৭ সাল
‘দ্য বার্মিংহ্যাম নিউজ’-এর ব্রেট ব্ল্যাকলেজ পেয়েছিলেন এই পুরস্কার৷ একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করে দেন তিনি৷ যার ফলে ঐ চ্যান্সেলরকে বরখাস্ত করা হয়েছিল এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
২০০৮ সাল
এ বছর দু’টি পত্রিকা এ পুরস্কার পায়৷ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার ওয়াল্ট বোগদানিচ এবং জেক হুকার পেয়েছিলেন এ পুরস্কার৷ চীন থেকে আমদানিকৃত ওষুধ ও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি সংক্রান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন তারা৷ এছাড়া ‘শিকাগো ট্রিবিউন’-এর এক প্রতিনিধি জিতেছিলেন এই পুরস্কার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০৯ সাল
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর ডেভিড বার্সতো পেয়েছিলেন এ পুরস্কার৷ কিছু অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা রেডিও ও টেলিভিশনে বিশ্লেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পেন্টাগনের সমর্থনে ইরাক যুদ্ধকে প্রভাবিত করছে৷ তাদের এসব বক্তব্যের কারণে কত কোম্পানি সুবিধাভোগ করছে তাও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Emmert
২০১০ সাল
‘দ্য ফিলাডেলফিয়া ডেইলি নিউজ’-এর বারবারা ল্যাকার ও ওয়েনডি রুডারম্যান এবং ‘নিউইয়র্ক টাইম ম্যাগাজিন’-এর প্র-পাবলিকার শেরি ফিঙ্ক যৌথভাবে এ পুরস্কার জিতেছিলেন৷ একটি অসৎ পুলিশ দলের মাদক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি উদঘাটন করেন ল্যাকার ও রুডারম্যান৷ ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ হয়েছিল৷ ফিঙ্ক ঘূর্ণিঝড় ক্যাটরিনা আঘাত হানার পর রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসকদের মানসিক অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Ngan
২০১১ সাল
‘সারাসোতা হেরাল্ড ট্রিবিউন’-এর পেইজি সেন্ট জন সে বছর পুলিৎজার পেয়েছিলেন৷ ফ্লোরিডার বাড়ি মালিকদের সম্পদের ইনস্যুরেন্সে দুর্বলতা সংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তাঁকে এ পুরস্কার এনে দিয়েছিল৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
২০১২ সাল
‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’-এর ম্যাট অ্যাপুৎসো, অ্যাডাম গোল্ডম্যান, এইলিন সুলিভান এবং ক্রিস হাওলি সে বছর এই পুরস্কার জিতেছিলেন৷ নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের ‘ক্ল্যানডেস্টাইন গুপ্তচর কর্মসূচি’র আওতায় শহরের মুসলিম সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবন যাপনের প্রতি নজর রাখা হচ্ছিল, যা প্রকাশ পায় এপি-র ঐ প্রতিবেদনে৷ প্রতিবেদন প্রকাশের পর কংগ্রেস থেকে কেন্দ্রীয় তদন্ত দাবি করা হয়৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
২০১৩ সাল
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এর ডেভিড বার্সতো এবং আলেহান্দ্রা ইয়ানিক ফন বেরত্রাব এই বছর পুরস্কারটি পান৷ মেক্সিকোতে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে কীভাবে ওয়াল-মার্ট ঘুষ দেয়, সেটা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন তারা৷
ছবি: AP
২০১৪ সাল
ওয়াশিংটর ডিসির ‘দ্য সেন্টার ফর পাবলিক ইনটিগ্রিটি’-র ক্রিস হামবি জেতেন এই পুরস্কার৷ কয়লা খনির শ্রমিকদের ফুসফুসের রোগ নিয়ে কয়েকজন আইনজীবী ও চিকিৎসকের প্রতারণার চিত্র তুলে ধরেছিলেন তার প্রতিবেদনে৷ যার ফলে ঐ আইনজীবী ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
২০১৫ সাল
এ বছর দুইজন জিতেছেন এই পুরস্কার৷ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর এরিক লিপটন কংগ্রেস নেতা ও অ্যাটর্নি জেনারেলদের লবিস্টরা তাদের কতটা প্রভাবিত করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের জন্য এবং ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর এক প্রতিনিধির স্বাস্থ্য সেবা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের জন্য৷
ছবি: Imago/Rüdiger Wölk
২০১৬ সাল
চলতি বছরে ‘ট্যাম্পা বে টাইমস’-এর লিওনোরা লাপিটার ও অ্যান্থনি কর্মিয়ার এবং ‘দ্য সারাসোতা হেরাল্ড ট্রিবিউন’-এর মাইকেল ব্রাগা জিতেছেন এই পুরস্কার৷ ফ্লোরিডা মানসিক হাসপাতালের অবহেলার অমানবিক চিত্র ফুটে উঠেছিল তাদের প্রতিবেদনে৷
ছবি: The Pulitzer Prizes Columbia University
11 ছবি1 | 11
আমি অবশ্য সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলবের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানাই৷ সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়াদেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, সাংবাদিকদের হিসাব চাইলে আপত্তি কোথায়, তাদের হিসাব দিতে সমস্যা কোথায়, তারা কি আইনের উর্ধ্বে? আমি তাদের সাথে একমত৷ সাংবাদিকেরা কখনোই আইনের উর্ধ্বে নন৷ সরকার চাইলে যে কারো হিসাব তলব করতে পারে, আয়-ব্যয় না মিললে মামলা করতে পারে৷ আর বিএফআইইউ সরাসরি নেতাদের কাছে হিসাব চায়নি, চেয়েছে ব্যাংকগুলোর কাছে৷ তাই এখানে নেতাদের চাওয়া না চাওয়া, হিসাব দেয়া না দেয়ার কোনো বিষয় নেই৷
কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্যখানে৷ স্বাগত জানালেও বিএফআইইউ এর এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার সংশয় আছে৷ প্রথম সংশয় হলো, ১১ সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাব তলব সমাজে সাংবাদিকদের সম্পর্কে নেতিবাচক পারসেপশনে প্রায় বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি দেবে৷ লোকজন বলাবলি করছে, আগেই বলেছিলাম, সাংবাদিকেরা ভালো নয়৷ এবার তো প্রমাণ হল৷ যদিও এখনও কিছুই প্রমাণিত হয়নি৷ মাত্র হিসাব চাওয়া হয়েছে৷ বাংলাদেশে কারো হিসাব তলব করা মানেই, সবাই ধরে নেবেন, ডালমে কুছ কালা হ্যায়৷ কোনোকিছু প্রমাণের আগেই ১১ সাংবাদিক নেতাকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করা হলো৷ আর শুধু ১১ নেতা নয়, এ সিদ্ধান্ত গোটা সাংবাদিক সমাজ সম্পর্কেই বাজে ধারণার স্রোতকে আরো প্রবল করবে৷ বাংলাদেশে ভালো বেতন পায়, এমন সাংবাদিক যেমন আছেন; আবার নামমাত্র বেতন, তাও মাসের পর মাস বকেয়া, এমন সাংবাদিকও আছেন৷ অল্প সময়েই টাকার পাহাড় বানিয়ে অসৎ সাংবাদিক যেমন আছেন, আবার সুযোগ সত্ত্বেও দুর্নীতির ফাঁদে পা না দিয়ে কষ্টে-সৃষ্টে জীবনযাপন করছেন, এমন সাংবাদিকও আছেন৷ এই সিদ্ধান্ত সবাইকেই কমবেশি হেয় করবে৷ তবে হেয় হতেও আমার আপত্তি নেই৷ যদি সরকার দুর্নীতিবাজ সাংবাদিকদের চিহ্নিত করতে কোনো চিরুনি অভিযান চালায়, আমি আরো বেশি স্বাগত জানাব৷ সরকার তালিকা করে ৫০০ বা এক হাজার সাংবাদিকের হিসাব তলব করুক৷ সমস্যা নেই৷ কিন্তু এ তলবকে তেমন কোনো অভিযান মনে হচ্ছে না৷ বিএফআইইউ ঢালাওভাবে ছয়টি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে৷ এটা সত্যি বিস্ময়কর৷ দুর্নীতিবাজ সাংবাদিক নেতা হতেও পারেন, নাও হতে পারেন৷ দুর্নীতি করাটা নেতা হওয়ার পূর্বশর্তও নয়, সমান্তরালও নয়৷ সরকারের কাছে যদি সাংবাদিক নেতাদের কারো ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য থাকতো, যদি তেমন কারো হিসাব তলব করতো; তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না৷ কিন্তু ঢালাও নেতাদের হিসাব তলব পুরো প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাই নষ্ট করে দিয়েছে৷ যাদের হিসাব তলব করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সরকার সমর্থক যেমন আছেন, সরকার বিরোধীরাও আছেন৷ দুইপক্ষ মিলে কোনো দুর্নীতি করেছে, সেটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়৷ যদি এমন হতো, দেশের সকল পেশাজীবী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের হিসাব তলব করা হচ্ছে৷ তাহলে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো আলোচনারই সুযোগ থাকতো না৷ আবার সাংবাদিক নেতাদের হিসাব চাইতে হলে, আগে অন্য সংগঠনের নেতাদেরও হিসাব তলব করতে হবে; তেমন অন্যায় আবদারও করছি না আমি৷ খালি বলতে চাই, সন্দেহ করার মত সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকার যে কারো হিসাব চাইতে পারে৷ কিন্তু সন্দেহ করার মত তথ্যটা কী সেটাই আমরা জানতে পারছি না৷
সাংবাদিকতার নৈতিক দিকগুলো মনে করায় যারা
সাংবাদিকতার সঙ্গে নৈতিকতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ একক কোনো সংস্থা না থাকলেও আন্তর্জাতিক একাধিক সংগঠন আছে যারা সাংবাদিকতার নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা রেখে আসছে৷ কয়েকটি উদ্যোগের কথা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images/H. Peters
এথিক্যাল জার্নালিজম নেটওয়ার্ক
ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ৭০ জন সাংবাদিক, সম্পাদক, গণমাধ্যম মালিক, মিডিয়া সাপোর্ট গ্রুপের সমন্বয়ে এই নেটওয়ার্কটি গড়ে উঠেছে৷ বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকতার ধরন, নৈতিকতা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে হালনাগাদ প্রকাশনা ও তথ্য আছে তাদের ওয়েবসাইটে৷ আছে প্রশিক্ষণের সুযোগ, রিপোর্টিং টুলকিটসহ অনেক কিছু৷ আরো জানতে প্লাস (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: ethicaljournalismnetwork.org
অ্যাকাউন্টেবল জার্নালিজম
বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের কোডস অব কন্ডাক্ট এবং প্রেস কাউন্সিলগুলোর সবচেয়ে বড় তথ্য ভাণ্ডার হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ২০০২ সালে এই উদ্যোগটি যাত্রা করে৷ এটি এথিক্যাল জার্নালিজম নেটওয়ার্কেরই একটি সহযোগী প্রকল্প৷ তাদের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেস কাউন্সিল, প্রেস ক্লাব, সরকার ও বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা মিলিয়ে ৪০০-রও বেশি কোড অব কন্ডাক্ট বা বিধিমালা আছে৷
ছবি: accountablejournalism.org
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার
গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার সাংবাদিকতার মান উন্নয়ন ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর লক্ষ্যেও কাজ করছে৷ এজন্য ইউরোপীয় সম্প্রচার কমিশন, এএফপি ও গ্লোবাল এডিটর্স নেটওয়ার্কের সহযোগিতায় ২০১৯ সালে ‘জার্নালিজম ট্রান্স ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি উদ্যোগ শুরু করে৷ গণমাধ্যমগুলো কতটা মানসম্মত ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে কাজ করে সেটি স্বেচ্ছায় মূল্যায়নের পদ্ধতি গড়ে তোলা এর উদ্দেশ্য৷
ছবি: rsf.org
ওএনও
পুরো নাম দ্য অর্গনাইজশেন অফ নিউজ অমবাডসমেন অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস এডিটরস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদ সংশ্লিষ্ট অভিযোগ নিষ্পত্তির দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি ও সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের প্রতিনিধিত্ব করে এই সংস্থাটি। ওএনও -র উদ্দশ্যে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পৃষ্ঠপোষকতা, স্বচ্ছতার উপর জোর দেয়ার মাধ্যমে গণমাধ্যমের উপর পাঠক-দর্শকের আস্থা বাড়ানো। উদ্দেশ্য পূরণে প্রতিবছর সদস্যদের নিয়ে সম্মেলন করে সংগঠনটি।
ছবি: newsombudsmen.org
গ্লোবাল চার্টার ফর এথিকস ফর জার্নালিস্ট
১৪০ টি দেশের ১৮৭ টি ট্রেড ইউনিয়ন ও অ্যাসোসিয়েশনের ছয় লাখ গণমাধ্যমকর্মীর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস বা আইএফজে। ২০১৯ সালে আইএফজে -র ৩০তম সম্মেলনে গ্লোবাল চার্টার অব এথিকস ফর জার্নালিস্টস ঘোষণা করা হয়। একটি প্রস্তাবনা ও ১৬ টি অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নৈতিকতা বিষয়ে সাংবাদিকদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে এই চার্টারে।
ছবি: ifj.org
এসপিজে
সোসাইটি অব প্রফেশনাল জার্নালিস্টস বা সংক্ষেপে এসপিজে নামে পরিচিত। এটি যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বকারী পুরনো একটি সংগঠন। মার্কিন সংবিধানের ফাস্ট অ্যামেন্ডমেন্টে বর্ণিত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার পাশাপাশি সাংবাদিকতার সর্বোত্তম চর্চা, সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে তারা। ১৯৭৩ সালে সংগঠনটি প্রথম নিজেদের কোড অব এথিকস প্রণয়ন করে, যেটি সবশেষ ২০১৪ সালে সংশোধন করা হয়েছে।
ছবি: spj.org
6 ছবি1 | 6
আরেকটা ভয়ংকর বিষয় হলো, যে ইউনিট হিসাব তলব করেছে মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর অস্ত্রের বিস্তার রোধকল্পে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ব্যাংকিং হিসাব–নিকাশের অনুসন্ধান করে এবং প্রাপ্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে জানায়৷ তাহলে বিএফআইউ বা যে সংস্থা তথ্য চেয়েছে, তারা কি সন্দেহ করছেন, সাংবাদিক নেতাদের কেউ মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মত অস্ত্রের বিস্তারের সাথে জড়িত৷ তেমন গুরুতর কিছু হলে সেই সংস্থার উচিত প্রাথমিক তদন্ত শেষে সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করে শুধু তাদের হিসাব তলব করা, তিনি নেতা হোন আর না হোন৷ ঢালাওভাবে নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করে, পুরো প্রক্রিয়াটিকে বিতর্কিত করা হচ্ছে; তাতে সত্যিই কোনো অপরাধী থাকলে তিনিও পার পেয়ে যেতে পারেন৷
এমনিতে বাংলাদেশে এখন সরকার সমর্থিত বা স্বেচ্ছা সমর্পিত সাংবাদিকের সংখ্যাই বেশি৷ করে নাকো ফোসফাস, মারে নাকো ঢুসঢাস মার্কা সব৷ তারপরও সরকার বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করতে নানা আইন করে৷ ১১ নেতার ব্যাংক হিসাব তলবকেও অনেকে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন৷ তবে তথ্যমন্ত্রী, সেতুমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ নীতিনির্ধারকদের কথায় মনে হচ্ছে, তারা কিছুই জানেন না৷ তাহলে বিএফআইইউ কার নির্দেশে এত বড় সিদ্ধান্ত নিলো৷ আবার কারো ব্যাংক হিসাব তলব করতে মন্ত্রীদের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তেমনও নয়৷ বারবার যেটা বলতে চাইছি, ব্যাংক হিসাব তলব করার আগে প্রাথিমক তদন্ত এবং সন্দেহ করার মত তথ্য থাকতে হবে৷ বিএফআইইউ যদি একমাস পর জানায়, কারো একাউন্টে কোনো সমস্যা নেই৷ তাহলেই কি মিটে যাবে বিষয়টা? সবকিছু এত সরল নয়৷ ১১ নেতা যদি তখন বলেন, এই একমাস যে আমাদের সামাজিকভাকে হেয় করা হলো, তার জবাব কী? অতীতে অনেক ব্যক্তি বিচারের আগেই সামাজিক পারসেপশন আর মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়েছেন৷ এবার সাংবাদিক নেতারা পরলেন সেই গাড্ডায়৷
প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও লেখক ছবি: DW/S. Hossain
বাংলাদেশের সব সমস্যা সমাধানের ভার আমরা একজনের কাছেই ঠেলে দিই৷ সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলবের বিষয়টি মেটানোর বলও প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে ঠেলে দেয়া হয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি দেখবেন, এই আশ্বাসে আপাতত সাংবাদিকরা তাদের কর্মসূচি স্থগিত রেখেছেন৷ কিন্তু আমার কৌতূহল, প্রধানমন্ত্রী কী সমাধান দেবেন৷ যে বা যারা সিদ্ধান্তটি নিয়েছেনন, তারা খুব কৌশলে নিয়েছেন৷ সাংবাদিকদের দাবি মেনে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্তটি স্থগিত বা প্রত্যাহার করলেন; তাতেই কি সব মিটে যাবে? বিষয়টা কিন্তু অত সরল নয়৷ তখন সবাই বলবে, নিশ্চয়ই সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে কোনো ঘাপলা ছিল, নইলে হিসাব দিতে তাদের সমস্যা কোথায়?
ব্যাংক হিসাব তলবের সিদ্ধান্ত স্থগিত বা প্রত্যাহার নয়; আমি বরং দাবি করছি তলব করা ব্যাংক হিসাব প্রকাশ করা হোক৷ আমরা দেখতে চাই, আমাদের নেতারা কতটা সৎ? আমরা তাদের নিয়ে গর্ব করতে চাই৷ পাশাপাশি দাবি করছি, প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি, বিএফইউজে, ডিইউজেসহ সাংবাদিকদের সকল প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে নির্বাচন করতে হলে, সবাইকে তার সম্পদের হিসাব জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হোক৷ অন্য মানুষের দুর্নীতি, নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করতে হবে৷ সাংবাদিক মানেই ধান্ধাবাজ, চাঁদাবাজ এই পারসেপশন বদলে আমরা উচ্চ নৈতিকতা নিয়ে মাথা উচু করে নিজেদের পেশায় মনোনিবেশ করতে চাই৷ সাংবাদিকরা হবে উচ্চ নৈতিকতার আর সাংবাদিক নেতারা হবেন সুউচ্চ নৈতিকতার, যেন কেউ আর আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলতে না পারে৷