টার্গেট সাংবাদিক না সাংবাদিকতা
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অফিস বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আর নয়াপল্টনে৷ অধিকাংশ বাম দলের অফিস তোপখানা এলাকায়৷ খেলার অধিকাংশ খবর মেলে স্টেডিয়ামে৷ আর ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতির খবরের জন্য যেতে হয় মতিঝিলে৷ প্রেসক্লাবের সামনে বছরজুড়ে চলে দাবি-দাওয়ার সমাবেশ৷ এখন তো মাঠে রাজনীতি নেই৷ যখন ছিল, তখন পল্টন ময়দান, মুক্তাঙ্গন, জিরো পয়েন্ট, পল্টন, তোপখানা এলাকা সবসময় মুখরিত থাকত৷ লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া সব মিলে জমজমাট এলাকা৷ তখন নিয়মিত যেতে হতো৷ কিন্তু তখন প্রেসক্লাব থাকলেও রিপোর্টার্স ইউনিটি ছিল না৷ ১৯৯৬ সালে রিপোর্টার্স ইউনিটি শুরু হলেও আজকের মত জমজমাট হয়নি৷ তাই মাঠে কাজ করতে গিয়ে আমাদের নানা ঝামেলায় পরতে হতো৷ রাস্তার পাশের সস্তা হোটেলে খেতে হতো৷ তবে সবচেয়ে বেশি বিপদে পরতাম ঝড়-বৃষ্টিতে আর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে৷ তখন আমরা ‘অসভ্য’ ছিলাম, তাই প্রেসক্লাবে ঢুকতে পারতাম না, এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার মত জরুরি কাজেও না৷ রাস্তার উল্টোপাশে আরেক পেশাজীবী সংগঠনের কার্যালয় বিএমএ ভবনে তবু যাওয়া যেতো, প্রেসক্লাবে নয়৷ শুধু প্রেসক্লাবে ঢোকা নয়, সভ্য হওয়ার পথটিও রুদ্ধ ছিল ‘ব্ল্যাক বল’ নামের এক কালো আইনে৷ সেই দিন আর এখন নেই৷ প্রেসক্লাবের সভ্য হয়েছি, তাও অনেক বছর আগে৷ কিন্তু এখন আর প্রেসক্লাব বা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে যাওয়ার সময় পাই না৷
শুরুর দিকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি সংগঠন করারও খুব আগ্রহ ছিল৷ নব্বই দশকের শুরুর দিকে বাংলাবাজার পত্রিকার ইউনিটে খুব সক্রিয় ছিলাম৷ বিএফইউজে, ডিইউজের সব কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতাম৷ প্রেসক্লাবের সদস্যপদ উন্মুক্ত করার দাবির আন্দোলনেও অংশ নিয়েছি৷ একবার রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচনে অংশ নিয়ে সদস্যও হয়েছিলাম৷ কিন্তু পেশাগত ব্যস্ততায় সেই রাজনীতি আর করা হয়নি৷ তবে আমি সারাবছর যেতে পরি আর না পারি, নির্বাচনের সময় অবশ্যই ভোট দিতে যাই৷ প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি, বিএফইউজে, ডিইউজে মিলে ভোট দিতে যেতে হয় ৪/৫ বার, তাতে অনেকের সাথে দেখা হয়ে যায়৷ তবে দেখা হওয়ার জন্য নয়, আমি আসলে যাই সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা যাতে নির্বাচিত হতে পারে৷ সবসময় যে আমার পছন্দের প্রার্থীই জয় পান, তা নয়; তবে আমি আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকি যে আমি একজন সৎ মানুষকে ভোট দিয়েছি৷ নিশ্চিত হারবেন জেনেও আমি সৎ ও যোগ্য মানুষকে ভোট দেই৷ তবে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন নিয়ে যেসব কাণ্ডকারখানা হয়, তাতে আমার অনেক প্রশ্নের জবাব পাই না৷ সাংবাদিকদের নেতৃত্ব দৃশ্যত কোনো লাভজনক পদ নয়৷ কিন্তু বড় বড় পদে নির্বাচনের ব্যয় সম্পর্কে যা শুনি, তা আমার কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে যায়৷ কারো কারো একবারের নির্বাচনের যত ব্যয় শুনি, তা থাকলে আমার সারাজীবনের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যেত৷ এত পরিশ্রম করে, এত ব্যয় করে তারা কেন নেতা নির্বাচিত হতে চান? এই প্রশ্নের জবাব আমি জানি না৷
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচন হয় প্রতিবছর ৩০ নভেম্বর৷ ২০১৭ সালের নির্বাচিত কমিটিকে স্বাগত জানিয়ে আমি একটি লেখা লিখেছিলাম৷ ‘নেতা চাই, চাঁদা আদায়কারী নয়’ শিরোনামের লেখাটি থেকে একটু উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ‘রিপোর্টার্স ইউনিটিতে নিয়মিত যাওয়া আসা করেন, এমন একজন জানালেন, রিপোর্টার্স ইউনিটির বছরে খরচ প্লাস মাইনাস তিন কোটি টাকা৷ ক্যান্টিনে সাবসিডি রেটে খাওয়া, পিকনিক ইত্যাদিতে বড় খরচ হয়৷ হল ভাড়া থেকে আয় হয় এক কোটি টাকা৷ বাকি টাকাটা আসে কোত্থেকে?
তিনি জানালেন, বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুদান থেকে৷ তিনি অনুদান বললেন বটে, তবে আমি শুনলাম চাঁদা৷ আসলে চাঁদাই তো৷ নইলে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কেন বছরের পর বছর রিপোর্টার্স ইউনিটিকে অনুদান দেবে৷ মানুষ মসজিদে বা মাদ্রাসায় টাকা দেয় সওয়াবের আশায়৷ রিপোর্টার্স ইউনিটিকে টাকা দিয়ে তো অশেষ নেকি হাসিল হবে না৷ সহজ কথা হলো, এসব প্রতিষ্ঠান রিপোর্টারদের হাতে রাখতে চায় বলেই তাদের টাকা দেয়৷ অনুদান কত হবে, সেটা নির্ভর করে রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারির দক্ষতার ওপর৷ যিনি যত বেশি অনুদান বা চাঁদা আনতে পারবেন, তিনি তত সফল৷ আমরা আসলে ভোট দিয়ে চাঁদাবাজ নির্বাচিত করি৷ তবে তিনি দাবি করলেন, এখন অনুদান নেওয়া হয় স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, চেকের মাধ্যমে৷ ধরে নিচ্ছি, আমরা যাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করছি, তারা ব্যক্তিগতভাবে সৎ৷ কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে ডিআরইউর সততা কিন্তু আমরাই প্রতিদিন প্রশ্নের মুখে ফেলছি৷ নেতাদের সততা নিয়ে সন্দেহ নেই৷ তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায়, এত টাকা খরচ করে তারা নেতা হতে চান কেন?’
জাতীয় প্রেসক্লাবের ক্যান্টিনেও ভর্তুকি মূল্যে খাবার পাওয়া যায়, বড় আয়োজনের পিকনিক হয়; তারমানে প্রেসক্লাবকেও অনুদানের নামে চাঁদার টাকায় ঘাটতি পোষাতে হয়৷ আমি সত্যিই জানি না, এত অর্থ ব্যয় করে ঘাটতিতে থাকা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে কেন আসতে চান সবাই৷ নেতৃত্বের আকাঙ্খা, সামাজিক মর্যাদা নাকি অন্য কিছু?
আগে সমাজে সাংবাদিকদের উচ্চ মর্যাদা ছিল৷ সাংবাদিকদের সবাই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা মেশানো সমীহ করতো৷ গত কয়েক বছরে সামাজিক পারসেপশনটা পাল্টে গেছে৷ এখনও সাধারন মানুষ সাংবাদিকদের সমীহ করে বটে, তবে তাতে ভালোবাসা-শ্রদ্ধার চেয়ে ভয় মেশানো থাকে বেশি৷ মনে করা হয়, সাংবাদিকদের মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা আছে৷ এ কারণে অনেক বাড়িওয়ালা সাংবাদিকদের বাড়ি ভাড়া দিতে চান না৷ সাধারণভাবে সাংবাদিকদের নৈতিকতা এবং সততা প্রশ্নবিদ্ধ৷ সাধারণ মানুষ মনে করে, সাংবাদিকেরা বেতনকড়ি পায় না৷ তারা ধান্ধাবাজি বা চাঁদাবাজি করেন৷ তাদের ধারণা, সাংবাদিকরা সরকারের দালালি করে এবং বিনিময়ে সরকার তাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়৷ প্রথম কথা হলো, বাংলাদেশের সব খাতই এখন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত৷ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে৷ সাংবাদিকরাও এই সমাজেই বাস করে৷ তাই সাংবাদিকদের কারো কারো আয়ের সাথে ব্যয় নাও মিলতে পারে৷ বাড়ি, গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, শান শওকত দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না; শুধু সাংবাদিকতায় সম্ভব নয় এতকিছু৷ তবে সাংবাদিকদের সম্পর্কে সামাজিক পারসেপশনে একটা বড় রকমের গলদ আছে৷ মানুষের সাথে কথা বললেই মনে হয়, সৎ সাংবাদিক মানেই তিনি বস্তিতে থাকবেন, রিকশায় চড়বেন৷ কদিন আগে আমি অফিসে যাওয়ার সময় মেসেঞ্জারে একজন কল দিলেন৷ ধরে বললাম, আমি গাড়ি চালাচ্ছি, পরে ফোন দেবো৷ আমি গাড়ি চালাচ্ছি শুনে ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পরলেন৷ তার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হলো, গাড়িটি আমি সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কোনো শোরুম থেকে এইমাত্র ডাকাতি করে এনেছি৷ অথচ গত ২০ বছর ধরেই আমি অফিস থেকে চালকসহ সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা পেয়ে আসছি৷ শুধু আমি নই, ঢাকায় এমন শখানেক সাংবাদিক আছেন, যারা অফিসের দেয়া গাড়ি ব্যবহার করেন৷ লাখ টাকার ওপর বেতন পান, এমন সাংবাদিকের সংখ্যাও অনেক যাবে৷ কোনো সাংবাদিকের গাড়ি-বাড়ি আছে শুনলেই, তাকে অসৎ মনে করার কোনো কারণ নেই৷ ২৫/৩০ বছর ভালো প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা করলে, একটু হিসাব করে চললে; ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একটা ফ্ল্যাট বা গাড়ি কেনা সম্ভব৷ সাংবাদিকদের সম্পর্কে এই ভুল পারসেপশনে সুকৌশলে ঘি ঢেলেছে সরকার৷ সম্প্রতি সরকারের একটি সংস্থার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বাংলাদেশের ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়ে ১১ সাংবাদিক নেতার বিস্তারিত হিসাব চেয়েছে৷ চিঠিতে বিস্তারিত হিসাব মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে৷ বিএফআইইউ প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং দুইভাগে বিভক্ত বিএফইউজে এবং ডিইউজের শীর্ষ নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে৷ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এ সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবি জানাচ্ছেন৷ তবে যাদের হিসাব চাওয়া হয়েছে, তাদের অধিকাংশই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন৷ যদিও এখন তারা সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেন৷ সবাই এখন এর বিরোধিতাই করছেন৷
আমি অবশ্য সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলবের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানাই৷ সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়াদেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, সাংবাদিকদের হিসাব চাইলে আপত্তি কোথায়, তাদের হিসাব দিতে সমস্যা কোথায়, তারা কি আইনের উর্ধ্বে? আমি তাদের সাথে একমত৷ সাংবাদিকেরা কখনোই আইনের উর্ধ্বে নন৷ সরকার চাইলে যে কারো হিসাব তলব করতে পারে, আয়-ব্যয় না মিললে মামলা করতে পারে৷ আর বিএফআইইউ সরাসরি নেতাদের কাছে হিসাব চায়নি, চেয়েছে ব্যাংকগুলোর কাছে৷ তাই এখানে নেতাদের চাওয়া না চাওয়া, হিসাব দেয়া না দেয়ার কোনো বিষয় নেই৷
কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্যখানে৷ স্বাগত জানালেও বিএফআইইউ এর এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার সংশয় আছে৷ প্রথম সংশয় হলো, ১১ সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাব তলব সমাজে সাংবাদিকদের সম্পর্কে নেতিবাচক পারসেপশনে প্রায় বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি দেবে৷ লোকজন বলাবলি করছে, আগেই বলেছিলাম, সাংবাদিকেরা ভালো নয়৷ এবার তো প্রমাণ হল৷ যদিও এখনও কিছুই প্রমাণিত হয়নি৷ মাত্র হিসাব চাওয়া হয়েছে৷ বাংলাদেশে কারো হিসাব তলব করা মানেই, সবাই ধরে নেবেন, ডালমে কুছ কালা হ্যায়৷ কোনোকিছু প্রমাণের আগেই ১১ সাংবাদিক নেতাকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করা হলো৷ আর শুধু ১১ নেতা নয়, এ সিদ্ধান্ত গোটা সাংবাদিক সমাজ সম্পর্কেই বাজে ধারণার স্রোতকে আরো প্রবল করবে৷ বাংলাদেশে ভালো বেতন পায়, এমন সাংবাদিক যেমন আছেন; আবার নামমাত্র বেতন, তাও মাসের পর মাস বকেয়া, এমন সাংবাদিকও আছেন৷ অল্প সময়েই টাকার পাহাড় বানিয়ে অসৎ সাংবাদিক যেমন আছেন, আবার সুযোগ সত্ত্বেও দুর্নীতির ফাঁদে পা না দিয়ে কষ্টে-সৃষ্টে জীবনযাপন করছেন, এমন সাংবাদিকও আছেন৷ এই সিদ্ধান্ত সবাইকেই কমবেশি হেয় করবে৷ তবে হেয় হতেও আমার আপত্তি নেই৷ যদি সরকার দুর্নীতিবাজ সাংবাদিকদের চিহ্নিত করতে কোনো চিরুনি অভিযান চালায়, আমি আরো বেশি স্বাগত জানাব৷ সরকার তালিকা করে ৫০০ বা এক হাজার সাংবাদিকের হিসাব তলব করুক৷ সমস্যা নেই৷ কিন্তু এ তলবকে তেমন কোনো অভিযান মনে হচ্ছে না৷ বিএফআইইউ ঢালাওভাবে ছয়টি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে৷ এটা সত্যি বিস্ময়কর৷ দুর্নীতিবাজ সাংবাদিক নেতা হতেও পারেন, নাও হতে পারেন৷ দুর্নীতি করাটা নেতা হওয়ার পূর্বশর্তও নয়, সমান্তরালও নয়৷ সরকারের কাছে যদি সাংবাদিক নেতাদের কারো ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য থাকতো, যদি তেমন কারো হিসাব তলব করতো; তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না৷ কিন্তু ঢালাও নেতাদের হিসাব তলব পুরো প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাই নষ্ট করে দিয়েছে৷ যাদের হিসাব তলব করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সরকার সমর্থক যেমন আছেন, সরকার বিরোধীরাও আছেন৷ দুইপক্ষ মিলে কোনো দুর্নীতি করেছে, সেটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়৷ যদি এমন হতো, দেশের সকল পেশাজীবী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের হিসাব তলব করা হচ্ছে৷ তাহলে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো আলোচনারই সুযোগ থাকতো না৷ আবার সাংবাদিক নেতাদের হিসাব চাইতে হলে, আগে অন্য সংগঠনের নেতাদেরও হিসাব তলব করতে হবে; তেমন অন্যায় আবদারও করছি না আমি৷ খালি বলতে চাই, সন্দেহ করার মত সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকার যে কারো হিসাব চাইতে পারে৷ কিন্তু সন্দেহ করার মত তথ্যটা কী সেটাই আমরা জানতে পারছি না৷
আরেকটা ভয়ংকর বিষয় হলো, যে ইউনিট হিসাব তলব করেছে মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর অস্ত্রের বিস্তার রোধকল্পে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ব্যাংকিং হিসাব–নিকাশের অনুসন্ধান করে এবং প্রাপ্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে জানায়৷ তাহলে বিএফআইউ বা যে সংস্থা তথ্য চেয়েছে, তারা কি সন্দেহ করছেন, সাংবাদিক নেতাদের কেউ মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মত অস্ত্রের বিস্তারের সাথে জড়িত৷ তেমন গুরুতর কিছু হলে সেই সংস্থার উচিত প্রাথমিক তদন্ত শেষে সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করে শুধু তাদের হিসাব তলব করা, তিনি নেতা হোন আর না হোন৷ ঢালাওভাবে নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করে, পুরো প্রক্রিয়াটিকে বিতর্কিত করা হচ্ছে; তাতে সত্যিই কোনো অপরাধী থাকলে তিনিও পার পেয়ে যেতে পারেন৷
এমনিতে বাংলাদেশে এখন সরকার সমর্থিত বা স্বেচ্ছা সমর্পিত সাংবাদিকের সংখ্যাই বেশি৷ করে নাকো ফোসফাস, মারে নাকো ঢুসঢাস মার্কা সব৷ তারপরও সরকার বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করতে নানা আইন করে৷ ১১ নেতার ব্যাংক হিসাব তলবকেও অনেকে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন৷ তবে তথ্যমন্ত্রী, সেতুমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ নীতিনির্ধারকদের কথায় মনে হচ্ছে, তারা কিছুই জানেন না৷ তাহলে বিএফআইইউ কার নির্দেশে এত বড় সিদ্ধান্ত নিলো৷ আবার কারো ব্যাংক হিসাব তলব করতে মন্ত্রীদের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তেমনও নয়৷ বারবার যেটা বলতে চাইছি, ব্যাংক হিসাব তলব করার আগে প্রাথিমক তদন্ত এবং সন্দেহ করার মত তথ্য থাকতে হবে৷ বিএফআইইউ যদি একমাস পর জানায়, কারো একাউন্টে কোনো সমস্যা নেই৷ তাহলেই কি মিটে যাবে বিষয়টা? সবকিছু এত সরল নয়৷ ১১ নেতা যদি তখন বলেন, এই একমাস যে আমাদের সামাজিকভাকে হেয় করা হলো, তার জবাব কী? অতীতে অনেক ব্যক্তি বিচারের আগেই সামাজিক পারসেপশন আর মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়েছেন৷ এবার সাংবাদিক নেতারা পরলেন সেই গাড্ডায়৷
বাংলাদেশের সব সমস্যা সমাধানের ভার আমরা একজনের কাছেই ঠেলে দিই৷ সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলবের বিষয়টি মেটানোর বলও প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে ঠেলে দেয়া হয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি দেখবেন, এই আশ্বাসে আপাতত সাংবাদিকরা তাদের কর্মসূচি স্থগিত রেখেছেন৷ কিন্তু আমার কৌতূহল, প্রধানমন্ত্রী কী সমাধান দেবেন৷ যে বা যারা সিদ্ধান্তটি নিয়েছেনন, তারা খুব কৌশলে নিয়েছেন৷ সাংবাদিকদের দাবি মেনে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্তটি স্থগিত বা প্রত্যাহার করলেন; তাতেই কি সব মিটে যাবে? বিষয়টা কিন্তু অত সরল নয়৷ তখন সবাই বলবে, নিশ্চয়ই সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে কোনো ঘাপলা ছিল, নইলে হিসাব দিতে তাদের সমস্যা কোথায়?
ব্যাংক হিসাব তলবের সিদ্ধান্ত স্থগিত বা প্রত্যাহার নয়; আমি বরং দাবি করছি তলব করা ব্যাংক হিসাব প্রকাশ করা হোক৷ আমরা দেখতে চাই, আমাদের নেতারা কতটা সৎ? আমরা তাদের নিয়ে গর্ব করতে চাই৷ পাশাপাশি দাবি করছি, প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি, বিএফইউজে, ডিইউজেসহ সাংবাদিকদের সকল প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে নির্বাচন করতে হলে, সবাইকে তার সম্পদের হিসাব জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হোক৷ অন্য মানুষের দুর্নীতি, নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করতে হবে৷ সাংবাদিক মানেই ধান্ধাবাজ, চাঁদাবাজ এই পারসেপশন বদলে আমরা উচ্চ নৈতিকতা নিয়ে মাথা উচু করে নিজেদের পেশায় মনোনিবেশ করতে চাই৷ সাংবাদিকরা হবে উচ্চ নৈতিকতার আর সাংবাদিক নেতারা হবেন সুউচ্চ নৈতিকতার, যেন কেউ আর আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলতে না পারে৷