বাংলাদেশ করোনা টিকা যুগে প্রবেশ করেছে৷ প্রথম দিন ২৭ জনকে টিকা দেয়া হয়েছে, দ্বিতীয় দিনে ৫০০ স্বাস্থ্যকর্মীকে৷ আর পুরোদমে দেয়া শুরু হবে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে৷
বিজ্ঞাপন
আর এর সাথে এই টিকা নিয়ে রাজনীতিও তীব্র হচ্ছে৷ এই রাজনীতিতে কার লাভ, কার ক্ষতি?
সর্বশেষ বিতর্কের জন্ম দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী৷ তিনি দাবি করেন প্রথম করোনার টিকা নিতে হবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর৷ এর আগে অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনা টিকা কারা আগে পাবেন তা নিয়ে ভুয়া একটি তালিকা ছড়িয়ে পড়ে৷ তাতে মন্ত্রী-এমপিদের অগ্রাধিকার তালিকায় রেখে সেটা ভাইরাল করা হয়৷ তখনও ওই ভুয়া তালিকা ধরে রাজনীতির মাঠ বেশ গরম হয়েছে৷ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে করোনা টিকা কেন নেয়া হলো সেটা নিয়েও রাজনীতি আছে৷ এই টিকা অক্সফোর্ডেরহলেও এটাকে ভারতীয় ভ্যাকসিন বলেও চলছে নানা কথা৷
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেই দিয়েছেন যে ভারতের ভ্যাকসিনে তাদের আস্থা নাই৷ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে আগে ভ্যাকসিন দেয়ার নেয়ার আহ্বান জানান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী৷ তার ওই আহ্বানের জবাবে তথ্যমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ, বিএনপিকে আগে টিকা দেয়ার প্রস্তাব করেন৷
আর ডা, জাফরুল্লাহ চৌধুরী বেসরকারি পর্যায়ে টিকা দেয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলেন, ‘‘বুড়িগঙ্গার পানি বা মুরগির টিকা দিয়ে দেবে কিনা তার কোনো গ্যারান্টি নাই৷''
করোনার টিকা কার্যক্রম শুরু
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে টিকা প্রদান কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন৷ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে প্রথমদিন মোট ২৭ জনকে টিকা দেয়া হয়েছে৷
ছবি: facebook.com/ATNNews
প্রথম টিকা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে টিকা প্রদান কার্যক্রম উদ্বোধন করেন৷ তার উপস্থিতিতে পাঁচজনকে টিকা দেয়া হয়৷ প্রথম টিকা নেন কুর্মিটোলা হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু বেরোনিকা কস্তা৷ এরপর টিকা নেন মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. আহমেদ লুৎফর মবিন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপিকা নাসিমা সুলতানা, ট্রাফিক পুলিশ মো: দিদারুল ইসলাম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম ইমরান হামিদ৷
ছবি: facebook.com/ATNNews
সাহস দেন প্রধানমন্ত্রী
প্রথম টিকা নেয়া রুনুকে প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি ভয় পাচ্ছো না তো?’ তখন রুন মাথা নেড়ে জানিয়ে দেন, তিনি ভয় পাচ্ছেননা৷ এরপর প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেন, ‘তুমি সাহসি মেয়ে’৷ টিকা দেয়া শেষে প্রধানমন্ত্রী হাততালি দিয়ে তার সুস্থতা কামনা করেন৷ এভাবে বাকি চারজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের ‘রিলাক্স’ করার চেষ্টা করেন প্রধানমন্ত্রী৷ এছাড়া যারা টিকা প্রয়োগের কাজে ছিলেন তাদেরকে তিনি ‘মাসল লুজ’ করারও পরামর্শ দেন৷
ছবি: facebook.com/ATNNews
‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’
টিকা নেয়া শেষে কেউ হাত তুলে, কেউ সালাম দিয়ে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জয় বাংলা’ বলেন৷
ছবি: facebook.com/ATNNews
মোট ২৭ জন
প্রথমদিন মোট ২৭ জনকে টিকা দেয়া হয়৷ আগামীকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার পাঁচ হাসপাতালের ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে৷ ছবিতে তেজগাঁও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধীনে সাব-সেন্টারে কাজ করা ডাঃ দেওয়ান মোঃ হেমায়েত হোসেইনকে টিকা নিতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সারা দেশে শুরু ৭ ফেব্রুয়ারি
বাংলাদেশে যেহেতু করোনা টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়নি তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী প্রথমে টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষণ করা হবে৷ সব ঠিক থাকলে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অবজারভেশন রুম
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে টিকা নেয়া ব্যক্তিদের পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য একটি আলাদা কক্ষ ঠিক করা হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নিবন্ধন প্রক্রিয়া
যারা টিকা নিতে চান, তাদের সবাইকে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে৷ ‘সুরক্ষা’ (www.surokkha.gov.bd) প্ল্যাটফর্মের মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে নিবন্ধন করতে হবে৷ নিবন্ধনের জন্য অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর লাগবে৷ যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তারা আপাতত করোনার টিকা পাবেন না৷
ছবি: surokkha.gov.bd
সরকারের পরিকল্পনা
আগামী ছয় মাসে তিন কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার৷ প্রতি মাসে ২৫ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে৷ জনপ্রতি দুটি করে মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকার প্রয়োজন হবে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রস্তুত পাঁচ হাসপাতাল
টিকা দিতে আপাতত ঢাকার পাঁচটি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে৷ এগুলো হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল৷
ছবি: Mortuza Rashed
অগ্রাধিকার পাবেন যারা
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এক কোটি ৬৯ লাখ ৩৭ হাজার ৯৭৩ জনকে করোনার টিকা দেয়ার জন্য পরিকল্পনা সাজিয়েছে সরকার৷ এদের মধ্যে আছেন কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত চার লাখ ৫২ হাজার ২৭ জন স্বাস্থ্যকর্মী, অনুমোদিত ছয় লাখ বেসরকারি ও প্রাইভেট স্বাস্থ্যকর্মী, দুই লাখ ১০ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার ৬২০ জন সদস্য, সামরিক ও বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন লাখ ৬০ হাজার ৯১৩ জন সদস্য৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অগ্রাধিকার তালিকায় সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক
রাষ্ট্র পরিচালনায় অপরিহার্য ৫০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী, ৫০ হাজার গণমাধ্যম কর্মী, এক লাখ ৭৮ হাজার ২৯৮ জন জনপ্রতিনিধি, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার দেড় লাখ কর্মচারী, পাঁচ লাখ ৪১ হাজার ধর্মীয় প্রতিনিধি, মৃতদেহ সৎকারে নিয়োজিত ৭৫ হাজার ব্যক্তি, জরুরি সেবার চার লাখ কর্মী, স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরের দেড় লাখ কর্মী, এক লাখ ২০ হাজার প্রবাসী অদক্ষ শ্রমিকও আছেন অগ্রাধিকারের তালিকায়৷
ছবি: bdnews24.com
আছেন জাতীয় দলের খেলোয়াড়রাও
জেলা উপজেলায় কর্মরত চার লাখ জরুরি সেবার সরকারি কর্মচারী, এক লাখ ৯৭ হাজার ৬২১ জন ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার (যক্ষ্মা, এইডস, ক্যানসার) ছয় লাখ ২৫ হাজার জনগোষ্ঠী, ৬৪ থেকে ৭৯ বছর বয়সী এক কোটি তিন লাখ ২৬ হাজার ৬৫৮ জন্য ব্যক্তি, ৮০ বছর ও তদূর্ধ্ব ১৩ লাখ ১২ হাজার ৯৭৩ জন জনগোষ্ঠী, জাতীয় দলের খেলোয়াড় ২১ হাজার ৮৬৩ জনও আগে টিকা পাবেন৷
ছবি: Munir Uz zaman/AFP
12 ছবি1 | 12
বৃহস্পতিবার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ভারতে নরেন্দ্র মোদী এখনও ভ্যাকসিন নেননি৷ তবে আমি বলেছি আমাদের এখানে প্রধানন্ত্রীরই আগে ভ্যাকসিন নেয়া উচিত৷ তাহলে লোকের আস্থা বাড়ত৷ আর আমার নাম যখন আসবে তখনই আমি ভ্যাকসিন নেব৷ তবে আমার দাবি হলো যাদের ভ্যাকসিন আগে প্রয়োজন তাদেরই আগে দেওয়া উচিত৷''
‘‘যাদের ভ্যাকসিন আগে প্রয়োজন তাদেরই আগে দেওয়া উচিত’’: জাফরুল্লাহ চৌধুরী
আপনি সবার আগে ভ্যাকসিন নিলেন না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ডাকতে হবে তো৷ আমি তো চাইলেই আগে নিতে পারব না৷''
ডা.জাফরুল্লাহর দাবি, এই সরকার ব্যবসায়ীদের সরকার তাই সেরামের টিকা বেক্সিমকোর মাধ্যমে এনেছে৷ তারা কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই ফাও কত টাকা নিয়ে গেল৷ দামও বেশি নিচ্ছে৷ বেক্সিমকো সেরামের এখানকার প্রতিনিধি হলেও সরকার চাইলে এসেনসিয়াল ড্রাগস-এর মাধ্যমে আনতে পারত বলে তিনি মনে করেন৷
অবশ্য যারা ভারতের টিকা বলে কথা ছড়াচ্ছে তাদের সাথে নাই তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘সেরাম ইনস্টিটিউট অক্সফের্ডের টিকা উৎপাদন করছে৷ আমার ওষুধও তো অনেক দেশ ব্যবহার করছে৷''
‘‘সাধারণ মানুষের উচিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কথায় আস্থা রাখা’’: এহতেশামুল হক চৌধুরী
বিএমএর মহাসচিব এবং সরকার সমর্থক চিকিৎসক নেতা অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী মনে করেন ভ্যাকসিন নিয়ে এই ‘রাজনীতিতে' সাধারণ মানুষের ক্ষতি৷ তিনি মহামারি নিয়ে রাজনীতি করা থেকে সবাইকে বিরত থাকার অনুরোধ করেন৷ তার মতে, ‘‘সাধারণ মানুষের উচিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কথায় আস্থা রাখা৷ এর বাইরে এই টিকা নিয়ে যারা রাজনৈতিক কথা বলছেন তাদের কথায় গুরুত্ব দেয়ার দরকার নাই৷''
তিনি বলেন, ‘‘সারা পৃথিবীর মানুষ ভ্যাকসিন নিচ্ছে৷ বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন রকম ভ্যাকসিন তৈরি করছে৷ তবে পরীক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত ডাব্লিউএইচও কোনোভাবেই স্বীকৃতি দেবে না৷ এই ভ্যাকসিনের মাধ্যমে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে, মানুষ ভ্যাকসিন নেবেনা, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গেলে সেতু ভেঙে পড়বে, এইসব কথাবার্তা রাজনৈতিক৷ এতে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভালো হবে না৷''
তিনি দাবি করেন, ‘‘ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা না নেয়ার কোনো বিকল্প আমাদের ছিল না৷ এটা তো ভারতের টিকা না৷ অক্সফোর্ডের টিকা তাদের দেওয়া ফর্মূলায় সেরাম তৈরি করছে৷''
‘‘ক্লারিফিকেশন দেয়া তো সরকারের দায়িত্ব’’: এ জেড এম জাহিদ
বিএনপি সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাব-এর সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ বলেন, ‘‘ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা নিয়ে কোনো বিতর্ক নাই৷ তারা তো অক্সফোর্ডের টিকা উৎপাদন করছে৷ কিন্তু মাঝখানে ভারতের টিকা কোভেক্স-এর ট্রায়ালের কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের ওপর৷ এটা মানুষকে কনফিউজড করেছে৷ তারা মনে করেছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন আসছে না ভারতের কোভেক্স আসছে৷ পরে অবশ্য পরিস্কার হয়েছে৷ ক্লারিফিকেশন দেয়া তো সরকারের দায়িত্ব৷''
তিনি মনে করেন মানুষের মধ্যে সন্দেহ দূর করে আস্থা তৈরির জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যদের আগে টিকা নেওয়া উচিত৷ প্রধানমন্ত্রী কোলে নিয়ে একটি শিশুকে পোলিও টিকা খাওয়াচ্ছেন, টিকা খাওয়াতে তাকে দরকার নাই৷ দরকার আস্থা সৃষ্টির জন্য৷