এক কোটি মানুষকে গণটিকা দেয়ার কথা ছিল এক সপ্তাহে। কিন্তু পরিমাণ ঠিক রাখা যায়নি। সরকার দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তাতে টিকা লাগবে ২৬ কোটি ডোজ।
বিজ্ঞাপন
গণটিকা শুরুর আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন,৭ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট দেশের এক কোটি মানুষকে টিকা দেয়া হবে। তার সেই পরিকল্পনা সফল করতে প্রতিদিন প্রায় ১৩ লাখ ডোজ টিকা দিতে হতো। শেষ পর্যন্ত ৭ আগস্ট থেকে গণটিকা দেয়া শুরু হয়েছে। চলবে ৬ দিন, ১২ আগস্ট পর্যন্ত। এ সময়ে দেয়া হবে মোট ৩২ লাখ ডোজ। প্রতি কেন্দ্রে প্রতিদিনের জন্য বরাদ্দ ৩০০ ডোজ। গণটিকা শুরুর প্রথম দিন থেকেই কেন্দ্রে অনেক মানুষ টিকার জন্য ভিড় করছেন। কিন্তু অনেকেই টিকা পাচ্ছেন না টিকা স্বল্পতার কারণে। এ নিয়ে বিক্ষোভ ও মারপিটের ঘটনাও ঘটেছে।
‘‘আশা করছি টিকা পেয়ে যাবো’’
১৮ বছরের বেশি বয়স এমন ১৩ কোটি মানুষকে সরকার টিকা দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এই টিকা কত দিনে দেয়া হবে তার কোনো রোডম্যাপ এখনো ঘোষণা করা হয়নি। এই ১৩ কোটি মানুষকে টিকা দিতে মোট ২৬ কোটি ডোজ টিকা লাগবে।
বাংলাদশে প্রথম ভারত থেকে অক্সফোর্ডের টিকা আসে ২১ জানুয়ারি আর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাপক ভিত্তিতে টিকা দেয়া শুরু হয়। এখন পর্যন্ত ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান থেকে মোট দুই কোটি ৭৩ লাখ ৪৩ হাজার ৯২০ ডোজ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের টিকা এসেছে। তার মধ্যে সর্বশেষ মঙ্গলবার চীন থেকে এসেছে ১৭ লাখ ডোজ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে এ পর্যন্ত প্রথম ডোজ পেয়েছেন এক কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার ৬৩০ জন আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪৭ লাখ ৩২ হাজার ৮৩২ জন। সব মিলিয়ে মোট এক কোটি ৯১ লাখ ৮৩ হাজার ৪৬২ ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। সেই হিসাবে মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারের হাতে আছে ৮১ লাখ ৬০ হাজার ৪৫৮ ডোজ। প্রতিজনকে দুই ডোজ দেয়া হলে ৪০ লাখের মতো মানুষকে দেয়ার মতো টিকা আছে।
তবে টিকা শুধু নতুনদের দিলেই হবেনা। অনেক মানুষ এখন দ্বিতীয় ডোজের টিকার জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রথম ডোজ পেলেও দ্বিতীয় ডোজ পাননি এরকম মানুষের সংখ্যা ৯৭ লাখ ১৭ হাজার ৭৯৮ জন।
প্রবাসীদের টিকাদান: ভোগান্তি, উধাও স্বাস্থ্যবিধি
কাজে যোগ দিতে এবং কোয়ারান্টিনের খরচ বাঁচাতে প্রবাসীদের টিকাদানের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ৷ এজন্য জনশক্তি কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-তে নিবন্ধন করে সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে টিকা নেওয়া সুযোগ রাখা হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঢাকায় টিকাকেন্দ্র সাতটি
প্রবাসী কর্মীদের টিকাদানের জন্য ঢাকায় সাতটি কেন্দ্র খোলা হয়েছে৷ কেন্দ্রগুলো হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল এবং শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে দ্বিতীয় তলার করিডোরে মানুষের ভিড়, নেই কোন সামাজিক দূরত্ব৷ প্রবাসীরা তীব্র গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে ক্লান্ত৷ অনেকের মুখে ছিল না মাস্ক৷ একজনকে প্রশ্ন করলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘টিকার ব্যবস্থা করেন আগে, মাস্কের কথা পরে জিগাইয়েন৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মাঝরাত থেকে সিরিয়াল
টিকা নিয়ে দশটার দিকে ফেরত যাচ্ছিলেন সৌদি আরবে গমনেচ্ছু চট্টগ্রামের বাসিন্দা ফয়সাল আহমেদ চৌধুরি৷ এতো দ্রুত কিভাবে টিকা পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘ভাই, সিরিয়াল দিসি কালকে রাত ২টায়৷’’ কেন এতো আগে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘‘এতো মানুষ, ঐদিন সকালে এসে সিরিয়াল দিলে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
এসএমএস ছাড়া টিকা নয়
নিবন্ধনের পর মোবাইলে আসা এসএএমএস ছাড়া কাউকে টিকা দেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ঢাকার একাধিক টিকাকেন্দ্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা৷ প্রবাসীদের ক্ষেত্রে যারা অনেকদিন আগে নিবন্ধন করেছেন কিন্তু এখনো এসএমএস পাননি, তাদের ক্ষেত্রে কী করা হবে জানতে চাইলে তারা বলেন, এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিবে৷ তাদের কিছু করার নেই৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা নিতে এসেছেন এমন একাধিক প্রবাসী অভিযোগ করেন, দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা জনপ্রতি ৫০০-১০০০ টাকা ঘুসের বিনিময়ে সিরিয়ালের বাইরের লোকজনকে টিকাকেন্দ্রে ঢুকতে দিচ্ছেন৷ অপরদিকে হাসপাতালটির সুপারভাইজার আব্দুল মান্নান বিশ্বাস বলেন, প্রবাসীরা নিয়ম মানছেন না, বিশৃঙ্খলা করছেন৷ সবাই আগে যেতে চাইছেন বিধায়ই এত বড় সিরিয়াল তৈরি হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ফেরত যাচ্ছেন অনেকে
সৌদি আরবে যাওয়ার ভিসা নিয়ে ১৭ আগস্টের বিমানের টিকেট কেটেছেন কুমিল্লার বাসিন্দা মোঃ সাব মিয়া৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে টিকা না নিয়েই তাকে ফেরত যেতে হয়৷ কারণ জানতে চাইলে টিকাকেন্দ্রের দায়িত্বরত মোঃ তৌহিদ জানালেন, ‘‘উনি ফাইজারের প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন সৌদি আরবে৷ যারা প্রবাসে প্রথম ডোজ নিয়েছেন, দেশে তাদের দ্বিতীয় ডোজের ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি৷ তাই ওনাকে বলেছি এক সপ্তাহ পরে আবার আসতে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কোন কেন্দ্রে কোন টিকা?
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল সেখানে প্রবাসীদের বায়োনটেক-ফাইজার, মডার্না ও সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হচ্ছে৷ অপরদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে দেওয়া হচ্ছে বায়োনটেক-ফাইজার, অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকা এবং সিনোফার্মের টিকা৷ টিকাদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রাপ্তি সাপেক্ষে বিভিন্ন কেন্দ্রে বিভিন্ন টিকা দেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
হাসপাতাল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল সেখানে দ্বিতীয় তলায় শুধু প্রবাসীদের টিকা দেওয়া হচ্ছে৷ তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রবাসীদের জন্য পৃথক কোন ব্যবস্থা নেই৷ সাধারণ মানুষদের সাথেই তাদের টিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নারী, বয়স্কদের সিরিয়ালের প্রয়োজন নেই
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকাকেন্দ্রে পুরুষদের একাধিক লম্বা লাইন থাকলেও নারীদের কোন লাইন ছিল না৷ দায়িত্বরত একজন ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেল, যেহেতু নারী এবং বয়স্ক প্রবাসীদের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম, তাই তাদের জন্য আলাদা লাইন করা হয়নি৷ তারা সরাসরি টিকা দিয়ে চলে যেতে পারছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কেন্দ্রভেদে পরিস্থিতির ভিন্নতা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রবাসীদের টিকাকেন্দ্রে ভিড় ছিল তুলনামূলক কম৷ বড় পরিসরে খোলামেলা পরিবেশে সেখানে টিকাদান চলছে৷ বুথের সংখ্যাও অন্যদের চেয়ে বেশি৷ টিকা নিতে আসা প্রবাসীদেরকে সেচ্ছাসেবীরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছেন৷ উল্টো পরিস্থিতি দেখা গেছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
10 ছবি1 | 10
গণটিকার বাইরে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে টিকার নিবন্ধন করেছেন দুই কোটি ৬৭ লাখ ৬৯ হাজার ৫৬৬ জন।
স্থাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে গত ২৪ ঘন্টায় সব মিলিয়ে প্রথম ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে চার লাখ ৯৪ হাজার ৩৪১ জনকে। এই গতিতে টিকা দেয়া হলে যাদের দেয়া হয়েছে তাদের বাদ দিয়ে সাড়ে ১১ কোটি মানুষকে টিকা দিতে ৫৭৫ দিন বা ১৯ মাস সময় লাগবে।
তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পাইপলাইনে অনেক টিকা আছে।
তিনি শনিবার বলেছেন, এই আগস্টে ৫৪ লাখ টিকা আসবে। তারমধ্যে কোভ্যাক্স দেবে ৩৪ লাখ এবং চীন থেকে ২০ লাখ টিকা আসবে। তিনি আরো জানান, চীন থেকে মোট সাড়ে সাত কোটি ডোজ টিকা আসবে। চীনের সঙ্গে দেড় কোটি ডোজ টিকার চুক্তি হয়েছে, যা আসতে শুরু করেছে । আরো ছয় কোটি ডোজের চুক্তি করা হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, "আমাদের এক দিনে ৩০ লাখ ডোজ টিকা দেয়ার সক্ষমতা আছে। এটা প্রমাণিত। টিকা নিতেও মানুষ আগ্রহী । কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত টিকা নেই। এর আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের মধ্যে ২১ কোটি ডোজ টিকা আসবে। তার রোডম্যাপ কিন্তু স্পষ্ট নয়। আর ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে সবাইকে টিকা দেয়া দরকার। ১৩ কোটি মানুষকে কতদিনের মধ্যে টিকা দেয়া হবে তা-ও বলা হচ্ছে না। যদি মার্চের মধ্যে সবাইকে টিকা দিতে হয়, তাহলে প্রতিমাসে দুই কোটি ডোজের বেশি টিকা দেয়া প্রয়োজন। সেই কূটনৈতিক তৎপরতা আমাদের কছে যথার্থ মনে হচ্ছে না।”
তিনি আরো বলেন ,"এর আগে জনসন অ্যান্ড জনসনের সাত কোটি ডোজ টিকা আনার কথা বলা হয়েছিল। এই সিঙ্গেল ডোজের টিকা সাত কোটি মানুষকে দেয় যাবে। কিন্তু তার কোনো খবর আমরা জানি না। স্পুটনিক টিকারও কোনো খোঁজ নেই।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক(এমআইএস) ডা. মিজানুর রহমান বলেন, "আমরা তো চাই দেশের সব মানুষকে টিকা দিতে । সেই চেষ্টায় আমাদের ঘাটতি নেই। আমরা আশা করছি, প্রয়োজনীয় টিকা পেয়ে যাবো। তবে টিকা কত পাইপ লাইনে আছে তার সঠিক তথ্য আছে ইপিআই-এর কাছে।”
‘‘আমাদের পর্যাপ্ত টিকা নেই’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমরা গণটিকা প্রতি কেন্দ্রে প্রতিদিন ২৫০-৩০০ ডোজ দেয়ার পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করি। কিন্তু মানুষ আসছে হাজার হাজার। আমরা কী করবো? তাই এখন যারা এসে পাচ্ছেন না, তাদের তালিকাভূক্ত করে রাখতে বলেছি। পরে টিকা এলে তারাও পাবেন।”
১৩ কোটি মানুষকে কতদিনের মধ্যে টিকা দেয়া হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন," আমরা যেভাবে টিকা পাই, সেভাবে পরিকল্পনা করি। দিতে থাকি। বাকি বিষয়গুলো জানা নেই।”