করোনার কারণে দেশে ফিরে আসা সৌদি প্রবাসীদের ওয়ার্ক পারমিটের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে না ফিরলে অনেকেই কাজ হারাবেন৷ তাই ফেরার টিকিটের দাবিতে ঢাকার রাস্তায় নেমেছেন তারা৷
বিজ্ঞাপন
এমদাদুল হক সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছেন গত ১ ডিসেম্বর৷ করোনার কারণে আর ফিরতে পারেননি৷ তার প্রতিষ্ঠান সব দিক বিবেচনা করে ছুটি বাড়িয়ে দিয়েছিল৷ কিন্তু আর বাড়াচ্ছে না৷ তার ওয়ার্ক পারমিট আছে ৩০ সপ্টেম্বর পর্যন্ত৷ এই সময়ের মধ্যে ফিরতে না পারলে তার চাকরিই থাকবে না৷ তিনি জানান, ‘‘সাউদিয়া এয়ার লাইন্সের রিটার্ন টিকেট নিয়ে আমি দেশে ফিরেছি৷ ১৬ সেপ্টেম্বর আমার ফিরে যাওয়ার তারিখ ছিল৷ কিন্তু ফ্লাইট না থাকায় যেতে পারিনি৷ আমার টোকেন থাকার পরও আমাকে টিকেট দিচ্ছে না৷’’ কিন্তু অনেকে পেছনের দরজা দিয়ে টিকেট পাচ্ছে বলে তার অভিযোগ৷
আমার টোকেন থাকার পরও আমাকে টিকেট দিচ্ছেনা: এমদাদুল হক, প্রবাসী
তার মতো কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ প্রবাসী মঙ্গলবার ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায় হোটেল সোনারগাঁ-এ সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্স (সাউদিয়া) অফিসে টিকেটের জন্য ভিড় করেন৷ এক পর্যায়ে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওই এলাকার সড়ক অবরোধ করেন৷ কয়েক ঘন্টা পর পুলিশ গিয়ে তাদের সড়ক ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করলে তারা সরে যান৷ প্রবাসীরা অভিযোগ করেন, ‘‘রিটার্ন টিকেট থাকার পরও রি-ইস্যু করতে বাড়তি আরো ২৫ হাজার টাকা দাবি করছে এয়ার লাইন্সটি৷’’
গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ বিমানে সৌদি আরব থেকে ছুটি নিয়ে দেশে আসেন মেহেদী হাসান সাগর৷ ১৭ এপ্রিল তার ফেরার কথা ছিল৷ কিন্তু করোনার কারণে ফিরতে পারেননি৷ এরপর ছুটি বাড়লেও এই মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে তাকেও ফিরতে হবে৷ কারণ, এরপর তার আর ওয়ার্ক পরমিট থাকবে না৷ এখন কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না৷ কারণ, ওয়ার্ক পরামিটের মেয়াদ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সৌদি আরবে গিয়ে বাড়াতে হবে৷ তিনি জানান, ‘‘বিমানে যোগাযোগ করেছি, তারা আমাদের কবে পাঠাতে পারবে তা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না৷’’
এখন ল্যান্ডিং পারমিশনের অপেক্ষায় আছি: বিমানের সিইও মোকাব্বির হোসেন
বাংলাদেশে ফিরে আসা সৌদি প্রবাসী আরেকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সৌদি আরবে ফেরার অপেক্ষায় এরকম প্রায় এক লাখ প্রবাসী আছেন৷ তাদের বড় একটি অংশকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ফিরতে হবে৷ কিন্তু তারা বিমান বা সাউদি এয়ারলাইন্স কোনো জায়গা থেকেই কোনো আশ্বাস পাচ্ছেন না ৷ বিমানে তবু ফোনে কথা বলা যায়৷ কিন্তু সৌদি এয়ার লাইন্সের অফিসে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে৷ কোউ ফোনও ধরেন না৷ এই প্রতিবেদকও বার বার ফোন করে তাদের কারুর সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারেননি৷
তবে জানা গেছে, সৌদিয়া ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে সপ্তাহে দুই দিন ঢাকা থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালানোর অনুমতি পেয়েছে৷ কিন্তু তারা এখনো ফ্লাই ও করার অনুমতি পায়নি বাংলাদেশ সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটির কাছ থেকে৷
অন্যদিকে আগে অনুমোদন চাইলেও ১ সেপ্টেম্বর থেকে সৌদি আরবে বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালানোর অনুমতি পেয়েছে বিমান ৷ কিন্তু এখনো ল্যান্ডিং পারমিশন পায়নি৷ বিমানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোকাব্বির হোসেন বলেন, ‘‘আমরা সপ্তাহে আটটি ফ্লাইট সৌদি আরবের তিনটি ডেস্টিনেশনে চালানোর অনুমতি পেয়েছি৷ কিন্তু এখন ল্যান্ডিং পারমিশনের অপেক্ষায় আছি৷ এই সপ্তাহে আমার পাঁচটি চাটার্ড ফ্লাইট চালাচ্ছি৷ এতে সৌদি আরব থেকে যাত্রী আনা যাবে৷ তবে সেখানে পাঠানো যাবোনা৷’’
তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, ১ অক্টোবরের আগে বিমান কাউকে সৌদি আরবে নিতে পারছে না৷ যাদের রিটার্ন টিকেট আছে, তারা অগ্রাধিকার পাবেন৷
যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি
প্রতি বছরই বাংলাদেশিরা কাজ নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে৷ বৈধপথে বিদেশে যাওয়া এসব প্রবাসীর হিসাব রাখে সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি৷
ছবি: DW
এক কোটি প্রবাসী
বাংলাদেশের ঠিক কতজন নাগরিক প্রবাসে আছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ বিএমইটি-র হিসাবে ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তবে কতজন ফিরে এসেছেন সেই পরিসংখ্যান নেই সেখানে৷
ছবি: Positive light
১৪ লাখ কোটি টাকা
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের আয়৷ এর কারণে বাংলাদেশের রিজার্ভের অঙ্কটাও এখন বেশ শক্তিশালী৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে মাত্র ২৪ লাখ ডলার বা প্রায় ৩৬ কোটি টাকার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে৷ সেই তুলনায় রেমিটেন্স অনেক বেড়েছে৷ শুধু গত বছরই এসেছে ১৮৩৫ কোটি ডলার বা এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা৷ সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৭০৫ কোটি ডলার বা ১৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা৷
ছবি: AFP
এক তৃতীয়াংশ সৌদি আরবে
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রবাসীর গন্তব্য সৌদি আরব, যেখানে ২০২০ সালের মে পর্যন্ত ৪১ লাখ ৮৪ হাজার বাংলাদেশি পাড়ি জমিয়েছেন৷ ১৯৭৬ সালে মাত্র ২১৭ জন দিয়ে এই শ্রমবাজারের যাত্রা শুরু৷ ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৫১ হাজার কাজ নিয়ে গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে৷ আর চলতি মে পর্যন্ত পাড়ি জমিয়েছেন এক লাখ ৩৪ হাজার জন৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
আরব আমিরাতের মন্দা বাজার
শুরুর দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতই ছিল বাংলাদেশের বড় বাজার৷ ২০০৮ সালে দেশটিতে একবছরে সবচেয়ে বেশি ৪ লাখ ১৯ হাজার জন বাংলাদেশি গেছেন৷ তবে ২০১৩ সালের পর থেকে এই বাজারটিতে মন্দা চলছে৷ গতবছর মাত্র তিন হাজার ৩১৮ জন দেশটিতে পাড়ি জমানোর সুযোগ পেয়েছেন৷ ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৩ লাখ ৭২ হাজার বাংলাদেশির গন্তব্য ছিল আরব আমিরাত, যা মোট জনশক্তি রপ্তানির ১৮ ভাগের কিছু বেশি৷
ছবি: picture-alliance/J. Schwenkenbecher
পড়তিতে ওমান
প্রবাসীদের গন্তব্যের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছে পারস্য উপসাগরের দেশ ওমান৷ ১৫ লাখ ১৮ হাজার বাংলাদেশি কাজ নিয়ে গেছেন সেখানে৷ তবে গত ৩ বছর ধরে এই বাজারটিতেও প্রবাসী যাওয়ার সংখ্যা কমছে৷ ২০১৬ সালে যেখানে এক লাখ ৮৮ হাজার জন ওমানে পাড়ি জমিয়েছেন, গেল বছর তা নেমে এসেছে ৭২ হাজার ৬৫৪ জনে৷ আর চলতি বছর মে পর্যন্ত গেছেন মাত্র ১৭ হাজার ৪০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/A. Farnsworth
আকর্ষণীয় মালয়েশিয়া
বাংলাদেশিদের কাছে মালয়েশিয়া আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে শুরু করে মূলত ১৯৯০ সালের পর থেকে৷ ২০০৭ সালে সেখানে সবচেয়ে বেশি ২ লাখ ৭৩ হাজার জনের বেশি শ্রমিক কাজের জন্যে গেছেন এশিয়ার দেশটিতে৷ মাঝে এই প্রবণতা কমলেও সম্প্রতি আবার বেড়েছে৷ ২০১৮ সালে দেশটিতে গেছেন প্রায় এক লাখ ৭৬ হাজার জন আর ২০১৯ এ মাত্র ৫৪৫ জন৷ সব মিলিয়ে মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে পাড়ি জমিয়েছেন সাড়ে ১০ লাখ ৫৭ হাজারের বেশি বাংলাদেশি৷
ছবি: picture-alliance/FOTOGRAMMA/M. Alberico
সম্ভাবনার কাতার
২০০৬ সাল পর্যন্তও কাতারের বাজার বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রপ্তানিতে ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না৷ তবে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিও এখন বিদেশ গমনেচ্ছুদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে৷ কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন সেখানে অনেক বাংলাদেশির জন্যেই কাজের সুযোগ তৈরি করেছে৷ এখন পর্যন্ত আট লাখ ১১ হাজার বাংলাদেশি দেশটিতে কাজ নিয়ে গেছেন৷
ছবি: picture-alliance
দক্ষ শ্রমিকের বাজার সিঙ্গাপুর
দেশের দক্ষ শ্রমিকদের জন্য পছন্দের এক গন্তব্য সিঙ্গাপুর৷ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশটিতে এখন পর্যন্ত চাকরি নিয়ে ৭ লাখ ৯২ হাজার বাংলাদেশি পা রেখেছেন, যা মোট প্রবাসীর ছয় ভাগের কিছু বেশি৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০ হাজার জন গেছেন ২০১৩ সালে৷
ছবি: picture-alliance/Global Travel Images
কুয়েতে ৫ ভাগ
বাংলাদেশিদের জন্য কুয়েতের মতো গুরুত্বপূর্ণ এক শ্রমবাজার প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলা চলে৷ ২০০৮ থেকে ২০১৩— এই সময়ে মাত্র ৪১৪ জন দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন৷ ২০১৪ সাল থেকে তা বাড়তে শুরু করলেও গত দুই বছর ধরে আবার পড়তির দিকে৷ সব মিলিয়ে ছয় লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশি গেছেন কুয়েতে, যা মোট প্রবাসীর প্রায় ৫ ভাগ৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/G. Hellier
পারস্য উপসাগরের দ্বীপে
চার লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশির গন্তব্যের দেশ বাহরাইন৷ ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৭২ হাজার মানুষ কাজ নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন পারস্য উপসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে৷ তবে ২০১৯ সালে গেছেন মাত্র ১৩৩ জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.Al-Shaikh
ইউরোপে সর্বোচ্চ ইটালিতে
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি রয়েছে ইটালিতে৷ ২০০২ সাল থেকে সেখানে পাড়ি জমানোর তথ্য আছে বিএমইটির কাছে৷ সে অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সাড়ে ৫৫ হাজার বাংলাদেশি বৈধ পথে গেছেন পশ্চিম ইউরোপের দেশটিতে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Medichini
11 ছবি1 | 11
তবে তাদের সৌদি আরবের একটি অনুমোদনপত্র লাগবে৷ আর সৌদি আরবে পৌঁছানোর ৪৮ ঘন্টার মধ্যে করোনা নেগেটিভ থাকতে হবে৷ কিন্তু যাদের ওয়ার্ক পারমিট শেষ হয়ে যাবে, তারা যেতে পারবেন কিনা তার কোনো উত্তর তিনি দিতে পারেনি৷ তিনি জানান, এসব বিষয়ে তিনি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কথা বলছেন৷ তারা নিশ্চয়ই কোনো ব্যবস্থা করবেন৷
এদিকে পরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে জানা গেছে, যারা করোনার আগে ছুটি নিয়ে এসেছেন, তাদের কোনো সমস্যা হবে না৷ তারা দেরি হলেও যেতে পারবেন৷ অন্তত আরো তিন মাস তাদের সুযোগ থাকবে৷ এ ব্যাপারে সৌদি রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ সরকারকে আশ্বস্ত করেছেন৷
তবে প্রশ্ন উঠেছে উড়োজাহাজ চলাচল শুরু হলেও প্রায় এক লাখ প্রবাসীকে কত দিনে সৌদি আরবে পাঠানো সম্ভব হবে?
বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান আহমেদ রিয়াজ বলেন, ‘‘এখন ২০ হাজারের মতো সৌদি প্রবাসী চাকরির ঝুঁকিতে আছেন৷ তারা ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ফিরতে না পারলে সমস্যায় পড়বেন৷ তাদের ওয়ার্ক পারিমট থাকবে না৷ তাই সরকারের উচিত এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কথা বলা, তাদের জন্য সময় বাড়ানোর ব্যবস্থা করা, এর জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের ব্যবস্থা করা৷’’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘বিমানের অবহেলা আর দায়িত্বহীনতার কারণে এই পরিস্থিতি হয়েছে৷ কারণ, এর আগে একবার বাণিজ্যিক ফ্লাইটের অনুমোদন দেয়া হলেও শর্ত ভঙ্গের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়৷’’
আর সৌদিয়াকে আটকে রাখার কোনো মানে হয় না বলে তিনি মনে করেন৷ তাদের দ্রুত আরো ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতির দাবি জানান তিানি৷