ফেসবুক নিয়ে ইদানিং সমালোচনার শেষ নেই৷ আজ ‘তথ্য চুরি' তো কাল ‘ভুয়া খবর' ছড়ানোর দায়৷ ফেসবুকের যেন দোষের শেষ নেই৷ অথচ এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিন্তু অনেক ইতিবাচক কাজও করে যাচ্ছে৷ যেমন, রক্তদান সহজ করা৷
বিজ্ঞাপন
ফেসবুক হচ্ছে এমন এক প্ল্যাটফর্ম যেখানে এখন আপনার দূরদূরান্তের আত্মীয়-স্বজনেরও দেখা পাবেন৷ হয়ত বাস্তব জীবনে তাঁদের দেখা তেমন একটা পাননি, অথচ এখন ফেসবুকে ‘হ্যালো' বললেই দু'মিনিটে উত্তর মেলে৷ গত কয়েক বছরে মার্ক সাকারবার্গ এই প্ল্যাটফর্মকে কার্যত পুরো বিশ্বের এক ভার্চুয়াল প্রতিরূপে পরিণত করেছেন৷
মানুষের সঙ্গে মানুষের মধ্যে অনলাইনভিত্তিক যোগাযোগে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়া এই সামাজিক যোগাযোগ সাইট এখন একটু বেকায়দায় আছে বলা যায়৷ কিছুদিন পরপরই শোনা যায়, ফেসবুক থেকে কয়েক মিলিয়ন ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি গেছে৷ ফেসবুক দ্রুত সে-কথা স্বীকার করে নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেয় ভবিষ্যতে এমন আর হবে না৷ সেসব চুরি করা তথ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে কার কতটা লাভ হয়, সেটা নিয়ে যদিও বিতর্ক রয়েছে, তবে এটা সত্যি যে, নিজের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হোক এমনটা কেউই চায় না৷
তথ্য চুরির পাশাপাশি ফেসবুকের বিরুদ্ধে আরেক বড় অভিযোগ হচ্ছে ‘ভুয়া খবর' ছড়ানো৷ এক্ষেত্রে সাকারবার্গের কৃপণ মানসিকতাকে কিছুটা দোষ দেয়া যেতেই পারে৷ তিনি ফেসবুক নিয়ন্ত্রণে মানুষের বদলে যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা দেখিয়েছেন বেশি৷ ফলে দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো চক্র যন্ত্রকে বিভ্রান্ত করে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে যাচ্ছে৷ আবার এটাও ঠিক, ফেসবুকের পরিধি এতই বেড়ে গেছে যে, মানুষ দিয়ে সেটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে অনেক নতুন মডারেটর নিয়োগ করতে হবে৷ নানা দেশে চাপে পড়ে সাকারবার্গ সেটা করছেনও, তবে খুব ধীরগতিতে৷
সব মিলিয়ে ফেসবুক সামলাতে যে সাকারবার্গ এখন হিমশিম খাচ্ছেন সেটা বলাই যায়৷ আর এই কঠিন সময়ে তাঁর এক সময়ের আপন মানুষদের কেউ কেউ দাবি তুলেছেন ফেসবুক ভেঙে দেয়ার৷ এ যেন মাথাব্যাথা নিরসনে মাথা কেটে ফেলার মতো ব্যাপার৷
আমার মনে হয়, তথ্য চুরি আর ভুয়া খবর নিয়ে ইদানিং এতবেশি আলোচনা হচ্ছে যে, ফেসবুকের ভালো দিকগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে৷ ফেসবুক আমাদের পুরো পরিবারকে যেমন এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে, তেমনি অনেক মানবিক ব্যাপারও সহজ করে দিয়েছে৷ আর সেগুলোর একটি হচ্ছে রক্তদান৷
বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে ২০১৮ সালে ‘ব্লাড ডোনেশনস হাব' তৈরি করে দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাইটটি৷ ফলে এখন জরুরি প্রয়োজনে রক্ত পাওয়া অতীতের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেছে৷ এখন যাঁরা ফেসবুকে রক্ত দিতে আগ্রহের কথা জানাচ্ছেন, তাঁরা কারো রক্তের প্রয়োজন হলে তাৎক্ষণিক সাড়া দিতে পারেন৷ বলাবাহুল্য, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের কয়েক মিলিয়ন মানুষ রক্তদানে ফেসবুকের মাধ্যমে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন৷
রক্তদানের মতো অন্যান্য মানবিক বিষয়ে ফেসবুকের ব্যবহার বাড়ানো গেলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটির গ্রহণযোগ্যতা সাধারণ মানুষের মধ্যে আরো বাড়িয়ে দেবে৷ প্রশ্ন হচ্ছে, মার্ক সাকারবার্গ কি সেদিকে গুরুত্ব দেবেন? ব্যবসা হয়ত তাতে একটু কম হবে, তবে মানবজাতির উপকার হবে অনেক৷
রক্তদানের আদ্যোপান্ত
রক্তদান কি কেবল অন্যের জীবন বাঁচায়? না, তা নয়৷ রক্তদাতাও এর মাধ্যমে উপকৃত হন বহুভাবে৷ তবুও চাহিদা অনুযায়ী মিলে না রক্ত৷ রক্তদানের আদ্যোপান্ত জেনে নিন ছবিঘরে৷
ছবি: Fotolia
যাঁরা রক্ত দিতে পারেন
১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সি কোনো মানুষের ওজন অন্তত ৪৫ কেজি হলেই তিনি রক্ত রক্ত দিতে পারেন৷ রক্ত দিতে পারেন তিন মাস পরপর৷ তবে রক্তদানের জন্য ব্যক্তিকে সুস্থ থাকতে হবে৷ দাতার রক্তের স্ক্রিনিং টেস্ট বা রক্ত নিরাপদ কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে৷ ভরপেট খাওয়ার চার ঘণ্টা পর রক্ত দেওয়া শ্রেয়৷ যাঁদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তাঁরাও চিকিৎসকের পরামর্শে রক্তদান করতে পারেন৷
ছবি: Fotolia
যাঁদের রক্ত দিতে মানা
ক্যানসার, হিমোফিলিয়া, ম্যালেরিয়াসহ জীবাণুঘটিত কোনো রোগ, এইচআইভি বা এইডসে আক্রান্ত, মাদক সেবনকারী, হেপাটাইটিস-বি ও সি আক্রান্ত ব্যক্তি ও গর্ভবতী নারীরা রক্ত দিতে পারবেন না৷ যাঁদের অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট আছে এবং যাঁদের শরীরের কোনো স্থানের গ্ল্যান্ড (লিম্ফনোড) ফুলে গেছে, তাঁদেরও রক্ত দেওয়া নিষেধ৷
ছবি: Universität Tübingen/Christoph Jäckle
রক্ত যাঁদের প্রয়োজন
দুর্ঘটনায় আহত, ক্যানসার বা অন্য কোনো জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য, অস্ত্রোপচার কিংবা সন্তান প্রসব অথবা থ্যালাসেমিয়ার মতো বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় রক্তেরপ্রয়োজন হয়৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে আট থেকে নয় লাখ ব্যাগ রক্তের চাহিদা রয়েছে৷ এর মধ্যে ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ ব্যাগ সংগ্রহ হওয়ায় ঘাটতি থাকে তিন লাখ ব্যাগের বেশি৷ এর মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ আসে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের কাছ থেকে৷
ছবি: Fotolia
কে কাকে রক্ত দিতে পারেন?
সাধারণত নির্দিষ্ট রক্তের গ্রুপের ব্যক্তি নির্দিষ্ট গ্রুপকে রক্ত দিয়ে থাকে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক গ্রুপ থেকে অন্য গ্রুপেও রক্ত সঞ্চালন করা যায়৷ এক্ষেত্রে ‘ও-নেগেটিভ’ হলো সর্বজন দাতা এবং ‘এবি-পজেটিভ’ হলো সর্বজন গ্রহীতা৷
ছবি: Yohannes G/Egziabhare
কোন রক্ত লাগে বেশি
যদিও ৮টি গ্রুপের রক্তেরই প্রয়োজন পড়ে, তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি লাগে ‘ও পজিটিভ’ রক্ত৷ বিশ্বের ৩৫ শতাংশ মানুষের এই রক্ত রয়েছে৷ এর পরের অবস্থান ‘এ পজিটিভ’-এর – শতকরা ৩০ভাগ৷ সবচেয়ে বিরল রক্তের গ্রুপ ‘ও নেগেটিভ’৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
রক্তদানের পর...
রক্ত দেওয়ার পর একটু মাথা ঘোরানোটা স্বাভাবিক৷ কারণ, এ সময় শরীর থেকে রক্তের পাশাপাশি ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম আয়রনও কমে যায়৷ এ কারণে আয়রন ও প্রোটিনযুক্ত খাবার বেশি বেশি খাওয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা৷ এ সময় হাঁটাহাঁটি না করে অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়া দরকার৷ আর রক্তদাতা যদি ঘামতে থাকেন এবং অস্থিরতা হয়, তবে তাঁকে স্যালাইন খাওয়ানোর পরামর্শও দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা৷
ছবি: DW/P. Samanta
রক্তদানের উপকারিতা
রক্তদানে যে কেবল মানুষের জীবন বাঁচে, তা নয়, এর মাধ্যমে রক্তদাতাও উপকৃত হন নানাভাবে৷ এর মধ্যে কয়েকটি হলো– নিয়মিত রক্তদান করলে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে, বছরে তিনবার রক্ত দিলে শরীরে নতুন লোহিত কণিকা তৈরির হার বেড়ে যায়, অস্থি-মজ্জা সক্রিয় থাকে ও দ্রুত রক্ত স্বল্পতা পূরণ হয়৷
হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে
রক্ত দিলে রক্তে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে যায়, এতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি মাসে পিরিয়ড হওয়ার কারণে নারীর হৃদরোগ তুলনামূলকভাবে কম হয়৷ এ কারণে পুরুষদের প্রতি ৩ থেকে ৪ মাস পর পর রক্তদানের পরামর্শ দেন তাঁরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রক্তদান করলে ফ্রি পরীক্ষা
বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে পাঁচটি পরীক্ষা সম্পূর্ণ বিনা খরচে সম্পন্ন হয়ে যায়৷ এর মাধ্যমে জানা যায়, শরীরে অন্য বড় কোনো রোগ যেমন—হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি (এইডস) প্রভৃতি আছে কিনা৷