বাংলাদেশে কয়েক বছরের প্রবণতা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কথিত ধর্মীয় অবমাননার পোস্টকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে৷ এর পেছনে ছিল তাদের সম্পত্তি দখলের ষড়যন্ত্র৷
বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ রংপুরের ঠাকুপাড়ায় হামলা চালিয়ে হিন্দুদের ৩০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়, ভাঙচুর করা হয় আরো ২৫টি বাড়ি৷ চালানো হয় লুটপাটও৷ এর জন্য ব্যবহার করা হয় টিটু রায় নামের একজনের কথিত ফেসবুক স্ট্যাটাস৷ টিটু রায় নিজে নাম সই করা ছাড়া আর কোনো লেখাপড়া জানেন না৷ গত পাঁচ বছর আগে তিনি তাঁর রংপুরের ঠাকুপাড়া বাড়ি ছেড়ে নারয়ণঞ্জে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করছিলেন৷ পাওনাদারদের ভয়ে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তিনি নাকি একবারও বাড়ি যাননি৷
যে ফেসবুক পোস্টটির কথা বলা হচ্ছে, তার ‘স্ক্রিনশট' ছাড়ানো হয় ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ-এর খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সভাপতি এবং খুলনা জেলা শাখার সহ সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আসাদুল্লাহ হামিদির ফেসবুক থেকে৷ ঐ স্ক্রিনশটে দেখা যায় রাকেশ মন্ডল নামে আরেকজন সেটা শেয়ার করেছেন এমডি টিটু (টিটু রায় নয়) নামে আরেকজনের ফেসবুক থেকে৷ কিন্তু পুলিশ শেষ পর্যন্ত টিটু রায়কেই গ্রেপ্তার করেছে৷ তাঁকে দু'দফা রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে৷ তার ওপর আদালতে তাঁর জামিন আবেদনের জন্য কোনো আইনজীবীও দাঁড়াচ্ছেন না৷
নূর খান
রংপুরের ঘটনায় অবশ্য পুলিশ এরইমধ্যে ১৬২ জনকে আটক করেছে ভিডিও ফুটেজ ধরে৷ এরমধ্যে ৭৫ জনকে সোমবার আদালতে হাজির করা হয়৷ কিন্তু এই হামলার নেপথ্যে যারা আছেন, তাদের এখনো আটক করা হয়নি বলে অভিযোগ৷ এমনকি হামলার জন্য ফেসবুক গ্রুপ খুলে প্রচারণাকারী মোসাদ্দেকুর রহমানকেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ৷
গত বছরের ২৯ অক্টোবর একইভাবে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে হিন্দু বসতি এবং মন্দিরে হামলা চালানো হয়৷ ঐ ঘটনায় রসরাজ নামে এক মৎসজীবী যুবককে ফেসবুক পোস্টের দায়ে আটক করা হয়৷ রসরাজও লেখাপড়া জানতেন না৷ শুধু তাই নয়, রসরাজ কখনো ফেসবুক আইডি-ই খোলেননি৷
আটকের আড়াই মাস পর চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি পান৷ কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে এখনো মামলা চলছে৷ নাসির নগরের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আরো ১০৭ জনের সবাই এ মুহূর্তে জামিনে আছেন৷ কিন্তু মূল হোতারা আটক হয়নি বলেও রয়েছে অভিযোগ৷
মিজানুর রহমান
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুতে একইভাবে বৌদ্ধ বসতি এবং মন্দিরে হামলা চালানো হয়৷ এখানেও ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়৷ উত্তম বড়ুয়া নামে একজনকে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগে পুলিশ তখন আটক করে৷ কিন্তু উত্তম কোনো স্ট্যাটাস দেননি৷ অন্য কেউ স্ট্যাটাস দিয়ে তাঁকে ‘ট্যাগ' করেছিল৷ কিন্তু পুলিশ উত্তমের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং চার্জশিট দেয়৷ সেই ঘটনার পর থেকে আজ পর্যন্ত উত্তম নিখোঁজ৷ পুলিশ বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা তাঁর কোনো খোঁজ দিতে পারছে না৷
রংপুরের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘টিটু ফেসবুক পোস্টের সঙ্গে জড়িত কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়৷ তদন্ত চলছে৷ তবে তাঁর বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইম অ্যাক্টে মামলা হওয়ায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷''
অপরাধ নিশ্চিত না হয়েই গ্রেপ্তার কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘তাঁকে আগে আটক না করতে পারার কারণেই তো মোল্লারা হামলা চালিয়েছে৷''
এদিকে টিটু রায়কে আটকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘টিটু যে নিরাপরাধ তা প্রমাণ করেতই তাঁকে আটক করা হয়েছে৷''
নাসিরনগরের হিন্দুরা এখন যেমন আছেন
এক ব্যক্তি ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে- এই অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু জনপদে ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা৷ শতাধিক বাড়ি ও বেশ কিছু মন্দিরে হামলা হয়েছে৷ সেখানে গিয়ে ছবি তুলে এনেছেন খোকন সিং৷
ছবি: Khukon Singha
রসরাজের বাড়ি-ঘরে হামলা
যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়েছে তার নাম রসরাজ দাস৷ অভিযোগ ওঠার পরই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ তারপরও হামলা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং হবিগঞ্জের মাধবপুরের হিন্দুদের অনেক বাড়ি এবং মন্দিরে৷ নাসিরনগর সদর থেকে ১৬ কিমি. দূরে হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামে রসরাজের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়৷
ছবি: Khukon Singha
রসরাজ কি সত্যিই ধর্ম অবমাননা করেছে?
২৮শে অক্টোবর রসরাজের ফেসবুক পাতায় ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি পোস্ট করা হয় বলে দাবি করা হয়৷ রসরাজ জানিয়েছে, কেউ হ্যাক করে এটি করেছে৷ তারপরও নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ছবিটি পোস্ট হওয়ায় ক্ষমা চেয়েছেন তিনি৷ তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রসরাজ মাত্র ফোর বা ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে৷ ফলে ফটোশপ করে ছবি ফেসবুকে দেয়ার ক্ষমতা তার আছে কিনা এই প্রশ্ন উঠেছে৷
ছবি: Khukon Singha
ফটোশপ করতে জানেন না রসরাজ
এদিকে গ্রেপ্তার করার পর রসরাজকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ৷ নাসিরনগর ঘুরে এসে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘ফোর-ফাইভ ক্লাস পাস ঐ যুবকের ফটোশপে কাজ করার মতো দক্ষতা নাই৷ আমরা সরেজমিন তদন্তে ধারণা করছি, একটি সাইবার ক্যাফে থেকে এ কাজ করা হয়েছে৷’’ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক, পুলিশ কর্মকর্তা এবং মানবাধিকার কর্মীরাও একই কথা বলেছেন৷
ছবি: Khukon Singha
পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়
ধর্ম অবমাননার কথা বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দির ও বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটের সময় পুলিশ হামলাকারীদের রুখতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন নির্যাতিতরা৷
ছবি: Khukon Singha
আবারও হামলা
৩ নভেম্বর আবার হামলা হয় নাসিরনগরে৷ হিন্দুদের বেশ কিছু বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ এছাড়া গত কয়েকদিনে গোপালগঞ্জ, রংপুর, বরিশাল, ঠাকুরগাঁওসহ আরো কয়েকটি জায়গায় হিন্দুদের মন্দিরে হামলা হয়েছে৷ ছবিতে নাসিরনগরের একটি বাড়ি৷
‘হেফাজতে ইসলাম’ ও ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের’ ব্যানারে বিক্ষোভ
রসরাজের শাস্তি দাবিতে ‘হেফাজতে ইসলাম’ ও ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের’ ব্যানারে রোববার বিক্ষোভ-সমাবেশের পরপরই নাসিরনগরে এবং পাশের এলাকা হবিগঞ্জের মাধবপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলে পড়ে একদল যুবক৷ ছবিতে নাসিরনগরের একটি ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি৷
ছবি: Khukon Singha
স্থানীয় আওয়ামী লীগের তিন নেতা বহিষ্কার
হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় স্থানীয় তিন নেতাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে আওয়ামী লীগ৷ হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ৷
ছবি: Khukon Singha
চলছে ঘর-বাড়ি ঠিক করার কাজ
পুড়ে যাওয়া ও ভাঙা ঘর-বাড়ি ঠিক করে কোনোমতে মাথা গোঁজার নিশ্চয়তা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: Khukon Singha
মন্দিরের বেহাল দশা
এই পুরোহিতের চোখের ভাষা অনেক কিছুই বলে দেয়৷ মন্দিরগুলো কবে যে ঠিক করা হবে, কারো জানা নেই৷
ছবি: Khukon Singha
মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রতিমা
হামলার পর থেকে এখনো মন্দিরগুলোকে ঠিক করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি৷ তাই এই মন্দিরে প্রতিমা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাটিতে৷
ছবি: Khukon Singha
ক্ষতিগ্রস্তরা পাচ্ছেন না ত্রাণ
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ৬ হাজার করে টাকা ও টিন দেয়া হয়েছে৷ ক্ষতির তুলনায় তা খুবই কম৷ তবে খোকন সিং ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, বেশিরভাগ পরিবার ছয় হাজার টাকাও পাননি৷ কেউ কেউ এক বান্ডিল টিনের সঙ্গে পেয়েছেন মাত্র তিন হাজার টাকা!
ছবি: Khukon Singha
12 ছবি1 | 12
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একটি চক্র ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে অথবা অন্য কোনো কৌশলে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অপকৌশল চালিয়ে আসছে৷ সংখ্যালঘুদের সহায়-সম্পদ দখলই এর উদ্দেশ্য৷ কিন্তু সঠিক তদন্তের মাধ্যমে মূল অপরাধীদের আটক না করে যাঁদের নামে বা যাঁদের নাম ব্যবহার করে এ সব স্ট্যাটাস দেয়া হচ্ছে, পুলিশ তাঁদেরই আটক করছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এ কারণে সংখ্যালঘুরা আরো নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন৷ পুলিশের বোঝা উচিত, এটা কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়৷ একটা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর এটা আঘাতের নতুন কৌশল৷''
এটা কি সত্যিই কোনো বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর এটা আঘাতের নতুন কৌশল? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷