ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে কোনোরকম রাখঢাক না করে শি জিনপিংবলেছেন, তাদের দুজনের বৈঠকের সব খবর কী করে মিডিয়াতে চলে এলো? জি২০ বৈঠকের ফাঁকে ট্রুডো ও শি-র কথপোকথন ধরা রইলো টিভি-র চিত্রসাংবাদিকদের ক্যামেরায়।
চীনা প্রেসিডেন্ট উত্তেজিত হয়ে অন্য এক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে কিছু বলছেন, এই ঘটনা বিরল। সাধারণত তিনি খুবই সংযত ব্যবহার করেন।
কিন্তু ক্যানাডার মিডিয়াতে এই ভিডিও সম্প্রচার করা হয়েছে এবং সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, শি জিনপিং রীতিমতো অভিযোগের সুরে ট্রুডোকে বলছেন, তিনি তাদের আগের বৈঠকের কথা মিডিয়াতে ফাঁস করেছেন। এটা ঠিক নয়।
দুই দেশের সম্পর্ক এখন খুব একটা মধুর নয়। এই অবস্থায় এই ধরনের ঘটনা দুই দেশের সম্পর্ককে আরো তিক্ত করতে পারে।
শি জিনপিং ও তাঁর রাজনীতি
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তৃতীয়বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন। ছবিঘরে দেখুন তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
দেরিতে শুরু
কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা শি ঝংজুন ছিলেন তাঁর পিতা৷ পিতার কীর্তি তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়তে শুরুর দিকে বাধা তৈরি করে৷ ১৯৬২-তে দল থেকে বহিষ্কৃত হন ঝংজুন৷ কয়েক বছর পর চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নিপীড়িত হন, এমনকি জেলেও যেতে হয় তাঁকে৷ সেই পিতার ছেলের আবেদন বারবার প্রত্যাখ্যান করে অবশেষে ১৯৭৪-এ সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে কমিউনিস্ট পার্টি৷ সেই থেকে শুরু শি জিনপিংয়ের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media/Pictures From History
আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন
রসায়ন প্রকৌশলের ছাত্র শি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে৷ কঠিন পরিশ্রম করেন৷ আট বছর পর দলের পক্ষে প্রথম বড় পদটি পান৷ ১৯৮২ সালে নির্বাচিত হন দলের হের্বেই রাজ্যের সম্পাদক৷ এরপর একে একে বেশ কয়েকটি প্রদেশের গভর্নর নির্বাচিত হন৷ এমনকি চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য ও ব্যবসাকেন্দ্র সাংহাই রাজ্যদলের প্রধানের পদটিও ঝুলিতে পুরে নেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/CPA
রাষ্ট্রপ্রধান শি
শি’র ক্যারিয়ারে ২০১২ সালের ১৫ নভেম্বর খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন৷ যে দল তাঁর পিতাকে বহিষ্কার করেছে সেই কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি৷ এমন কি কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁকে সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত করে, যার অর্থ হলো, অলিখিতভাবে তিনি হয়ে ওঠেন চীনের নেতা৷ সাবেক প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও-এর দু’বারের মেয়াদ শেষ হবার পর চীনের জাতীয় কংগ্রেস তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে৷
ছবি: GOH CHAI HIN/AFP/Getty Images
দ্য চাইনিজ ড্রিম
নির্বাচনের পর শি-এর রাজনৈতিক শ্লোগান হয় ‘চাইনিজ ড্রিম’৷ অনেকে একে আমেরিকান ড্রিমের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললেও আসলে এর অর্থ চীনের নবউত্থান৷ শি একে ‘চীনা জাতির মহাউত্থান’ হিসেবেই উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, চীনকে পৃথিবীতে এর ‘প্রাপ্য জায়গা’ নিশ্চিত করতে হবে৷ তাঁর মতে, সেই জায়গা করতে গিয়ে ‘শত্রুর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে’ যেতেও পিছপা হবে না চীন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Wong
ঐতিহাসিক বৈঠক
১৯৪৯ সালের চীনের গৃহযুদ্ধের পর শি’ই প্রথম কোনো চীনা নেতা যিনি তাইওয়ানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট মা ইয়িং-জু’য়ের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি৷ তার মানে এই নয় যে তিনি ছাড় দিতে রাজি আছেন৷ ২০১৮ সালের মার্চে তিনি তাইওয়ানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যদি আলাদা হবার চিন্তা আসে মাথায়, তাহলে ‘ইতিহাসের শাস্তি’ জুটবে তাদের কপালে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/W. Maye-E
মূল নেতা
২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর শি কমিউনিস্ট পার্টির মূল নেতার স্বীকৃতি পান৷ এ স্বীকৃতি এর আগে কেবল আধুনিক চীনের স্থপতি, দলের সাবেক চেয়ারম্যান মাও সেতুং এবং আরেক সাবেক চেয়ারম্যান দেং জিয়াওপিং ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন পেয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/Feng Li
সামরিক প্রভাব
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে চীনের সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের (যেটি মূলত সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে) নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়৷ এতে করে ৬ লাখ ৬০ হাজার শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ক্ষমতায় অনির্দিষ্টকাল
একনায়কতন্ত্রের খড়গ হতে দেশকে বাঁচাতে ১৯৮২ সালে জিয়াওপিং নিয়ম করেন যে, একজন দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না৷ ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ, চীনের সংসদ শি’কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে এবং ভোটের মাধ্যমে সংশোধনী প্রস্তাব পাশ করে যে, একজন প্রেসিডেন্টের দু’বার নয়, বরং অনির্দিষ্টবারের জন্য নির্বাচিত হতে পারবেন৷ তাই শি-এর সামনে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রেসিডেন্ট থাকার পথ খোলা৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
8 ছবি1 | 8
গত সোমবারই ক্যানাডার কর্তৃপক্ষ একটি সংস্থার এক কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে কিছু বাণিজ্যিক গোপন তথ্য চীনে পাঠাবার চেষ্টা করছিল।
কী হয়েছিল?
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ট্রুডো ও শি জিনপিং কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের দুইজনের মধ্যে আছেন একজন ইন্টারপ্রেটার।
শি-র কথা অনুবাদ করে ইন্টারপ্রেটার বললেন, ''আমাদের আলোচনার সবকিছু একটা কাগজে লিক হয়ে গেছে। এটা ঠিক হয়নি। এভাবে কোনো আলোচনা করা যায় না। যদি আপনার দিক থেকে আন্তরিকতার অভাব থাকে তাহলে...।'' এই অবস্থায় ট্রুডো ইন্টারপ্রেটারকে থামিয়ে বলেন, ''ক্যানাডায় আমরা মুক্ত ও খোলামেলা আলোচনায় বিশ্বাস করি। আমরা সেভাবেই চলব। আমরা দুই জনে গঠনমূলক কাজ করব। কিন্তু কিছু বিষয়ে আমাদের মতান্তর হতেই পারে।''
এর জবাবে শি বলেন, ''প্রথমে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা দরকার।'' এই বলে ট্রুডোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে যান শি।
আকর্ষণীয় কয়েকজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান
শুধু সৌন্দর্য্য নয়, আচরণ এবং ব্যক্তিত্বও মানুষের চেহারায় ফুটিয়ে তোলে আকর্ষণের ছাপ৷ নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান জায়গা করে নিচ্ছেন বিশ্ববাসীর মনে৷ এমন কয়েকজনকে নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
কোলিন্ডা গ্রাবার-কিটারোভিচ
বিশ্বকাপ ফুটবলে গ্যালারিতে সবার নজর কেড়েছিলেন ক্রোয়েশিয়ার সুন্দরী প্রেসিডেন্ট কোলিন্ডা গ্রাবার-কিটারোভিচ৷ ২০১৫ সাল থেকে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন৷ তবে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বর্ণাঢ্য৷ প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে কাজ করেছেন ইউরোপ বিষয়কমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে৷ ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে ক্রোয়েশিয়ার দূত ছিলেন কোলিন্ডা৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
ভ্লাদিমির পুটিন
১৯ বছর ধরে কখনও সরকারপ্রধান, কখনও রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক এই রুশ গোয়েন্দা৷ ১৯৯৯ থেকে ২০০০ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী, ২০০০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি, ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত আবার প্রধানমন্ত্রী, এবং এরপর থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পুটিন৷ ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া যে অবস্থান খুইয়েছিল, তার অনেকটাই পুনরুদ্ধার করেছেন পুটিন৷
ছবি: Reuters/G. Dukor
এমানুয়েল মাক্রোঁ
ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সি প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁ৷ ২০১৭ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি৷ তরুণ রাজনীতিবিদ হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা প্রশংসা পেয়েছে বিশ্বনেতাদের কাছে৷ বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্সের খেলা চলাকালীন সময়ে ভিআইপি গ্যালারিতে মাক্রোঁ’র উত্তেজনা নজর কেড়েছে অনেকের৷
ছবি: Reuters/C. Platiau
জাস্টিন ট্রুডো
৪৪ বছর বয়সে ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে সাড়া ফেলেছিলেন ট্রুডো৷ সুদর্শন এই তরুণের মন্ত্রিসভাকে বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় মন্ত্রিসভা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়৷ তাঁর মন্ত্রিসভায় আদিবাসী ছাড়াও বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের ক্যানাডিয়ান পেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব৷ এছাড়াও বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যুতে তাঁর প্রগতিশীল চিন্তাভাবনাও তাঁকে তরুণদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছে৷
ছবি: picture-alliance/empics/A. Wyld
বরুট পাহো
২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর ২০১২ থেকে দেশটির প্রেসিডেন্ট পাহো৷ অনেকটা আনুষ্ঠানিক পদ হলেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে পাহো বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে চলেছেন৷ ইউক্রেন সংকট নিরসন এবং ট্রাম্প-পুটিন বৈঠকে তাঁর আন্তরিক চেষ্টা ইউরোপের রাজনীতিতে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷
ছবি: Reuters/S. Zivulovic
এনরিকে পেনিয়া নিয়েটো
২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মেক্সিকোর প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন সুদর্শন এই মেক্সিকান৷ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া আধিপত্য ভাঙা, জ্বালানি খাত আধুনিকায়ন, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অর্থায়নসহ নানা উদ্যোগে মেক্সিকোর তরুণদের মধ্যে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress
6 ছবি1 | 6
বৈঠকে কী হয়েছিল?
এই বৈঠক নিয়ে ক্যানাডা সরকারিভাবে কোনো কথা বলেনি। মঙ্গলবার বালিতে ১০ মিনিট ধরে বৈঠক হয়। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সরকারি মিডিয়াও কিছু জানায়নি। কারণ এটা কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছিল না।
পরে ট্রুডো সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ''প্রতিটি আলাপচারিতা কখনই মসৃন হয় না। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, আমাদের আলোচনা করে যেতে হবে। ক্যানাডার মানুষের জন্য যা জরুরি, তার পক্ষে আমাদের দাঁড়াতেই হবে।''
দুইজনের মধ্যে বৈঠকে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ, উত্তর কোরিয়া ও পরিবেশ নিয়ে কথা হয়েছে। ক্যানাডার এক কর্মকর্তা সংবাদসংস্থা এপি-কে জানিয়েছেন, ট্রুডো ক্যানাডার অভ্যন্তরীণ ঘটনায় চীনের হস্তক্ষেপ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন।
শি-র আচরণ নিয়ে
চীনে ক্যানাডার সাবেক রাষ্ট্রদূত গাই সেইন্ট বলেছেন, ''শি-র ব্যবহার স্বাভাবিক ছিল ন।'' তিনি মনে করেন, ক্যামেরার সামনে ইচ্ছাকৃতভাবে শি এই আচরণ করেছেন। ক্যানাডার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক কতটা তিক্ত তা এর থেকে বোঝা যাচ্ছে।
২০১৮ সালে চীনা সংস্থার কর্মকর্তা মেং ওয়াংঝাউকে ক্যানাডা আটক করে। তারপর বেজিং দুইজন ক্যানাডার নাগরিককে চরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। তিনজনকেই গত বছর মুক্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু চীন ও ক্যানাডার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক খুবই খারাপ জায়গায় চলে গেছে।