বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা এক রোহিঙ্গাকে ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷ ভুক্তভোগীর বড় ভাইয়ের দাবি এ ঘটনায় সেনা সদস্যরা জড়িত৷ তবে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার বলছেন ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি৷
বিজ্ঞাপন
টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে রোববার সন্ধ্যা সাতটার দিকে এক রোহিঙ্গা কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের তিন সদস্য কিশোরীকে তার ঘরের ভেতরে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছেন কিশোরীর বড় ভাই মোহাম্মদ উসমান৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘একজন মুখ চেপে ধরে রেখেছে, আর দুই জন আমার বোনকে ধর্ষণ করেছে৷ ওর বয়স তের বছর৷’’
ধর্ষণ আর অপহরণের শিকার রোহিঙ্গা এতিম শিশুরা
মিয়ানমার সেনাদের সীমাহীন নির্যাতনের কারণে গত আড়াই মাসে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে৷ সবচেয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখে পড়েছে শিশুরা৷ জন ওয়েনস এর ছবিতে উঠে এসেছে সেইসব দুর্দশার কিছু কথা৷
ছবি: DW/J. Owens
গুলি আর ছুরিকাঘাত
গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়েছে৷ তাদেরই একজন মোহাম্মদ বেলাল৷ দৌড়ে পালাতে পেরেছিল ১০ বছর বয়সি এই কিশোর৷ সে জানায়, ‘‘সেদিন সেনাবাহিনী এসে পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেয়৷ আমার মা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেসময় তাঁকে গুলি করা হয়৷ আমার বাবা হাঁটতে পারছিলেন না, তারা তাঁকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে৷ আমি নিজ চোখে এসব দেখেছি৷’’
ছবি: DW/J. Owens
আতঙ্কগ্রস্ত
মোহাম্মদ বেলালের বোন নূরও হত্যাযজ্ঞ দেখেছে৷ নিঃসঙ্গ হয়ে সে আর তার ভাই এখন বাংলাদেশে শিশুদের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে আছে৷ এখানে সে নিয়মিত খাবার পাচ্ছে এবং খেলতে পারছে৷এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য৷ মিয়ানমারে থাকার সময় তাদের দুই ভাই-বোনকে বেশিরভাগ সময়ই না খেয়ে থাকতে হতো৷ তারপরও সাম্প্রতিক এই ট্রমা থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না সে৷ ‘‘আমি আমার বাবা-মা, বাড়ি আর দেশ, সবকিছুই ভীষণ মিস করছি,’’ জানায় নূর৷
ছবি: DW/J. Owens
গভীর সঙ্কট
৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে চলছে এই সঙ্কট৷ সংঘাতে ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত দু’ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে৷ সাম্প্রতিক সেনা নিপীড়নের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ১২ বছর বয়সি রহমান বলে, ‘‘তারা আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ অসুস্থ ছিল বলে আমার মা পালাতেও পারেনি৷’’
ছবি: DW/J. Owens
শিশুদের বাঁচাও
বাবা-মাকে হত্যার দৃশ্য নিজ চোখে দেখার পর দিলু আরা তার বোন রোজিনার সাথে পালায়৷ এখন ক্যাম্পে আছে ৫ বছর বয়সি এই শিশু৷ ‘‘আমি খুব কাঁদছিলাম আর পুরোটা সময়ই আমাদের মাথার উপর দিয়ে বুলেট উড়ে যাচ্ছিল৷ কোনো রকমে আমি পালিয়ে এসেছি,’’ বলে শিশুটি৷ বাবা-মা ছাড়া কুতুপালংয়ে আসা এই শিশুদের সাহয়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন৷ বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের শতকরা ৬০ ভাগই শিশু৷
ছবি: DW/J. Owens
পশুদের মতো শিকার
জাদেদ আলমও বাবা-মা ছাড়া কুতুপালংয়ে এসেছে৷তবে ভাগ্য ভালো বলে সে তার চাচীকে সাথে পায়৷চাচীই এখন তার দেখাশোনা করছেন৷ সে বলছিল ‘মান্দি পাড়া’ নামে এক গ্রামে বেড়ে উঠেছে সে৷ ফুটবল খেলতেও সে খুব পছন্দ করতো৷ তবে সেনা অভিযানের পর থেকে সবকিছুই বদলে যায়৷ সে জানায়, ‘‘তারা আমাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে বলে৷ আমি আমার বাবা-মা’র সাথে দৌড়ে পালাচ্ছিলাম, এমন সময় তাঁদেরকে গুলি করে সেনারা৷ সাথে সাথে মারা যায় তারা৷’’
ছবি: DW/J. Owens
শিশু অপহরণ
এসব ঘটনার সময় সব পরিবারকেই যে আলাদা হতে হয়েছে, তা নয়৷ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রহমান আলী নামে এই ব্যক্তি এই ক্যাম্পে আছেন৷ তবে এখন তিনি তার ১০ বছর বয়সি ছেলে জিফাদকে খুঁজে পাচ্ছেন না৷ ক্যাম্প এলাকায় প্রায় সারা বছরই শিশু অপহরণের গুজব শোনা যায়৷ রহমানের আশংকা, তাঁর ছেলেও পাচারকারীদের হাতে পড়েছে৷ ‘‘আমি খেতে পারছি না, ঘুমাতে পারছি না৷ আমি মনে হয় পাগলই হয়ে গেছি,’’ বলে রহমান৷
ছবি: DW/J. Owens
‘আমি স্বাভাবিক নেই’
যখন গুলি শুরু হয়, তখন সকিনা খাতুন তাঁর বাচ্চাদের বাঁচাতে প্রাণপণে চেষ্টা করেছে৷ তারপরও ১৫ বছরের ইয়াসমিন আর ২০ বছরের জামালিকে বাঁচাতে পারেননি৷ ঘটনার সময় তারা পাশের গ্রামে ছিল৷ সকিনা বলছিল, ‘‘দাদা-দাদীর সামনে তাদের গলা কেটে হত্যা করা হয়৷ আমি এতটাই অনুভূতি শূণ্য হয়ে পড়েছি যে, এই কষ্টও অনুভব করতে পারছি না৷ তাই এই মুহূর্তে আমি স্বাভাবিক নেই৷’’ দুই সন্তানকে হারালেও বাকি নয় জনকে রক্ষা করতে পেরেছেন তিনি৷
ছবি: DW/J. Owens
হামলা, ধর্ষণ এবং লুটপাট
ইয়াসমিনের বয়স ১৫-র কাছাকাছি৷ তবে তাকে তার চেয়েও কম বয়সি বলে মনে হয়৷ গ্রামে থাকার সময় সে মার্বেল খেলতো আর বাড়ির কাছের মাঠে খেলতো৷ এখন অবশ্য ভিন্ন স্মৃতি তাড়িত করছে তাকে৷ মিয়ানমারের সেনারা তার বাবা ও ভাইদের প্রথমে মারধর ও পরে হত্যা করে৷ একদল সেনা তাকে ধর্ষণও করে৷ এখন ইয়াসমিন কেবল এটুকু বলতে পারে,‘‘আমার শরীরে ভীষণ ব্যথা৷’’
ছবি: DW/J. Owens
8 ছবি1 | 8
ঘটনার পর ভুক্তভোগী কিশোরীকে প্রথমে শরণার্থী শিবিরের চিকিৎসাকেন্দ্র এবং পরবর্তীতে কক্সবাজার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় বলেও জানিয়েছেন উসমান৷ তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালের সবগুলো পরীক্ষায় ধর্ষণ প্রমাণ হয়েছে৷ কিন্তু রিপোর্টগুলো তারা রেখে দিয়েছে৷’’
ভুক্তভোগী বর্তমানে শরণার্থী শিবিরে নিজের বাড়িতে রয়েছেন৷ তবে তার আরো চিকিৎসার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন উসমান৷ তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালে ওর ভালো চিকিৎসা হয়নি৷ ও অসুস্থ, বিছানায় পড়ে আছে৷ ওর সারা শরীর ব্যথা করছে৷ ওকে যে ধর্ষণ করা হয়েছে এটাই প্রমাণ৷’’
তিনি বলেন, ‘‘ওর যৌনাঙ্গ এবং স্তনের বোঁটায় দাগ রয়েছে৷’’
ধর্ষণের অভিযোগ তদন্তে সংশ্লিষ্ট শরণার্থী শিবিরের সরকারি কর্মকর্তারাসহ ব়্যাব ও সেনা সদস্যরা মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে বলেও জানান উসমান৷ তিনি বলেন, ‘‘আজকে বারোটার সময় আসছে ওরা৷ ঘটনা কিভাবে ঘটেছে জানতে চেয়েছে৷ আমার সঙ্গেও কথা বলেছে৷ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন যে, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দেয়া হবে৷’’
প্রসঙ্গত, ১৯৯২ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্য এই কিশোরী৷ তার জন্ম বাংলাদেশে৷ কিশোরীর পরিবার নয়াপাড়ার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা৷ তার এক প্রতিবেশী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডয়চে ভেলেকে জানান, (ধর্ষণের সময়) ওই কিশোরী গোঙ্গানির মতো শব্দ করলে আশেপাশের লোকজন টের পায়৷ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা চলে গেলে সেই কিশোরীকে তার প্রতিবেশীরা শিবিরের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায় বলেও জানান তিনি৷
‘‘বলাৎকার বা ধর্ষণের শিকার মেয়েটির রক্তক্ষরণ হচ্ছিল,’’ বলেন প্রতিবেশী৷
চিকিৎসা কেন্দ্রে কিশোরীকে দেখেছেন এমন এক রোহিঙ্গা নারী ডয়চে ভেলেকে জানান, কিশোরী হাঁটতে পারছিল না৷ ‘‘তাকে দুই জন দুই দিক থেকে ধরে হাসপাতালের ডেলিভারি রুমে নিয়ে যায়,’’ বলেন তিনি৷
রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশিক্ষণ আছে, অস্ত্র নেই
04:07
রোহিঙ্গা শিবিরে কিশোরী ধর্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর মুখপাত্র জোসেফ ত্রিপুরা ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত আছেন বলে জানান৷ তিনি বলেন, ‘‘এ ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগী শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসাসেবাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়ার উপযুক্ত৷’’ তবে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে বেশি তথ্য দিতে রাজি নয় ইউএনএইচসিআর৷
এই বিষয়ে উখিয়ায় সামরিক বাহিনীর শিবিরে যোগাযোগ করা হলে ধর্ষণের খবরটি ‘মিথ্যা, গুজব’ বলে দাবি করা হয়৷ আর শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোঃ মাহবুব আলম তালুকদার ডয়চে ভেলেকে জানান, সেই কিশোরীকে কক্সবাজার ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে, তবে ‘ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি৷’
তিনি বলেন, ‘‘ওটা ধর্ষণের ঘটনা নয়৷ ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গেছে ওটা ধর্ষণের ঘটনা নয়৷’’
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেদেশের সেনাবাহিনী ভয়াবহ অভিযান শুরু করলে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন৷ অতীতেও এভাবে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন আরো রোহিঙ্গা৷ সব মিলিয়ে দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে অবস্থান করছেন৷