টেস্ট ক্রিকেটকেই প্রহসন বানিয়ে ফেলছে বাংলাদেশ
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১অথচ এমন যে হতে পারে কে ভেবেছিল? আকাশে মেঘ থাকলে তবেই না বৃষ্টির শঙ্কা! ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগে বাংলাদেশের ক্রিকেটাকাশে ছিল না মেঘের ওড়াওড়ি৷ বরং ওয়ানডে সিরিজে আয়েশী জয়ের রেশে সোনারোদের ছড়াছড়ি৷
দুই দশকের টেস্ট ক্রিকেট পথচলায় সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন আগেও উঠেছে৷ টেস্টের অভিজাত অঙ্গনে ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশ পায়ের নীচের মাটি শক্ত করার জন্য একটা ফর্মুলা বের করেছিল৷ ঘরের মাঠে স্পিনিং উইকেট বানিয়ে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার৷ সেভাবে ইংল্যান্ডকে হারানো গেছে, অস্ট্রেলিয়াকে হারানো গেছে৷ কিন্তু ওই চোরাগলিতে হাঁটতে গিয়ে যে নিজেরা আরো চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পারেনি৷ যে কারণে টেস্টশিশু আফগানিস্তানের কাছে হারতে হয়েছে৷ এরপর খর্বশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে দুটো টেস্টেই পরাজয়৷ সেবার রশিদ খান, এবার রাহকিম কর্নওয়ালের কাছে আত্মসমর্পণ বাংলাদেশের৷
বাংলাদেশের বোলিং শক্তি বরাবরই স্পিননির্ভর৷ ২০০৫ সালে লাল-সবুজের প্রথম টেস্ট জয়েও ম্যান অব দ্য ম্যাচ বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র৷ নিজে স্পিনার হয়েও বাংলাদেশের এখনকার অতিমাত্রায় স্পিন-নির্ভরতা পছন্দ নয় তার৷ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পরাজয়, তথা টেস্ট ক্রিকেটে সামগ্রিক বিপর্যয়ের বড় একটি কারণ এটিই মনে হচ্ছে এনামুলের, ‘‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে আমাদের লাল বলে প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল৷ একাদশ নির্বাচনও ভালো হয়নি৷ দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে পেসার আবু জায়েদ চার উইকেট নিয়েছে৷ কিন্তু আরেকটি পেসার আমরা খেলাইনি৷ প্রথম টেস্ট থেকেও শিক্ষা নিইনি৷ ভেবেছিলাম, স্পিন দিয়েই প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেবো৷ দুই টেস্টেই পেসারের ঘাটতি ছিল৷ স্পিন দিয়ে হারিয়ে দেবো, এই ভাবনার জায়গা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে৷’’
এই ভাবনার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক যে ভারত, তারাও সেখান থেকে সরে এসেছে৷ বাংলাদেশকেও ওই তাগিদ দিচ্ছেন এনামুল৷ সেটি নিজেদের সময়ের সঙ্গে তুলনা করে৷ আর একাদশে চার স্পিনার খেলানোর কোনো যৌক্তিকতাই দেখেন না তিনি, ‘‘আমাদের সময়ে যে টেস্ট জিতেছি, সেখানে দুটো ফাস্ট বোলার ছিল৷ তাপস বৈশ্য ও মাশরাফি৷ ওরা ঠিক জায়গায় ব্রেক থ্রু দিয়েছে৷ আমরা চার বোলার নিয়ে খেলেছি৷ আমি, রফিক, তাপস ও মাশরাফি৷ টেস্টে এর চেয়ে বেশি বোলারের বোলিং করারই সুযোগ থাকে না সেভাবে৷ আমরা চার স্পিনার নিয়ে খেলেছি৷ স্পিনাররা তো লম্বা স্পেলে এমনিতেই বোলিং করেন৷ টেস্ট ম্যাচ জেতালে চার বোলারই জেতাবে৷’’
২১ বছরে মোট ১২১ টেস্ট খেলে বাংলাদেশের জয় মোটে ১৪ ম্যাচে৷ ১৬ বছর আগে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জেতে এই এনামের ঘূর্ণিতে৷ প্রথম সিরিজ জয়ও সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে৷ পরের সময়টায় বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের উন্নতি না হওয়াটা হতাশ করে এখনো ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা চালিয়ে যাওয়া স্পিনারকে, ‘‘বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট অবশ্যই আমাকে হতাশ করে৷ এখনো আমাদের দল সাদা-বল কেন্দ্রিক৷ লাল বলে এখনো সেভাবে মনোযোগ দিইনি৷ সে জায়গাকে হেয় করি৷ লাল বলে একদমই কম খেলি আমরা৷ তাহলে উন্নতি হবে কিভাবে?’’
প্রথম টেস্ট জয় যার নেতৃত্বে, সেই হাবিবুল বাশার এখন জাতীয় নির্বাচক৷ টেস্ট ক্রিকেটের রূগ্নদশায় উদ্বিগ্ন তিনিও৷ পাশাপাশি ঘুরে দাঁড়ানোর আশাও ছাড়েন না, ‘‘টেস্ট ক্রিকেটে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে ভালো করছি না৷ কিন্তু আমাদের তো প্রথম পরিচয় টেস্ট খেলুড়ে দেশ৷ আমাদের তাই ঘুরে দাঁড়াতে হবেই৷ শ্রীলঙ্কা নিজেদের মাটিতে অবশ্যই ভালো দল৷ তবে আশা করছি, সেখানে আমরা ভিন্ন ফল পাবো৷ ক্রিকেটারদের উপর সে আস্থা রয়েছে৷ বোলিংটা ভালোই আছে৷ ব্যাটিংটা ভালো হলে শ্রীলঙ্কায় টেস্টে ভালো করার ভালো সুযোগ আছে৷’’
আসলেই কী ভালো করার সুযোগ আছে বাংলাদেশের? টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি কর্তা থেকে শুরু করে ক্রিকেটারদের মনোভাব কি বদলাবে? শ্রীলঙ্কা সফরেই যেমন টেস্ট খেলতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশের ইতিহাসের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান৷ কারণ? আইপিএল খেলার জন্য ছুটি চাই৷ বিসিবি সে ছুটি অনুমোদনও করেছে৷ তাহলে যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে টেস্ট সিরিজে হারের পর ভীষণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন, ‘এভাবে চলতে দেয়া যায় না’ বলে গণমাধ্যমে হুঙ্কার দিলেন, সেসব কেবলই ফাঁকা বুলি? সাকিবও যে টেস্ট সিরিজে ধবলধোলাই হবার পর সবাই মিলে এই অবস্থা থেকে বেরোনোর তাগিদ দিলেন, সেটিও কি নিছক কথার কথা?
বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের চরম দুর্দিনে সেরা ক্রিকেটার টেস্ট ছেড়ে আইপিএলে খেলেন, বোর্ডও তা মেনে নেয়, এরপরও এই ফরম্যাটে বাংলাদেশ ভালো করবে! বিদ্রুপের মতোই তো শোনায়, নাকি? মর্যাদাপূর্ণ টেস্ট ক্রিকেটকেই বাংলাদেশ মর্যাদাহীন এক প্রহসনে রূপ দিয়েছে, নয় কি?