জার্মানির রাজধানী বার্লিন৷ ৩৫ লাখ মানুষের শহরে ট্যাক্সি চলে সাড়ে সাত হাজারের বেশি৷ কারা চালান এই সব ট্যাক্সি? কারা ওঠেন সেই সব ট্যাক্সিতে? কেমন তাঁদের অভিজ্ঞতা?
বিজ্ঞাপন
বার্লিনে বাস করেন মোট ৩৫ লাখ মানুষ, কিন্তু এখানে এত বেশি ট্যাক্সি চলার সেটাই একমাত্র কারণ নয়৷ যেমন পর্যটন, তেমনই ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল এই বার্লিন৷ এ শহরে ট্যাক্সির সংখ্যা: প্রায় সাত হাজার ছ'শো৷
মার্টিন ডল গত ২৪ বছর ধরে বার্লিনে ট্যাক্সি চালাচ্ছেন৷ গোড়ায় ছিলেন ছাত্র, খরচ চালানোর জন্য ট্যাক্সি চালাতেন৷ পরে সেই ট্যাক্সি চালানোই তাঁর মূল পেশা হয়ে দাঁড়ায়৷ আজ তাঁর ট্যাক্সি চলে বার্লিন ও তার আশেপাশের প্রায় ৯০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে৷ মার্টিন বলেন:
‘‘শহরটা এত বড় বলেই হয়ত আমি সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি মাস-দু'মাস ধরে শহরের কোনো কোনো অংশে ঢুকি না৷ ট্যাক্সিচালক হিসেবে প্রতিবারই আমি আশ্চর্য হই যে, বার্লিনে কতো কিছু বদলে গেছে৷ বার্লিনে তো সর্বত্র কনস্ট্রাকশন চলেছে: সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে হয়তো কোথাও রাস্তা বন্ধ ছিল৷ হঠাৎ দেখি সেখানে সব ব্যারিয়ার সরিয়ে ফেলা হয়েছে আর সে জায়গায় কোনো নতুন বাড়ি কিংবা ব্রিজ কিংবা শপিং সেন্টার গড়ে উঠেছে৷''
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ট্যাক্সি
সারা বিশ্বেই ‘ট্যাক্সি’ আজ শুধু যানবাহন নয়, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের একটা জায়গা হয়ে উঠেছে৷ ট্যাক্সিটি নতুন, পুরনো, ভাঙা বা বিলাসবহুল – যাই হোক না কেন, সেটায় বসেই যাত্রী সে দেশটিকে, দেশের মানুষকে দেখতে, ও জানতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উজ্জ্বল হলুদ রঙের ট্যাক্সি
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের হলুদ রঙের এই ট্যাক্সিগুলো পরিচিত ‘ইয়েলো ক্যাব’ নামে৷ বিশ্বখ্যাত এই ট্যাক্সিগুলো মজবুত এবং আয়তনে বেশ বড় হলেও, ১৯৮০ সালের পর থেকে আর তৈরি হয়নি৷ তাছাড়া পুরনো এই ট্যাক্সিগুলো চালাতে বেশি পেট্রোল লাগলেও, আজও নিউ ইয়র্কের রাস্তায় মাঝে মাঝেই এগুলি চোখে পড়ে৷ শোনা যায়, ১৯৯৯ সালে এই হলুদ ক্যাবের দাম নিলামে ১৩৪,৫০০ অ্যামেরিকান ডলার পর্যন্ত উঠেছিল৷
ছবি: imago/Manfred Segerer
মেয়েদের জন্য গোলাপি রঙের ট্যাক্সি
মেক্সিকোয় বড় শহরগুলোর রাস্তা তেমন নিরাপদ নয়৷ তাই মেক্সিকো-সিটি এবং পুয়েব্লার পৌরসভা সেখানে ‘পিংক ক্যাব’ ট্যাক্সি চালু করেছে৷ উজ্জ্বল গোলাপি রঙের এই ট্যাক্সির চালকরা যেমন মেয়ে, তেমনি যাত্রীও শুধুই মেয়ে এবং শিশুরা৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে, নারীচালিত এই ট্যাক্সিতে জিপিএস, ইমারজেন্সি বোতাম এবং কসমেটিক্স বক্স – এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সবসময় থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অতীতে ফিরে যাওয়া
কিউবার রাস্তায় এখনো পুরনো গাড়ি, মানে ‘ওল্ডটাইমার’ চলতে দেখা যায়৷ এদের মধ্যে অধিকাংশই মার্কিনি৷ ১৯৫০ এবং ৬০-এর দশকের এমন অনেক গাড়ি ইতিমধ্যেই ১০০,০০০ কিলোমিটারের ঘর পার করেছে৷ তাই আজকের এ যুগে ঐ গাড়িগুলোয় চড়া পর্যটকদের জন্য এক অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা৷ তার ওপর এগুলো ‘শেয়ার ট্যাক্সির’ মতো কাজ করায়, পথে যাত্রী ওঠা-নামা করে৷ ফলে স্থানীয়দের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় সহজেই৷
ছবি: picture-alliance/Horst Galuschka
ইচ্ছে মতো যাত্রী তোলা
গণ প্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসার ট্যাক্সিগুলিতে কতজন যাত্রী তোলা হবে – তার কোনো নিয়ম-কানুন নেই৷ ফলে ট্যাক্সিতে চালকের ইচ্ছেমতো যাত্রী তোলা হয়৷ তবে এ ছবি শুধু আফ্রিকায় নয়, বাংলাদেশের রাস্তাতেও নিত্যদিনের দৃশ্য৷ আসলে বেশিরভাগ সময় যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য আর কোনো বিকল্প উপায় থাকে না বলেই শেষ পর্যন্ত এরকম ভর্তি ট্যাক্সিতে ওঠেন তাঁরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দুবাইয়ের ‘লাইফলাইন’ জলট্যাক্সি
এখানে যতগুলো সেতু আছে, তারচেয়েও বেশি আছে জলট্যাক্সি৷ খাঁড়িগুলিতে অবশ্য শুধুমাত্র কাঠের তৈরি জাহাজগুলোরই চলাচলের অনুমোদন আছে৷ তবে ‘আব্রাস’ নামের ছোট্ট এই নৌকাটিও অন্ততপক্ষে ২০ জন মানুষকে তুলতে পারে৷ আর এই জলট্যাক্সিতে শ্রমিক, ম্যানেজার, পর্যটক – যেই উঠুন না কেন, সবার জন্যই ভাড়া মাত্র ২০ সেন্ট৷ সম্ভবত বিশ্বের আর অন্য কোথাও এত কম ভাড়ায় ট্যাক্সি চড়া যায় না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অমানবিক কাজ
জাপানে আবিষ্কৃত রিক্সা প্রথমে এশিয়ার দেশগুলিতে পরিচিতি পেলেও, ইতিমধ্যে সাইকেল রিক্সা হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এর চল রয়েছে৷ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবশ্য টানা রিক্সা শহরের প্রায় সব জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে৷ আজকের যুগে মানুষ-টানা রিক্সাকে রাজনীতিবিদ সহ অনেকেই অমানবিক বলে মনে করেন৷ তাই তাঁরা এ ধরণের রিক্সা একেবারেই তুলে দেওয়ার পক্ষে৷
ছবি: Gemeinfrei
সন্নাসীরাও ট্যাক্সিতে ওঠেন
থাইল্যান্ডে ট্যাক্সি চড়ে ঘুরে বেড়ানোটা বেশ মজার একটা ‘অ্যাডভেঞ্চার’৷ তবে ওখানকার তিন চাকাওয়ালা ‘টুক-টুক’-এ চড়তে শক্ত নার্ভ আর স্থিতিশীল পাকস্থলী থাকা প্রয়োজন তা না হলে মুসকিল৷ অন্যদিকে আরামদায়ক গাড়ির মধ্যে লিমোজিন অন্যতম৷এই গাড়িতে ওঠার আগে পর্যটকদের ভাড়া সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা ভালো৷ থাইল্যান্ডে সন্নাসীদের বিশেষ অবস্থানের কারণে তাঁরা এই ব্যয়বহুল লিমোজিনে উঠতে পারেন, তাও আবার বিনা পয়সায়৷
ছবি: picture-alliance/Sebastian Kahnert
বিরক্তিকর!
কম্বোডিয়ায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য সাইকেল রিক্সা, মোফাট্যাক্সি, মিনিবাসের মতো নানান যানবাহন রয়েছে৷ তবে ‘পিকআপ’ হচ্ছে সস্তা যানবাহনের একটি৷ আরাম যার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে এতে চড়তে পারেন৷ তবে ‘পিকআপ’-এ চড়ার আগে এটা ধরেই নিতে হবে যে, তাঁকে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে কষ্ট করে বসতে হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
সবুজ চা পান
চীনের প্রধান শহরগুলোতে ট্যাক্সিই মূল যানবাহন৷ শুধুমাত্র পেকিংয়েই চলে প্রায় ৬৬,০০০ ট্যাক্সি৷ শুধু তাই নয়, ট্যাক্সিতে খুব কম খরচে এবং সহজে যাতায়াত করা যায়৷ তবে বেশিরভাগ ট্যাক্সি চালক ইংরেজি না জানায়, গন্তব্যস্থলটি চীনাভাষায় লিখে চালককে ধরিয়ে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ৷ পর্যটকদের এটাও জানা দরকার যে চীনা ট্যাক্সি চালকরা যখন-তখন সবুজ চা পান করেন৷ তাই আপনাকেও যদি সেই চা খেতে বলা হয়, তাহলে ভয়ের কিছু নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জলের ওপর বিলাসবহুল ট্যাক্সি
ইটালির ভেনিস শহরে হাতে গোনা পিচ ঢালা সমান্তরাল রাস্তা রয়েছে৷ কারণ শহরটি রাস্তার বদলে সরু সরু খালে ভর্তি৷ দেড় হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরের বুকে শহরটির গোড়াপত্তন হয়৷ আর তখন থেকেই ছোট ছোট নালা বা খালের ভেতর দিয়ে চলতো কাঠের তৈরি সোনালি-কালো গন্ডোলা৷ দাঁড় বেয়ে মাঝিরা এই রোম্যান্টিক নৌকা চালান, রাতের বেলায় যাতে ৪০ মিনিট চড়তে খরচ হয় ১০০ ইউরো৷ আজকাল অবশ্য ইলেক্ট্রিক জলট্যাক্সিও পাওয়া যায় ভেনিসে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
ক্রিম-কলর্ড মার্সিডিজ
১২০ বছর ধরে জার্মানিতে ট্যাক্সি চলছে৷ গোড়ায় ট্যাক্সির রং ছিল কালো, বলতে কি বহু দশক ধরে৷ ১৯৭১ সাল যাবৎ নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে যে, ট্যাক্সির রং হতে হবে ‘‘গজদন্তের মতো'' হলুদ-সাদা৷ বহুকাল ধরে জার্মানিতে ট্যাক্সি মাত্রেই ছিল মার্সিডিজ, কিন্তু আজকাল নানা মডেলের ট্যাক্সি দেখতে পাওয়া যায়৷
বার্লিনে ট্যাক্সির ভাড়া তুলনামূলকভাবে বেশি নয়৷ ২০ মিনিটে দশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ভাড়া ওঠে ২০ ইউরো মতন৷ কাজেই ট্যাক্সি চালিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে হলে মার্টিন ডল-এর মতো নিজের ট্যাক্সি থাকা চাই৷ মার্টিনের ভাষ্যে:
‘‘শুনেছি নাকি এমন ট্যাক্সিচালক আছেন, যাঁরা ঘণ্টায় চার থেকে আট ইউরো রোজগার করেন, যা কিনা সরকারি ন্যূনতম মজুরি থেকেও কম৷ আমি নিজের ট্যাক্সি চালাই যতক্ষণ খুশি – কিন্তু তা সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টা বা তারও বেশি হয়ে দাঁড়াতে পারে৷''
যা টুরিস্ট গাইডে নেই
বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর পটসডামার প্লাৎস চত্বরটিকে নতুন করে সাজান ইটালির স্থপতি রেনসো পিয়ানো৷ চত্বরটি পর্যটকদের কাছে একটি দর্শনীয় বস্তু৷ মার্টিন ডল-কেও বারংবার এই প্রশ্ন শুনতে হয়, তিনি বার্লিনে দেখবার মতো এমন কিছু চেনেন কিনা, যা টুরিস্ট গাইডে নেই৷ চেনেন বৈকি: বার্লিনে যখন সন্ধ্যা নামে, তখন ট্যাক্সিচালকদের কাজ বাড়ে৷ মার্টিন ডল নিজে প্রায় দশ বছর ধরে শুধু রাত্রে ট্যাক্সি চালিয়েছেন৷ ফ্রিডরিশহাইন-ক্রয়েৎসব্যার্গ হলো হালের ফ্যাশনেবল গন্তব্য৷ বার্লিনের মানুষ একটি পার্টি থেকে আরেকটি পার্টি, একটি নাইট ক্লাব থেকে আরেকটিতে যেতে ভালোবাসেন – ফলে ট্যাক্সিচালকদের পোয়াবারো৷ কোনো কোনো নাইট ক্লাব সপ্তাহান্তে চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে৷